somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জসীমউদ্‌দীনের বাংলাদেশ!

১২ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১০:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জসীম উদ্‌দীন কি শুধুই কবি? তাঁকে কেবল কবি বললে তা হবে সাহিত্য-সংকীর্ণতার বহিঃপ্রকাশ। তাঁর বিশাল গানের ভুবনে স্বরচিত এবং সংগৃহীত অনেক গান রয়েছে। তাঁর লেখনী আজীবনই সচল ছিল স্নিগ্ধ মাটির গন্ধ, মাতাল হাওয়া, খেটে খাওয়া মানুষের পুঁথি-ইতিহাস ও নদীমাতৃক প্রেমে ভরা পল্লিগাথায়। জসীম উদ্‌দীন কবিতার বাইরে রচনা করেছেন, গান, নাটক, কাব্যনাটক, উপন্যাস এবং স্মৃতিকথা। তবে এতকিছুর পরও জসীমউদ্দীন লোকজ গানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যদিও পরবর্তী সময়ে আবদুল লতিফ, কানাইলাল, শাহ আবদুল করিম, মমতাজ আলী খান এবং শমসের আলী খানরা তাঁকে অতিক্রম করার বহু চেষ্টা করেছেন। লোকজ এবং মাটির গানগুলোকে তুলে দিয়েছেন শহর এবং গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। আধুনিক গান, ইসলামি গান, পল্লিগীতি, জারি, সারি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালাগান এবং উর্দুসহ অসংখ্য গান লিখে বাংলাগানের জগতকে করেছেন সমৃদ্ধ। জসীম উদ্‌দীন হিরন্ময় গানের ছোঁয়ায় আব্বাসউদ্দিন হয়ে ওঠেন একজন সহজাত শিল্পী। তবে পল্লিগীতিতে তাঁর মৌলিকতা এবং সাফল্য উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। এই কবি আপন প্রতিভাবলে নিজেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন বাংলা সাহিত্যে এবং সংগীতে। লালন, রবীন্দ্র কিংবা নজরুল আমাদের গানের ভুবনে এনেছেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কিন্তু জসীম উদ্‌দীন জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মারফতি গানে আমাদের বিভিন্নভাবে মোহিত করেছেন। জসীম উদ্‌দীন কালজয়ী এসব গান কেন জানি অনাদর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। 'রঙিলা নায়ের মাঝি'-তে অন্তর্ভুক্ত গানগুলোর মধ্যে ৩৪টি কবির স্বরচিত এবং বাকি ১৪টি সংগৃহীত। গানগুলো আমাদের মনকে কেবল আলোড়িতই করে না, আলোকিতও করে। (এই অংশটি নেওয়া হয়েছে)




বাংলা ভাষার আধুনিক যুগের কবিদের নাম বলতে গেলে প্রথমেই যে কয়েকজনের নাম মনে আসে, জসীম উদ্‌দীন তাঁদেরই একজন। তাঁর আগে জন্ম নেওয়া কবিদের মধ্যে মধুসূধন আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান। তাঁরা বড় হয়েছেন সচ্ছল পারিবারিক পরিবেশে। পরিবারেই তাঁরা পেয়ে গেছেন আধুনিক শিক্ষার উন্নত পরিবেশ। নাগরিক সংস্কৃতির পরিমন্ডলে বড় হওয়ায় এদিক দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন তাঁরা। মাইকেল মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের মতন জমিদার পুত্র না হলেও জীবনান্দ দাশও ছিলেন নগরজীবনের পরিশীলনেে এগিয়ে থাকা পরিবারেরই সন্তান। নজরুলের জন্ম গ্রামে। কিন্তু তিনিও প্রধানত নগড় সংস্কৃতির পরিশীলনেই নিজের চেতনাকে রন্জিত করেছেন। অন্যদিকে, জসীম উদ্‌দীন জন্ম ও বেড়ে ওঠা গ্রামে! তবে আধুনিক শিক্ষালাভের মধ্য দিয়ে তাঁরও নাগরিক সংস্কৃতির পরিশ্রুতি ঘটেছে। তবে প্রথম তিনজনের সঙ্গে নজরুল ও জসীম উদ্‌দীনের জীবনযাত্রা একটু আলাদা। কারণ, গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার উপর ভিত্তি করে তাঁদের দুজনের সৃষ্টিকর্ম পাখা মেলেছে। এর মধ্যে আবার নাগরিক মানসের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও জসীম উদ্‌দীন প্রধানত গ্রামীন মানুষের জীবনের রুপকে কবিতা করে তুলে পরিবেশন করেছেন। যদিও তাঁর এই পরিবেশনার লক্ষ্য নগড়ের মানুষরাই। নজরুল জসীম উদ্‌দীন চেয়ে আগেই আলাদা হয়ে গিয়ে ছিলেন সৃষ্টিশীলতার বৈশিষ্ট্যে বিদ্রোহি সত্তা বা জাতীয় সত্তার জাগরণকে উপজীব্য করেছিলেন বলে। তাঁর কবিসত্তা অবশ্য জসীমউদ্দীনের মত গ্রামজীবনেই সীমিত থাকেনি। ফলে গ্রামলগ্নতার ‘অপরাধে‘ জসীম উদ্‌দীন আধুনিকদের পঙক্তিভুক্ত হতে পারলেন না।

বয়সে জসীম উদ্‌দীনের চেয়ে নজরুল মাত্রই কয়েক বছরের বড়। জীবনান্দ দাশও নজরুলেরই সমবয়সী। তিনিও জসীমউদ্দীনের চেয়ে বয়সে অল্প প্রবীণ। উভয়েই রবীন্দ্রনাথের পরের কবি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পরের কিছু কবি সচেতনভাবে নিজেদের রবীন্দ্রনাথের চেয়ে আলাদা বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের আলাদাভাবে ‘আধুনিক‘ বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করলেন। নৈরাশ্য, নির্বেদ, বিবিক্তি আর অনিকেত ভাবনাকে ধারণ করে আছে ওই ‘আধুনিকবাদ‘। জীবনাননদ দাশও ছিলেন তাঁদের দলভুক্ত। ক্রমেই এই রবীন্দ্রবিরোধীরাই বেশি প্রতাপশালী হয়ে হয়ে উঠেছিলেন বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্যিক সমাযে। নজরুল ওই দলটির চেয়ে একটু আগেই কবিসত্তায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তিনিও ছিলেন আলাদা। কিন্তু আলাদা হওয়ার বিশেষত্বে গত শতাব্দীর তিরিশের দশকি আধুনিকদের তিনি ততটা দলভুক্ত ছিলেন না, যতটা ছিলেন জীবননান্দ। জসীম উদ্‌দীন রবীন্দ্রবিরোধী বলে নিজেকে ঘোষণা দেননি। এমনকি পল্লিজীবন নিয়ে কবিতা লিখলেও তাঁকে কেউ কেউ রবীন্দ্রানুসারীও বলে থাকেন। ফলে তিনিও আধনিকের দলভুক্ত হতে পারলেন না। জসীম উদ্‌দীনের কবিতায় আধুনিকতার সন্ধান করতে হলে বাংলা কবিতার এই বিশেষ সময়ে পটভূমিকে স্মরণে রাখতে হবে আমাদের।

গত শতকের তিরিশ দশকি আধুনিকতার সঙ্গে নগরচেতনার একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অথচ জসীম উদ্‌দীন গ্রামজীবনের কবি। তাহলে তিনি আধুনিক হবেন কি করে? এই প্রশ্নটা মাথায় রেখে আমরা যদি তাঁর গোটা জীবনের কথা জানতে চেষ্টা করি তাহলে হয়তো তিনি ‘আধুনিক‘ কি ‘আধুনিক‘ নন, সেই বিতর্কের আড়াল ঘুচতে পারে। হয়তো এর ফলে তাঁর জীবন ও কবিতার সম্পন্ন সৌন্দর্যকে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করতে পারব আমরা।
বিগত শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকেই বাংলা কবিতার সঙ্গে এই ‘আধুনিকতার‘ সম্পর্ক গভীর হয়ে উঠেছে। ফলে বাংলা কবিতার প্রসঙ্গে ‘আধুনিকতা‘ শব্দটি মোটাদাগে যে বোধকে ধারণ করে, তার কথা চলে আসে। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে ওই সময় থেকেই কবিদের মধ্যে কেউ কেউ আধুনিকতার প্রতিনিধি। ফলে আধুনিক না হলে কবিতার আলোচনায় কারও নাম আসা উচিত নয়- এমনও বলতে শোনা গেছে। মানে কবিত্ব আর আধুনিকতা যে এক নয়, সে কথা কারও কারও মনে থাকেনি। যিনি আধুনিক নন, তাঁকে কবি বলে বিবেচনা করতে রাজি নন তাঁরা। কোন কোন কবি যথেষ্ট ‘আধুনিক‘ না হয়েও যে শক্তিমান কবি হতে পারেন, এ কথা অনেকেই ভুলে যান। জসীম উদ্‌দীনের কবিত্ব নিয়ে একসময় তাই এমন একটা সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশের কবিতা প্রেমিকদের একটা অংশের মনে। অথচ জসীম উদ্‌দীন বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, আমাদের গ্রামবাসিদের নিয়ে যাঁরা কবিতা লিখেছেন , তাঁরাই সত্যিকারের বাঙ্গালি কবি। আমাদের গ্রামের কৃষক, তাঁতী, কামার, কুমোর, জেলে বা মাঝিদের জীবনযাত্রা বা মনোজগৎ নিয়ে যে সব কবিতা রচনা করা হয়, সেসব কবিতাই সত্যিকারের আমাদের কবিতা। সে কবিতাই বাংলার খাঁটি সম্পদ।
পল্লিজীবনের নানা রুপ জসীম উদ্‌দীনের কবিতার সম্পদ। তাহলে কি হবে, যাকে বলে আধুনিকতা, তার অনেক কিছুই যে তাঁর নেই! তাই সেই সারিতে তাঁকে রাখতে কারও কারও আপত্তি ছিল। আর রাখলেও রাখা হয়েছিল নিছকেই ব্যতিক্রম হিসেবে। এটা কেন হয়েছে, তা যদি আমরা একটু বুঝে নিতে চেষ্টা করি, তাহলে জসীম উদ্‌দীনকে বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে। হয়তো সুবিধা হবে সামগ্রিকভাবে বাংলা কবিতার সৌন্দর্য অনুভব করতেও।

‘পল্লিকবি‘ ছাপ মারা ছিল বলে নগরজীবনবাদীরা তাঁকে আধুনিকদের দলে রাখতে না চাইলেও নগরেও তাঁর পাঠকপ্রিয়তা ছিল বিপুল। তাঁর সামসাময়িকদের মধ্যে যাঁরা কবি হিসেবে ‘আধুনিক‘, তাঁদের চেয়ে অধিক সংখ্যক নগরবাসী মানুষ তাঁর কবিতা ভালোবাসে। কারণ, জসীম উদ্‌দীন যে কবিতা লিখতেন, তা তাঁর সমকালীন বাংলাদেশের বেশিসংখ্যক মানুষের চেনা জীবনের কথা। বাংলাদেশে হাজার বছর ধরে যাদের বাস, তাদের প্রায় সবাই গ্রাম-সমাযের অধিবাসি। নদীমাতৃক বাংলাদেশে সব সময় কৃষিই ছিল প্রধান নির্ভরতা। এখন এত যে নগরের বিস্তার ঘটেছে, তাতেও সংখ্যার দিক থেকে নগরবাসীরা গ্রামবাসীদের ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। উপরন্ত যারা নগরে বাস করেন, তাদের বেশির ভাগেরেই মনে বাস করে গ্রামজীবনের স্মৃতি। ফলে জসীম উদ্‌দীনের সামগ্রিক কবি-চৈতন্য বিবেচনায় রাখলে তাঁর মনোভাবটিও বুঝতে পারা যায়। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে কাব্যবোধের জাগরণ ঘটেছে, তাতে গ্রামের অনুভূতির একটা বড় ভূমিকা রয়েছে।
জসীম উদ্‌দীনের কবিতাকে ভালোভাবে বুঝে নিতে হলে আধুনিকতা কী, তাঁকে যাঁরা আধুনিক বলে মানেন না, তাঁরা কি বলতে চান, আবার যাঁরা জসীম উদ্‌দীনকে মনে করেন সত্যিকারের আধুনিক, তাঁরা কেন সে কথা বলেন- সেসব নিয়ে আরও ভালোভাবে ভাবতে হবে আমাদের।
জসীম উদ্‌দীনকে ‘পল্লিকবি‘ বলা হলেও যাঁকে বলে লোক কবি তিনি তা নন- মোটাদাগেই তা আমরা বোঝাতে পারি। এ কথা ঠিক যে গ্রামীন কৃষিভিত্তিক জীবনযাপনের মধ্য থেকেই তাঁর কবিসত্তা জেগে উঠেছে। গ্রামীন মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গী নানা শিল্পসংরুপের মাধ্যমেই তাঁর কবিসত্তার প্রকাশ। নৈরাশ্য, নির্বেদ, বিবিক্তি আর অনিকেত ভাবনা তাঁর উপজীব্য নয় বলে তাঁকে আধুনিক কবিদের দলে ফেলা হয় না বটে, কিন্তু অন্য এক অর্থে তিনিও আধুনিকই। কী সেই আধুনিকতা?
বাংলাদেশে ক্রমেই যে নগর গড়ে উঠছে, তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এ কথাও মানতে হবে যে তাতে ইউরোপিয় নগরমানসের বাস্তবতাও নেই। যেসব কারনে ইউরুপে অনিকেত মানসিকতার সৃষ্টি, বাংলাদেশে ওই মানসিকতা সৃষ্টি হওয়ার ভিত্তি তা নয়। শিল্পবিপ্লব ও বুর্জোয়া পুঁজির বিকাশের প্রভাবে ইউরুপিয় সমাযে যে ধরনের সামাজিক রুপান্তর ঘটেছিল, তার সঙ্গে বাংলাদেশের সমায রুপান্তরের অনেক কিছুরই মিল নেই। ফলে ইউরুপীয় নগরমানসের সঙ্গেও সামগ্রিক অর্থে বাংলার নগরমানসের মিল থাকতে পারে না।
আমরা লক্ষ্য করব যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শিল্পসংরুপগুলো তাদের জীবনযাপনের প্রতিক্রিয়াজাত। ফলে বাংলাদেশের একজন কবির আধুনিকতার বোধ ইউরুপের আধুনিকতার বোধের অনুরুপ না-ও হতে পারে। ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতার কারণে জাতীয় জীবনের নিজস্ব সাংস্কৃতিকতার মধ্যেও যে ভিন্ন এক নাগরিক মানসের জন্ম হতে পারে এবং সেই নাগরিক মানসও যে ভিন্নার্থে এক আধুনিকতারই উৎস, সে কথা আমরা ভুলে গেছি বলে জসীম উদ্‌দীনের আধুনিকতাকে আমরা মূল্য দিতে শিখি নি।
তিরিশি আধুনিকতা যে অনুকারী আধুনিকতা এবং এর মধ্যে যে আত্নদীনতা রয়েছে, জসীম উদ্‌দীনের আধুনিকতার বোধে তার জন্য বেদনা রয়েছে। তিনি স্বজাতির আত্নিক উত্থানকে গুরুত্ব দিতেন বলে অনুকারী আধুনিকতাকে অপছন্দ করতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গেও তিনি তাঁর এই মনোভাব প্রকাশে দ্বিধা করেন নি। তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন:
‘... আজকাল একদল অতি আধুনিক কবিদের উদয় হয়েছে। এরা বলে সেই মান্ধাতা আমলের চাঁদ জোছনা ও মৃগ নয়নের উপমা আর চলে না। নতুন করে উপমা অলঙ্কার গড়ে নিতে হবে। গদ্যকে এরা কবিতার মত করে সাজায়। তাতে মিল আর ছন্দের আরোপ বাহুল্যমাত্র। এলিয়ট আর এজরা পাউনেডর মত করে তারা লিখতে চায। বলুন তো একজনের মত করে লিখলে তা কবিতা হবে কেন?-(রবীন্দ্রতীর্থে, ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায়, কলকাতা, বলাকা-সংস্করণ, ২০০৭)

আরেক জায়গায় জসীমউদ্দীন পরিষ্কার বলেছেন এই দৃষ্টিভঙ্গির সাহিত্যিকদের সম্পর্কে:
‘... আমাদের সাহিত্যের পিতা-মহেরা এখন মরিয়া দুর্গন্ধ ছড়াইতেছেন, তাঁহাদের সাহিত্য হইতে আমাদের সাহিত্য হবে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁহাদের ব্যবহৃত উপমা, অলংকার, প্রকাশভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে বর্জন করিয়া আমরা নতুন সাহিত্য গড়িব। এই নতুন সাহিত্য গড়িতে তাঁহারা ইউরুপ, আমেরিকার কবিদের মতাদর্শ এবং প্রকাশভঙ্গিমা অবলম্বন করিয়া একধরণের কবিতা রচনা করিতেছেন। ...প্রেম-ভালোবাসা, স্বদেশানুভূতি, সবকিছুর উপরে তাঁহারা স্যাটায়ারের বাণ নিক্ষেপ করেন। তাঁহাদের কেহ কেহ বলেন, বর্তমানের সাহিত্য তৈরি হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিতদের গ্রন্থশালায়, জনসাধারণের মধ্যে নয়।‘ - (যে দেশে মানুষ বড়, ঢাকা, ১৯৯৭ প্রথম সংস্করণ: ১৯৬৮)

নিজের সাহিত্য চর্চা সম্পর্কে তাঁর মনোভাব ছিল এই রকম:
‘... দেশের অর্ধ শিক্ষিত আর শিক্ষিত সমায আমার পাঠক-পাঠিকা। তাহাদের কাছে আমি গ্রামবাসীদের সুখ-দুঃখ ও শোষণ-পীড়নের কাহিনি বলিয়া শিক্ষিত সমাযের মধ্যে তাহাদের প্রতি সহানুভূতি জাগাইতে চেষ্টা করি।আর চাই, যারা দেশের এই অগণিত জনগণকে তাহাদের সহজ-সরল জীবনের সুযোগ লইয়া তাহাদিগকে দারিদ্রের নির্বাসনে ফেলিয়া রাখে, তাহাদের বিরুদ্ধে দেশের শিক্ষিত সমাযের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাইতে।‘- (পূর্বোক্ত)
জসীম উদ্‌দীনের রচনার এই উদ্ধৃতের মধ্যে আমরা তাঁর নিজেস্য দৃষ্টিভঙ্গির আধুনিকতার একটু আভাস পাই। স্বসমাযের জাগরণচেতনার আভাসও তাঁর এই গদ্যভাষ্যে মূর্ত হয়েছে।তিনি গ্রামীন কবিদের আঙ্গিক গ্রহণ করে নক্সীকাঁথার মাঠ (১৯২৯) কিংবা সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) রচনা করেন। কেবল এই দুই কাহিনিগাথাই নয়, ছোট ছোট গীতিকবিতাগুলোতেও তিনি পুরনো জীবনবোধের অনুকারী মাত্র থেকে যাননি। কিন্তু আমরা স্পষ্টই অনুভব করি যে এসব কবিতায় তিনি বিষয়বস্তু ও জীবনবোধে বিশ শতকের ভাবধারার অনুসারী। এই আঙ্গিক হতে পারে আমাদের নতুন আধুনিকতার মাধ্যম। আধুনিক কবিতায় যখন গীতিকা আঙ্গিকটি পরিত্যাজ্য তখন জসীম উদ্‌দীনের নক্সীকাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট- এই দুই কাব্য ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কেবল আঙ্গিকের প্রাচীনত্ব নিয়ে নয়, নতুন জীবনবোধকে ধারণের সম্ভাবনা নিয়ে। তিনি গ্রাম্য গান সংগ্রহ করতে গিয়ে পরিশীলিত নাগরিক জীবনবোধ দিয়ে লক্ষ করেছেন যে গানের প্রথম কলিটি সুন্দর, কিন্তু পরবর্তী চরণগুলোতে জনগণের কুসংস্কারকেই রুপ দেওয়া হচ্ছে। তিনি তাই প্রথম পঙক্তির সুন্দর কলিটিকে রেখে পরের চরণগুলোকে নতুন করে রচনা করে দিচ্ছেন। তাঁরও লক্ষ্য বাংলার নাগরিক মানসের কাছে পৌঁছে যাওয়া। এখানেই তাঁর আধুনিকতা ও তাঁর স্বাতন্ত্র।

জসীম উদ্‌দীনের আধুনিকতার মর্মবাণী হচ্ছে বাংলাদেশের আত্নার মধ্য থেকে জেগে ওঠো। বিশ্বের দিকে তাকাও, কিন্তু তাকিয়ে আত্নবিস্মৃত হয়ো না, বরং বিশ্বকে গ্রহণ কর নিজের আত্নাকে সমৃদ্ধ করার জন্য। তাই বলা যায়, জসীম উদ্‌দীন প্রাশ্চাত্য অনুকারী নগর গড়তে চাননি, চেয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্রামের আত্না থেকে ওঠা নতুন নগর। বিদেশে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন পাশ্চাত্য-অনুকারী আমাদের বিরাটগুলো প্রকৃতপক্ষে বিরাট নয়, অতিশয় ক্ষুদ্র। তাই আমাদের গ্রামীন ক্ষুদ্রের যে বিরাটত্ব তাকেই অবলম্বন করতে হবে। আমাদের গ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাতন্ত্রের মধ্য থেকে জাগিয়ে তুলতে হবে এর বিরাটত্বকে। এটাই তাঁর আধুনিকতার মর্মবস্ত। তাই জসীম উদ্‌দীনকে ‘পল্লিকবি‘ বলা হলে তাঁর আধুনিকতার এই স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করা হয়। পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয় তাঁর দূরদৃষ্টিকে। তাঁর আধুনিকতার অনুসারী কবিদের পেতে আমাদের একুশ শতক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কারণ, এই নবীন শতকের তরুণ কবিদের মধ্যেই হয়তো আমরা পাব আত্নবিশ্বাসী আধুনিক কবিসত্তাকে, যাঁরা নিজেদের বিকশিত করবেন, তাঁর দেখানো আধুনিকতার পথে।


সোজন বাদিয়ার ঘাট পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীন রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ। গ্রাম বাংলার অপুর্ব অনবদ্য রুপকল্প এই কাব্যগ্রন্থটি ১৯৩৪ খৃষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। সোজন বাদিয়ার ঘাট কাব্যের প্রধান চরিত্র সোজন ও দুলী। পড়তে এখানে ক্লিক করুন!


লেখক- আহমাদ মাযহার
লেখাটি টাইপ করা হয়েছে প্রথম আলোর শুক্রবারের সপ্তাহিক শিল্পসাহিত্য (১১ মার্চ ২০১৬) থেকে / কালনী নদী
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৮:৩১
৯টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×