somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক এগারো’র গ্রীড বিপর্যয়

০২ রা নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সময়কাল ১ লা নভেম্বর ২০১৪, দুপুর ১১ টা বেজে ২৭ মিনিট : দিনে-দুপুরে সারা দেশ ঢেকে গেল অন্ধকারে। আকাশে সূর্য তার নিজ অবস্হানে থেকে যথানিয়মে আলোক বিতরন করে গেলেও দেশের সম্পূর্ণ বিদ্যুৎব্যবস্হা একযোগে বিকল হয়ে পড়াটা আজকের এই বিদ্যুৎ প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত আধুনিক যুগে অন্ধকারে ঢেকে যাওয়ার সাথে তুলনা করলে খুব একটা দোষ হয়না বৈকি। আর সহনশীল পর্যায়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্হাকে তুলে আনতে যেখানে রাত গড়িয়ে যায়, তাতে জনদূর্ভোগ এবং সার্বিক নিরাপত্তাহীনতার ব্যাপারটিও উপেক্ষা করার মত নয়। কেন ঘটল এ বিপর্যয়, আর এ থেকে মুক্তি পেতে এত সময়ই বা লাগলো কেন – তার কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে কি করে সংকট মোচন করা যায় তার দিক নির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্য থেকেই এ প্রবন্ধের অবতারণা।



প্রথমেই বলে রাখা ভাল – পৃথিবীর কোন বিদ্যুৎ ব্যবস্হা-ই প্রাকৃতিক বা মানব-সৃষ্ট আকস্মিক দূর্যোগ পরিস্হিতির আওতামুক্ত নয়। একটি দেশের সামগ্রিক বিদ্যুৎ ব্যবস্হা যা জাতীয় গ্রীড নামে পরিচিত তা মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্হার সমন্বয়ে গঠিত। এ তিন অংশের কোন না কোন পর্যায়ে ছোট-খাট সমস্যা হরহামেশা লেগেই আছে এবং সেগুলো আঞ্চলিক ভাবেই স্বল্পতম সময়ে সমাধান করা হচ্ছে। আমাদের দেশে উৎপাদন পর্যায়ে কাজ করে পিডিবি, কিছু সরকার নিয়ন্ত্রিত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি (আশুগন্জ্ঞ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, ইজিসিবি, এনডব্লিউপিজিসিএল ইত্যাদি) এবং বেসরকারী ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) কোম্পানি সমূহ। পুরো দেশের সঞ্চালন ব্যবস্হার দায়িত্বে আছে পাওয়ার গ্রীড কোম্পানি (পিজিসিবি) এবং বিতরণ ব্যবস্হায় আছে পিডিবি, পল্লীবিদ্যুৎ, ডিপিডিসি, ডেসকো, ওজোপাডিকো প্রমুখ। একটি বিদ্যুৎ ব্যবস্হা সফলভাবে চলতে পারে ঠিক ততক্ষণ, যতক্ষণ না পর্যন্ত উৎপাদন এবং বিতরণ ব্যবস্হার মধ্যে একটা সমতাসূচক ভারসাম্য বজায় থাকে। এখানে মনে রাখতে হবে যে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর তা বড় আকারে সঞ্চয় করে রাখার কার্যকর কোন ব্যবস্হা নেই। তাই যতটুকু উৎপাদন, সাথে সাথেই ততটুকু বিতরণের ব্যবস্হা করা দরকার। এই যে উৎপাদন ও বিতরণের মধ্যকার ভারসাম্য, তার নিদর্শক হল সিস্টেম ফ্রিকুয়েন্সি (কম্পাঙ্ক), যা আমাদের দেশে ৫০ হার্জ (অর্থ্যাৎ সেকেন্ডে ৫০ টি পূর্ণ কম্পন)। এই সিস্টেম ফ্রিকুয়েন্সি একটু এদিক-ওদিক হলেই আংশিক বা সামগ্রিক বিদ্যুৎ ব্যবস্হা তথা গ্রীড ভেঙ্গে পড়তে পারে। আমাদের দেশে নির্ধারিত ফ্রিকুয়েন্সি’র প্রায় সর্বোচ্চ দুই শতাংশ পর্যন্ত তারতম্য (৪৮.৯ হার্জ থেকে ৫১.১ হার্জ) স্বাভাবিক পরিচালনার জন্য অনুমোদন করা হয়।

পুরো বিষয়টিকে তুলনা করা যায় দড়ি টানাটানি প্রতিযোগিতার সাথে – যার একপক্ষ হল বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সমূহ, অন্যপক্ষে আছে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী তথা বিতরণ ব্যবস্হা আর মাঝখানে দড়ির ভূমিকা পালন করছে বিদ্যুৎ সঞ্চালনকারী। এ খেলা ততক্ষণ চলবে ঠিক যতক্ষণ দুপক্ষের টানের মাঝে সমতা বা ভারসাম্য থাকে। কোন কারনে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেলে সাথে সাথে উৎপাদন বাড়াতে হয়, নতুবা ফ্রিকুয়েন্সি কমতে থাকে। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা হাতে থাকলে তা চালু করা যায়, অন্যথায় বাধ্যতামূলক লোড-শেডিং করে বাড়তি চাহিদা দমন করা হয়। অন্যদিকে কোন কারনে সিস্টেমের চাহিদা যদি হঠাৎ করে কমতে শুরু করে, তখন ফ্রিকুয়েন্সি যায় বেড়ে। সেক্ষেত্রে কিছু পাওয়ার প্লান্টের উৎপাদন কমিয়ে বা কিছু ইউনিট বন্ধ করে দিয়ে সিস্টেম ফ্রিকুয়েন্সি স্বাভাবিক সীমার মধ্যে ধরে রাখা হয়।

প্রশ্ন জাগতে পারে - ফ্রিকুয়েন্সি স্বাভাবিক সীমার বাইরে গেলে ক্ষতি কি? প্রথমত, ফ্রিকুয়েন্সি স্বাভাবিক সীমার নিচে নেমে গেলে তা অধিক চাহিদা মেটানোর জন্য পাওয়ার প্লান্টের টারবাইন ব্লেডের উপর অত্যাধিক চাপ সৃষ্টি করে যা থেকে টারবাইন ব্লেড ভেঙ্গে গিয়ে পুরো পাওয়ার প্লান্ট অকার্যকর হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেজন্য প্লান্টের নিজস্ব সয়ংক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্হাতেই লো ফ্রিকুয়েন্সি অটো শাট-ডাউন মেকানিজম কার্যকর করা থাকে। কোন কারণে একটি পাওয়ার প্লান্ট অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়ে বন্ধ হয়ে গেলে তা অন্য পাওয়ার প্লান্টসমূহের ওপর অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করে যার ফলে একে একে সবগুলো জেনারেটর বন্ধ হয়ে দেশ অন্ধকারে চলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। অন্যদিকে, ফ্রিকুয়েন্সি স্বাভাবিক সীমার চাইতে বেশি হওয়া মানে চাহিদার চাইতে যোগান বেশি। এক্ষেত্রে অনর্থক অতিরিক্ত উৎপাদনের পেছনে প্রচুর জ্বালানী অপচয়ের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ব্যবস্হার সাথে সংযুক্ত যন্ত্রপাতি সমূহের নষ্ট হবারও আশংকা থাকে, যা কারোই কাম্য নয়।

এখন তাহলে কোটি টাকার প্রশ্ন হল - ফ্রিকুয়েন্সি স্বাভাবিক সীমারেখার নিয়ন্ত্রন তথা উৎপাদন ও বিতরণের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রন করবে টা কে? বিদ্যুৎ ব্যবস্হা প্রতিমূহুর্তে পরিবর্তনশীল এবং এ পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির ভারসাম্য নিয়ন্ত্রনের দায়িত্ব হল জাতীয় লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি, পিজিসিবি)। এ প্রতিষ্ঠানের দক্ষ প্রকৌশলী ও কর্মীবাহিনী প্রতিনিয়ত দূরনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ এবং উৎপাদন ও বিতরণ কর্তৃপক্ষের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে জাতীয় গ্রীড সচল রাখেন। তারপরও বিপর্যয় ঘটার কারণ তাহলে কি? আমরা ১ লা নভেম্বর ২০১৪’র প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা অনুসন্ধানের চেষ্টা করছি।

প্রথমে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্হার একটু পরিচয় দিয়ে নেওয়া যাক। সরকার দেশের সার্বিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দশ হাজার মেগাওয়াটের অধিক দাবি করলেও কারিগরী ত্রুটি ও জ্বালানী স্বল্পতার কারণে এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড হল ৭,৪১৮ মেগাওয়াট (১৪ জুলাই, ২০১৪ : রাত ৯ টা)। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিয়োজিত আছে নব্বইয়ের অধিক সরকারী ও বেসরকারী পাওয়ার প্লান্ট যার অনেকগুলোর-ই আছে একাধিক ইউনিট। এর সাথে গত বছরের ৫ই অক্টোবর থেকে সংযুক্ত হয়েছে ভারত থেকে আসা ৫০০ মেগাওয়াট ধারণ ক্ষমতার ব্যাক-টু-ব্যাক হাই ভোল্টেজ ডিসি (এইচভিডিসি) লাইন। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে গত ১ লা নভেম্বর ২০১৪ তারিখে দুপুর এগারটায় জাতীয় গ্রীডে সর্বমোট উৎপাদন ছিল প্রায় চার হাজার পাঁচশ মেগাওয়াট এবং এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানী হচ্ছিল ৪৫০ মেগাওয়াটের মত। ১১ টা বেজে ২৭ মিনিটে ভারতের বহরমপুর থেকে আসা এবং বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা সাব-স্টশনে যুক্ত হওয়া হাই ভোল্টেজ ডিসি লাইনে বা বাংলাদেশ অংশের সাব-স্টশনে কারিগরী ত্রুটি দেখা যায় যার ফলশ্রুতিতে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রবাহ সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এখানে জেনে রাখা দরকার যে প্রবাহমান নেটওয়ার্কের প্রায় দশ শতাংশ বিদ্যুৎ প্রবাহ কোন রকম পূর্ব-প্রস্তুতি ছাড়া বন্ধ হয়ে গেলে তা সামাল দেওয়া বেশ কষ্টকর, বিশেষ করে আমাদের মত দেশে যেখানে লোড ব্যবস্হাপনা এখনো পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় করা যায়নি। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় বিদ্যুৎ বিভাগীয় কর্মকর্তাদের প্রচেষ্টা কার্যকর করার আগেই ফ্রিকুয়েন্সি স্বাভাবিক সীমার অনেক নিচে নেমে আসে এবং একে একে দেশের সবগুলো পাওয়ার প্ল্যান্ট ক্যাসক্যাডিং ইফেক্টে বন্ধ হয়ে যায়। সেসময় লক্ষ্য করে থাকলে হয়তো মনে করতে পারবেন, বিদ্যুতের সে বিদায় চিরায়ত লোডশেডিংয়ের মত আকস্মিক নয়, বরং কেমন যেন ধীরলয়ে ভোল্টেজ কমে গিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের মত অকল্পনীয় বাস্তবিক।

এবার প্রশ্ন হল – এমন পরিস্হিতির কারণ কি? ঘটনার সূত্রপাত এইচভিডিসি লাইন বা সংশ্লিষ্ট সাব-স্টেশন দু’টোর কোনটিতে তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রকৃত ত্রুটি যেখানেই থাকুক না কেন, তা অবশ্যই তদন্ত ও প্রমাণ সাপেক্ষ। বিদ্যুৎ ব্যবস্হায় এ ধরনের ঘটনা সচরাচর না ঘটলেও অসম্ভব কিছু নয়। তাই বলে বিকল্প ব্যবস্হা কিংবা সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা পরিস্হিতির ব্যর্থতার কারণ অবশ্যই অনুসন্ধানের দাবী রাখে। বাংলাদেশী পক্ষের ভাষ্যমতে সেদিনই আরো একাধিকবার এইচভিডিসি লাইনে কারিগরী ত্রুটি ধরা পড়েছিল কিন্তু ব্যবস্হা নেবার আগেই তা ট্রিপ করে। অন্যদিকে ভারতীয় অংশের দাবী – তাদের সাব-স্টেশন কার্যকর ছিল এবং একটি লাইন ট্রিপ করায় বিকল্প লাইনে তারা বিদ্যুত সঞ্চালনের চেষ্টা করেছে; কিন্তু বাংলাদেশ অংশে তা আর কার্যকরীভাবে গ্রীডে সংযুক্ত করা যায়নি। ফলে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান যে বিকল্প লাইন বা সাব-স্টেশন যন্ত্রাংশে এমন কোন ত্রুটি বিদ্যমান যা সকল নিরাপত্তা ব্যবস্হাকেই ব্যার্থ প্রমাণ করেছে।

ঠিক আছে - ব্যাক-টু-ব্যাক এইচভিডিসি লাইন ট্রিপ করেছে, তাতে সারা দেশ একবারে অন্ধকারে চলে যাবে কেন? এখানে উৎপাদন ও বিতরণের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণকারী এনএলডিসি’র অবদান সামান্যই। কারণ তাৎক্ষণিক উৎপাদন হ্রাসের সাথে তাল মিলিয়ে লোড শেডিংয়ের মাধ্যমে কৃত্তিমভাবে চাহিদা কমানোর আগেই ফ্রিকুয়েন্সি চলে যায় নিয়ন্ত্রনের বাইরে। এনএলডিসি স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুব সামান্যই লোড বিচ্ছিন্ন করতে পারে, তাদের ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয় টেলিযোগাযোগের ওপর যার মাধ্যমে বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে লোড কমানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। একে তো প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ, অন্যদিকে বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহও অনেকসময় নির্দেশ পালনে গড়িমসী কিংবা অহেতুক সময়ক্ষেপন করে। এক্ষেত্রে পরিস্হিতির প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবনকারী এনএলডিসি’র অধিক সয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রদানের কোন বিকল্প নেই। বিগত ২০০৭ সনের নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে ঘূর্ণিঝড় সিডর পরবর্তী গ্রীড বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটি এ বিষয়ে অনুরুপ সুপারিশ করলেও তা যথেষ্ট কার্যকর হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না।

দেশতো অন্ধকারে গেল, এরপর নতুন করে গ্রীডকে সচল করতে এত সময় কেন লাগলো – এ প্রশ্নও আজ সকলের মুখে-মুখে। এ প্রসঙ্গে আমরা যদি সাম্প্রতিক কালে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ঘটে যাওয়া গ্রীড বিপর্যয়সমূহ পর্যালোচনা করি – তবে দেখতে পাবো যে সম্পূর্ণ গ্রীড বিপর্যয় হলে তা থেকে উত্তরনে ছয় ঘন্টা থেকে দুই দিন পর্যন্ত সময় লাগা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ২০০৩ এর আগস্টে আমেরিকায়, ২০০৯ এর নভেম্বরে ব্রাজিল কিংবা ২০১২ এর ৩০-৩১শে জুলাই ভারতের ২২ টি প্রদেশে সংঘটিত গ্রীড বিপর্যয়সমূহ এর জ্বাজ্বল্য নিদর্শন। এর পেছনে কারিগরী দিকটাও তাই ভেবে দেখা দরকার। প্রথমত একবার গ্রীড বিপর্যয় হলে সারাদেশ মুহূর্তেই অন্ধকারে চলে যায়। কিন্তু সে অবস্হায় চাইলেই সব মেশিন একযোগে চালু করে গ্রীড সচল করা সম্ভব নয়। এর পেছনে কারণ হচ্ছে যেকোন পাওয়ার প্লান্ট চালু হতে এবং সচল অবস্হায় তার নিজস্ব যন্ত্রাংশের প্রয়োজনে বিদ্যুৎ গ্রহন করে যা অক্সিলিয়ারি পাওয়ার নামে অভিহিত। সাধারন ক্ষেত্রে গ্রীডে নতুন পাওয়ার প্লান্ট চালু হলে তা প্রাথমিক অবস্হায় গ্রীড থেকে এবং পরবর্তীতে নিজস্ব উৎপাদন থেকেই অক্সিলিয়ারি গ্রহন করে যা প্লান্টের মোট উৎপাদনের দশ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু যখন গ্রীড বিপর্যয়ের কারণে সব প্লান্টই বন্ধ, তখন অক্সিলিয়ারি পাওয়ারের অভাবেই ঘটে বিপত্তি। অনেক প্লান্টেই আপদকালীন কাজ চালানোর জন্য ডিজেল জেনারেটর বা ব্যাটারী ব্যাংক থাকলেও তা অক্সিলিয়ারি পাওয়ার দেবার সামর্থ রাখে না। এ ধরনের পরিস্হিতি মোকাবেলায় কিছু বিশেষ প্লান্ট নির্ধারন করে রাখা হয় যেগুলো বাইরের অক্সিলিয়ারি পাওয়ারের সাহায্য ছাড়াই দ্রুত চালু হতে পারে। এসব প্লান্টকে ব্ল্যাক স্টার্ট নাম দেওয়া হয়, কারণ গ্রীড ব্ল্যাক-আউট হলে এসকল প্লান্টই প্রথম চালু করে ধীরে অন্য প্লান্টগুলোকে অক্সিলিয়ারি পাওয়ার সরবরাহের মাধ্যমে গ্রীড সচল করা হয়।

আমাদের বিদ্যুৎ ব্যাবস্হায় খুব অল্প কিছু প্লান্টই ব্ল্যাক স্টার্ট হিসেবে চালু হতে পারে। এর মধ্যে প্রধান হল কাপ্তাইয়ের ২৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট। এছাড়া ময়মনসিংহের আরপিসিএল এবং সিলেটের একটি গ্যাস পাওয়ার প্লান্টও ব্ল্যাক স্টার্ট হিসেবে চালুর ক্ষমতা সম্পন্ন। বিগত ২০০৯ এর সিডর অভিজ্ঞতার পর গ্রীড বিপর্যয় থেকে স্বল্পসময়ে উত্তরণ পেতে ব্ল্যাক স্টার্টের মাধ্যমে ধারাবাহিক ভাবে অন্যান্য প্লান্ট চালুর একটি ধারা সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এবার তা কার্যকর-ভাবে প্রথম প্রচেষ্টায় প্রয়োগ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যার ফলশ্রুতিতে ১লা নভেম্বর দুপুর ২:৩০ এর দিকে ক্ষুদ্র পরিসরে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা গেলেও তা বিকাল ৪টা’র দিকে আবার ভেঙ্গে পড়ে গ্রীড বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটে। এর পেছনেও বেশ কিছু কারিগরী কারণ বিদ্যমান। প্রথমত ধীর লয়ে এক এক করে পাওয়ার প্লান্টসমূহকে চালু করা হলেও এর প্রতিটি পর্যায়ে উৎপাদন ও চাহিদার ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার, নতুবা আগের মত বিপর্যয় খুবই স্বাভাবিক। অন্যদিকে ব্ল্যাক স্টার্টের মাধ্যমে অল্প কিছু প্লান্ট চালু হলেও বড় বড় বাষ্পচালিত প্লান্ট-সমূ্হ অক্সিলিয়ারি সরবরাহের পরও পুরোপুরি চালু হতে বেশ সময় (ছয় থেকে আট ঘন্টা) নেয়। অন্যদিকে দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকার পর গ্রীডের যে অংশে পুনরায় সংযোগ দেয়া হল, তাদের চাহিদাও স্বাভাবিক সময়ের চাইতে অনেক দ্রুত বেড়ে যায় – ফলে উৎপাদন-চাহিদার তাল মেলানো বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। তারপরও আমাদের প্রকৌশলী ও কর্মীবাহিনী নিরলস পরিশ্রম করে দশ-বারো ঘন্টার মধ্যেই যে পরিস্হিতি সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসতে পেরেছেন, সে জন্য তারা অবশ্যি প্রশংসার দাবীদার।

বিদ্যুৎ ব্যবস্হায় দূর্ঘটনা ঘটতেই পারে, কিন্তু তার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্হা সচল রাখা এবং বিপর্যয় মোচনে স্বল্পতম সময়ে প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনীর মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্হাপনার কার্যকর পরিকল্পনা রাখা দরকার। ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর সাম্প্রতিক এইচভিডিসি লাইনের কারণে গ্রীড বিপর্যয় আমাদের সামগ্রিক বিদ্যুৎ ব্যবস্হার জন্য এক আশনি-সংকেত। এদেশে একক ভাবে কোন বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট আড়াইশ মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন নয়। সেহিসেবে বলা যায় ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুৎ-ই এদেশের একক সর্বোচ্চ ক্ষমতার কেন্দ্র যার সামান্য কারিগরী ত্রুটি আমরা যথাসময়ে সামাল দিতে পারিনি। দেশ এখন পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ২০২১ সালের মধ্যে ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি এবং ২০২৩ সালের মধ্যে সমক্ষমতার আরেকটি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হবার কথা। পাশাপাশি আগামী ৪-৫ বছরের মধ্যে ৫০০-৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একাধিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও জাতীয় গ্রীডে সংযোগের লক্ষ্যে কাজ চলছে। দিনের বেলায় যখন বিপুল অলস বিদ্যুৎ উৎপাদন হাতে আছে তখনই আমরা ৫০০ মেগাওয়াটের অভাব সামাল দিতে পারিনি। সেক্ষেত্রে ৫০০ বা ১০০০ মেগাওয়াটের বৃহদাকার কয়লা ও পরমাণু বিদ্যুৎ ইউনিট নিয়ে আমরা যে কি বিপদে পড়তে যাচ্ছি তা হয়তো উপরওয়ালা-ই জানেন। তাই বলে উপরওয়ালার ওপর দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলেও চলবে না। নতুন প্রযুক্তিকে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলেও উন্নতি সাধিত হবে না। বিদ্যুৎ ব্যবস্হার সার্বিক উন্নয়নের জন্য স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্হা চালুর পাশাপাশি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরির মাধ্যমেই আমরা এ ধরনের জাতীয় দুর্যোগে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবো বলে আশা রাখি।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৯
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×