অল্পস্বল্প ব্লগিং-১
তার হেয়ালী ধরতে পারি না বলে, দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে।
টাকাটা হাতে নিতে নিতে সে আবার বলল, এমন জায়গায় কি প্রথম আসলেন?
-হুম!
-সবাই তো আমাদের তুই-তুমি করে বলে।
-হঠাৎ করে কাউকে তুই বা তুমি বলতে পারি না।
-কী খেতে চান?
-মাছ-ভাত-ডাল-ভর্তা-ভাজি! রান্না ভালো হলেই হলো।
-পানি গিলবেন, নাকি এইটাও চিনেন না?
-এটা জানা আছে।
-তাহলে মাছ না। বমি হয়ে সব বের হয়ে যাবে। গরুর মাংসের কথা বলি।
-আচ্ছা।
মেয়েটি দরজা খুলে মাথাটা বের করে এদিক ওদিক দৃষ্টি ফিরিয়েই হয়তো ডেকে ওঠে- বিন্দু মাসী কুয়ানে গেলি?
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে কোনো প্রৌঢ়ার কণ্ঠ ধ্বনিত হয়-কি বলবি ক!
-গরুর চাপার গোস্ত দুইটা ডাবল। ভাত একটা ডাবল। মাঝারি কড়া একটা। বাকি পঞ্চাশ টাকা তোর।
এবারও তার কথাবার্তা পুরোপুরি বুঝি না। গরুর চাপার মাংস, মাঝারি কড়া, তা ছাড়া তিনশ টাকার জায়গায় পুরো টাকাটাই ছেড়ে দিল কেন?
দরজার একটি কপাট ধরে ফিরে বলল, গোসল করতে চাইলে নদীতে চলেন। আমার গোসল দরকার। সারাদিনের বস্তা সামলাতে সামলাতে শরীর গন্ধ হইয়ে গেছে।
বস্তা ব্যাপারটা যেন এতক্ষণে আমার বুঝে এলো কিছুটা। খদ্দের তাহলে তাদের কাছে বস্তা? হাসি পেলেও তা চেপে রাখি। বলা যায় না। নানা অপরাধের স্বর্গ এসব এলাকা। কী থেকে কী হয়ে যায় বলা কঠিন। তবে এ পর্যন্ত এ সমস্ত পল্লী নিয়ে যত কাহিনী আর গাল-গল্প পড়েছি এমন ঘটনার কথা কোথাও পাইনি। ব্যাপারটা যেন আমার মনের চিলেকোঠায় আটকে থাকা গুমোট ভাবটাকে বেরিয়ে যেতে একটি পথ করে দিল। যদিও ট্রলার থেকে নেমে এ পল্লীর ভেতরের দিকে হেঁটে আসতে নানা অশুভ ভাবনায় ভেতরে ভেতরে চুপসে যাচ্ছিলাম। সেই সঙ্গে কেমন খাপছাড়া আর অচেনা একটি অস্বস্তিকর গন্ধের মুখোমুখি হলে ভেতরের দিকে আসবার আগ্রহটা হ্রাস পাচ্ছিল ক্রমশ। কোনো কোনো খুপরি ঘরের সামনে দিয়ে আসবার সময় শুনতে পাচ্ছিলাম নূপুর আর অর্গানের শব্দ। তার কয়েকটা ঘর পরেই শুনতে পাচ্ছিলাম মিহি স্বরে কাঁদছে কোনো এক যুবতী বা রমণী। সব মিলিয়ে বিগত সময়ে জমে ওঠা যাবতীয় দৈহিক কাতরতা আর কামনা বাসনা ঝিমিয়ে পড়েছিল প্রায়। মেয়েটির মুখে গোসল আর নদী শব্দ দুটো শুনতে পেয়ে আমার স্নায়ুগুলো যেন জেগে উঠলো মুহূর্তে।
সারাদিনের রাস্তার ধকল, ক্ষুধা আর গরমের তাণ্ডবে এমনিতেই বেশ বিপর্যস্ত ছিলাম। তার সঙ্গে অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে আমারও গোসল করবার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠেছে বুঝতে পারিনি। বিশেষ করে পানিতে ঝাঁপাঝাপি করে গোসল করা হয় না বহুকাল। বানিশান্তার নিষিদ্ধ এক খুপরি ঘরের অচেনা মেয়েটির কারণেই কিনা আমারও সাধ জাগে কৈশোরের মতো পানিতে ডুব দিয়ে মুঠো ভর্তি কাদা তুলে ছুঁড়ে মারি আরো গভীর পানিতে।
মেয়েটির সঙ্গে যে পথে নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সে অংশটির অন্ধকারকে তেমন বেশি দুর্বল করতে পারেনি বেশ খানিকটা দূরে পাশাপাশি গায়ে গায়ে লাগানো বিভিন্ন আকৃতির ট্রলারে ঝুলিয়ে রাখা ছোটবড় বাতিগুলোর সম্মিলিত আলো। মেয়েটি তার হাতের কাপড়, সাবান, গামছা মাটিতে বা ঘাসের ওপর ফেলে রেখেই গায়ের কাপড় খুলতে খুলতে নেমে যায় পানিতে। আমি তার অস্পষ্ট দেহকাণ্ডের শাখা-প্রশাখা দেখি অথবা আমার বুভুক্ষু মন নিজের মতো করে এঁকে নেয় দৃষ্টির কালচে ক্যানভাসে। সেই সঙ্গে অদ্ভুত একটি নেশা যেন তাড়িত করে আমাকে। পানির কাছাকাছি আমি থমকে দাঁড়ালে মেয়েটি গলা অবধি পানিতে দাঁড়িয়ে বলল, সব খুলে নেমে পড়েন। আশপাশে কেউ নেই।
মেয়েটির আহ্বানে আমার ভেতরগত স্নায়ুতন্ত্রও যেন কেঁপে উঠল শিরশির করে। জীবনে কত কিছুই না বাকি থেকে গেছে সুশীলতার প্রাণপণ চেষ্টায়, মান-মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখবার ভণ্ডামিতে। সেই তো প্রাপ্তি বলতে শূন্যতা আর প্রতারণাই। তাহলে কেন আর শুধু শুধু নানা প্রতিশ্রুতির ভারবাহী হয়ে জীবন কাটানো? সজ্ঞানে যতক্ষণ মেয়েটির কাছাকাছি থাকি সে সময়টা হয়তো আমাকে ঠকাবে না সে। সুশীলতার আড়ালে সূক্ষ্ম স্বার্থপরতার সূচিকর্মে পটু হবার সুযোগ পাবার আগেই হয়তো নিষিদ্ধ এ পল্লীটির অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল সে। তারপর তার জীবনে কেবল পুরুষ, দিনরাত, ক্ষুধা-রেচনই হয়তো মুখ্য হয়ে আছে। আর সে কথা মনে হতেই পোশাক আশাক খুলে ফেলে সদ্যজাতের চাঞ্চল্যে ঝাঁপিয়ে পড়ি পশুর নদীর কালো জলে।
(আজ এ পর্যন্তই)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০১৪ দুপুর ১২:০৬