৮ম শ্রেনী আমার জীবনের ইতিহাস। এই ক্লাসের ই সেকশনটা সেরা ছাত্রদের স্পেশাল বৃত্তি ক্লাস দিয়ে নিয়মিত ক্লাসের সময় থেকে ২ ঘন্টা আগেই শুরু হতো। ৭ম শ্রেনীর মতন এই শাখাটাও ছিল সব ক্লাসিক্যাল স্যারদের ঠিকানা। তাও আবার সম্পুর্ন দুইটা ক্লাস একজন একসাথেই নিতেন। বরাবরের মতো ভালো রেজাল্টের জন্য এই সেকশনটাই আমার কপালে ছিলো সত্যি বলতে কি আমি যারপরনাই খুশি ছিলাম আল্লার কাছে, গর্বে বুকটা ফুলাইয়া গেলাম ভর্তি হতে। অমা এ দেখি কি! সাক্কাত যমদুত যেন জীবন দেখে যান কবজ করতে বসে আছেন।আমার দেখা সর্বকালের সেরা প্রিয় স্যার ফয়সল স্যার। আমাকে দেখার সাথেসাথেই ডাক দিয়ে কাছে নিলেন। তহ তোমার পাস মার্ক আমার ক্লাসে তোমাকে নিয়ে এসেছে। আমি সত্যি খুশি কিন্তু তোমাকে আমি ভর্তি করবো না। আজকের জন্য সময় দিলাম তুমি ভালো করে চিন্তা করো তারপর কালকে এসো। সাথে ১০০টা নীয়ম এক নাম্বারেই ছিলো, বৃত্তি ক্লাসে নীয়মিত আসতে হবে(আমি কি কোন নীয়ম মানি ?একদিনও যাই নাই) নীয়মিত ক্লাসে আসতে হবে(৮ম শ্রেনীতেই সিলেটের সবকটা সিনেমা হল পরিদর্শন শেষ) পরীক্ষাতে নকল মারতে পারবে না(জীবনের প্রথম নকলে দরা খাই কম্পোজ কপি নিয়া তাও সরাসরি ফয়সল স্যারের হাতে!) । হায়রে স্যারের বেতের বাড়ি। একটা সহপাটি ছিল পিচ্চি , সাধা দবদবে (লিপস্টিক ছেলে) হাত দিয়ে গালে আদর করলে আঙ্গুলের চাপ পড়ে যায়। যাই হোক পড়া ফাকি দেওয়ার ব্যাপারেই সম্ভবত স্যার থাকে আসার নির্দেশ দিলেন। আমি সবসময় বন্ধুদের সাহস দিতাম,তহ তাকে আগেই বলেছি ছিনা চওড়া করে মার খেতে, যাই হোক সাবাল সাব খোভ ভয় নিয়ে স্যারের কাছে গেলেন, স্যার বললেন হাত দে, আমিও ইশারায় বলতেছি দিয়ে দে‘ না উনি ভান করবেনই, বিশ্বাস করবেন না নতুন জালিবেতের প্রথম বাড়িতেই বেতের আগা ভেঙ্গে ক্লাসের শেষ মাথায়। বেন্ঞ থেকে উঠে বেতের ঠুকরাটি সংগ্রহ করলাম অবশ্য ক্যাপটেনের অনুরুদে তাকেই দিলাম সে রাখবে সারা জীবন আর ওই দিকে সুন্দরি ভাইসাবের উপর বেদম প্রহার অবিরত চলছেই। যতক্ষন না উনার কান্না জলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলো।
আচ্ছা এখন আসি আমার বেলা । একদিনের ঘটনাই বলি।সাধারন স্কুলে না আসার জন্যই আমরা সাতজন অপরাধি আসামির কাঠগড়ায়! প্রহার চলছে ‘ সে কি প্রহার আমাদের অবস্তা দেখে অন্যরা যারা নিরাপদ তাদেরই কষ্ট হয়তো একটু বেশিই হয়। অনেককে আমি দেখছি আমাদের জন্য কাদতে যাই হোক সবার কপালে সাতটা করে বাড়ি গুনে গুনে। আমিতো জানি গুরু আসবেন শিষ্যের কাছে শেষ রাতে কিছুটা সময় হাতে নিয়ে, ভালোবাসাতো একটু বেশিই তাই হয়তো দিগুন কি তিনগুন তা একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লার বোধগম্য। সবাই মার খেয়ে বেন্ঞে এখন আমার বেলা। আমাকে হাত দে বলা লাগে না এইটা সর্বদাই রেডি। ডান হাত পরে বাম হাত অবিরত আমারও কোন অনুভুতি নেই শুধু ভালো লাগা । স্যার পনেরাটা হইছে ২১টা করেন । স্যার বলেন কি কষ্ট লাগে না ? স্যার আপনার দেওয়া ভালোবাসায় বেহেস্তের ঠিকানা। স্যার - যাও গিয়ে বসে পড়ো। আমি লাস্ট বেন্ঞ থেকে দেখছি স্যারের চোখে বিন্দু বিন্দু জল স্যার খোব চাতুর্যের সাথে ঘোপন করছেন। এটা জানা কথা একটু পর স্যার আমায় ডাকবেন,আমি নিজ থেকে নিলডাউন হয়ে বসবো যাতে স্যারের কষ্ট না হয় চেয়ার থেকে বসে আমার সাথে কথা বলতে। স্যার বড় মমতায় দীর্ঘসময় নিয়ে আমাকে বুজবেন আর বুজাবেন । কথাগুলো আমাদের মধ্যে চলে খোভ গোপনে। স্যার জানেন আমি উনার কাছে মিথ্যা বলি না।
যেমন একদিনের কথা, তুমি কি সবসময় স্কুল ফাকি দাও ? জ্বি না স্যার মাজেমধ্যে। হুমমম ফাকি দিয়ে হলে ছবি দেখো? জ্বি স্যার। আচ্ছা(স্যারের একটু রসিকথা) সিলেটে সর্বমোট কয়টা সিনেমা হল আছে। স্যার সবকটা মিলিয়ে সাতটা।
আচ্ছা তুমি সত্য কথা বলো তাই আমি কিছু করি না, তবে কালকে থেকে আর স্কুল কামাই না, ঠিক আছে? ইনশাহআল্লাহ স্যার। উহু এটা বললে হবে না তুমি নিশ্চয় আর এমন করবে না।
একদিন মনে আছে আমি ভিষন প্রতিবাদ করছিলাম এমনকি জীবনের প্রথম স্যারের চোখে চোখ রেখে উচ্ছ স্বরে বলেছিলাম যা সত্য তা , যে স্যার ভুল করছেন। নীল ডাউন থেকে উটে সামনের বেন্ঞের ক্যাপটেনের পানির বোতল নিয়ে সব পানি মাথায় ডাললাম, ক্লাসে পিন পতন নীরবতা, সিনিয়র স্যারদের মধ্যে যুবা এই আদর্শবান ফয়সল স্যারের সাথে এমন প্রতিবাদ যার কোন রেহাই নাই। আমি পানিতে চুল ভিজিয়ে স্যারকে বললাম স্যার যা সত্য তাই যারতরে আপনিও কিছু না। স্যার বললেন যাও তুমি কিছু সময় রেস্ট নাও পরে কথা বলছি। সেদিন নীলডাউন হয়ে কোন প্রহার ছাড়া শুধু স্যারের স্নেহে অনেক কেদেছি। স্যারও আমাকে সামলাতে পারছেন না। সেদিন হয়তো স্যার বুজেছিলেন আমি সত্যি ভালো হয়ে গেছি। তুমি কখনও একা নও , তুমি একাই সবাইকে রাস্তা করে দেবে।আবেগঘন সেই ক্লাসটি আমি ভুলতে পারি না।
লম্বা আর চেহারার উগ্রতাই হয়তো অন্যের দোষ সবসময় আমার ঘাড়েই আসতো, তাই অন্যের হয়ে দুইটা বাড়ি খেয়ে নিজেকে প্রবোধ দিতাম এটা আমার জন্য ভালোই। একদিন পন্ডিত স্যার অনুপস্তিত থাকায় হান্নান স্যার আসলেন ক্লাস নিতে। তখন নিমাই দাদু এসে নোটিস পড়লেন আজকে ক্লাস বিরতিতে স্কুল ছুটি হবে। শোনে সবাই ছুটির খোশিতে উল্লাসে কথাবলা শুরু করলো। হঠাৎ আমার ডান হাতের পেশিতে জালিবেতের প্রহার উপলব্দি করলাম। বিনা কারনে মার একবার না বহুবার তহ স্যার ক্লাস শেষ করে চলে গেলেন। একটি ক্লাস চলছে টিচার নাই আমরাই মজা করতেছি। এক সহপাটি সার্টের ফাকে দিয়া আমার আঘাতের চিহ্ন দেখে সার্টের বোতাম খোলে দেখছে। একটু পড়েই স্কুল ছুটি, আমি মার হজম করা নিয়ে ওর সাথে কথা বলছি, হঠাৎ ফয়সল স্যার ক্লাসে ডোকলেন। বাইরে থেকেই তিনি আমাদের ফলো করছিলেন। আমার সত্যি খোব ভয় হলো কারন আমি কথা বলতে ছিলাম। স্যার আমার কাছে এসে হাতের গোড়ালিটা সার্টটা সড়িয়ে ভালো করে দেখতে লাগলেন। কে মারছে? - জ্বি স্যার? ‘তোরে নির্দয়ে মতো কে মারছে? একসহপাটি বলে দিলো। বাকিটা থাক আর বলতে পারবো না। হান্নান স্যার, হেডমাস্টার মানস বাবু স্যার আর আমার ফয়সল স্যার‘ আমার চোখ এখনও বিজা স্যার, হান্নান স্যার ক্ষমা চান এইটা আমি চাই নাই , আল্লাহ কেন আমাকে এতো ভালোবাসেন যে আপনাদের স্নেহে আমি ছাত্র হয়েছি !
(আবু হেনা স্যার আর নেই! সবজানতা স্যার অনেক আগেই চলে গেছেন, উনার মৃত্যুতে বোজে ছিলাম কেন ফয়সল স্যার বলতেন আবু হেনা স্যার আসলে যতটুকু পারো জানার চেষ্টা করিও, আসলেই স্যার বাংলাদেশের পন্ডিত ছিলেন উনার উপাদি ছিল ‘সবজান্তা‘। জিন্দাবাজারের আবু হেনা স্যার ইতিহাস ও রাজনীতিতে অমর অক্ষয়, মানস বাবু সেরাদের সেরা প্রধান শিক্ষক যার রক্তে ছিল মানুষ গড়ার মন্ত্র)
তাদের ভালোবাসাই অমর , তাদের প্রেম অক্ষয় ......
পরে হবে আরো কিছু কথা বন্ধু সেই অবদি ভালো থেকো।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৮