somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-১

৩০ শে মে, ২০১৪ রাত ৮:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



( ব্লগার প্রফেসর শঙ্কুর গল্প-ভাবনা #৪)

সকাল সকাল ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলে মন-মেজাজ বেজায় খারাপ থাকে মতিনের। সন্ধ্যার পর পরই খাওয়া-দাওয়া সেরে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে ঘরের মাচা থেকে বালিশটা নামিয়ে কোনো রকমে শরীরটা ফেলতে পারলেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে দেরি হয় না। কিন্তু প্রতিদিন ভোরবেলায় একই ঘটনা। মনে মনে ভাবে যে, কোনো একটা দিন কি এর অনিয়ম ঘটতে পারে না? অথচ ঘুম জড়ানো চোখে মায়ের হাত থেকে দুধে ভরা মাটির তৈরি পাত্রটা নিয়ে তাকে ছুটতে হয় আড়ং-এর দিকে। তার তো আরেকটি ভাই আছে আজগর। কদিন আগে বিয়ে করেছে বলে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে তারও খবরদারিটা বেড়েছে আগের মতো। নতুন বউয়ের সামনে ক্ষমতা দেখাতে যেন মজা পায়। আর মিচকি শয়তানের মতন বউটাও ঘোমটার আড়াল থেকে হাসতে থাকে মিটিমিটি। সে সময় আরো বেশি রাগ হয় মতিনের। কিন্তু দুধ বেচতে আড়ঙে ছুটতে হয় বলে তার অতটা সময় বা সুযোগ থাকে না পালটা কিছু করবার।

তাদের সিদ্ধেশ্বরী গ্রামটার পরই কুটিলা গ্রামের খালপাড়ে বসে আড়ং। খালে তখন অনেক নৌকা এসে ভিড় করে। আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজন নানা শাক-সবজি, মাছ, মুরগি এমন কি কেউ কেউ পোষা কবুতরও বিক্রি করতে নিয়ে আসে। সপ্তাহে দুদিন শনি-মঙ্গলবারে হাট বসে বেলা ডোবার আগ পর্যন্ত। কিন্তু আড়ং চলে অল্প কিছুক্ষণ। পুবাকাশে সুরুজটা খুব বেশি হলে হাত খানেক ওপরে উঠতে পারে। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লোকজন যার যার কাজ সেরে ফিরে যেতে থাকে।

দুধ বেচা-বিক্রিটা শুরু হয় সবার আগে। লোকজন আগেই দুধটা কিনে ফেলে। নয়তো কোনোদিন ঘোষ বাড়ির মধু ঘোষ নয়তো শিবু ঘোষ পেতলের কলসি নিয়ে আসে দুধ কিনতে। কিন্তু তাদের কাছে দুধ বেচে শান্তি নেই। অন্যরা যখন দুধ কেনে চার পয়সা করে ঘোষেরা তখন দর হাঁকে পাঁচ পয়সা ছ পয়সা করে। কিন্তু ঘোষেরা তো আর প্রতিদিন আসে না। তাই তার মুখ চেনা মানুষগুলোর কাছেই দুধ বেচে যায়। এইসব বেচা-কিনি করতে নিজেকে কেমন ছোট ছোট মনে হয়। বেচা-বিক্রি করে খাবে অভাবী মানুষেরা। বছরের খোরাকি যাদের জমির ফসলে কুলায় না। আর ব্যাপারটা ভেবে একদিন আড়ং থেকে ফিরে চিঁড়া আর গুড় নারকেল মাখাতে মাখাতে বলেছিল, মা, আমরার দুধ বেচনের কোন কাম? ক্ষেতের চাউল, পইরের মাছ, বাড়ি-ঘরের তরি-তরকারি, কোনডার অভাব কওচাইন?

মা শরবতের নেসা হেসে বলেছিলেন, পুতরে! অভাব নাই হাচা কতা, তরা তিনজনে কয়সের দুধ খাস কচাইন?

-দুধ না খাইলেই কি, ঘি বানাও।

-কয় ঝিনাই ঘি খাস তরা জানা আছেরে পুত! এত কতা কইচ্চা, যা কই হুনিস!

মায়ের অল্প কথাতেই বুঝে গিয়েছিল মতিন। আসলে বেশি থাকলেই বেশি বেশি খরচ করা যায়। কিন্তু কাজের খরচ আর কটি হয়। তাই দুধ বেচতেই হয় বাড়তিটা। এমনই বাড়তি ধান-পাট-মুগ মসুর- মাস কলাই, মিষ্টি আলু সবই বছর শেষে থেকে যায় বলে বেচে দিতে হয়। গাছের নারকেলগুলো যখন ঝুনা হয় তখন খবর দিতে হয় কুটিলার মজিদ গাছিকে। সে নিজেই গাছে উঠে নারকেল পাড়ে। মায়ের সঙ্গে দরদাম করে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে যায়। সব টাকা মায়ের হাতে যেন কিছুদিন পর পর ফুলে ফেঁপে ওঠে। এই তো খুব বেশিদিন হয়নি যে, হিন্দু পাড়ার যতিন মণ্ডলের দেড়-কানি জমি কিনে ফেললেন দু ছেলের নামে। বাবা থাকতে তো মায়ের হাতে টাকা উঠতো না। তখন অভাব না থাকলেও বাবার নেশা ছিল গান-বাজনা, যাত্রার দিকে। মায়ের কোনো আপত্তি ছিল না হয়তো। মাঝে মাঝে বলতে শুনেছে মা বলছেন বাবাকে, কত দেশ-বৈদেশ ঘুরেন, কাপড়-চোপড় ভালা চাইয়া লইলে কী অয়?

বাবাও হয়তো খুশি হতেন। বলতেন তুই কি চাস আমারে রাজা রমেশ সাজাইয়া রাখবি?

এলাকায় রাজা রমেশের নামডাক ছিল কোম্পানির লোক বলে। পূর্ব পুরুষ থেকেই তারা ব্রিটিশ সরকার থেকে রাজা খেতাব পেয়ে এসেছে। সেই রমেশ পোশাক আশাকের দিক দিয়ে সবার কাছেই দর্শনীয় ছিলেন। তাকে সব সময়ই ধোপদুরস্ত দেখা যায়। চলেন পালকী দিয়ে। মতিন তাকে দূর থেকেই দেখেছে। কাছাকাছি হবার সাহস ছিল না। তাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে ঘাটুর গান হতো। কলিকাতা থেকে নৌকায় চড়ে আসা সুন্দর সুন্দর মেয়েরা ছেলেদের মতো মোটা গলায় গান গাইতো। কেউ বা নাচতো। রাতভর চলতো তাদের সেই উৎসব। কিন্তু সে সময়টাতে চুরি-চামারি বেড়ে যেতো। গেরস্থদের অনেকেই সে সময়টাতে রাত জেগে বাড়ি-ঘর আর আর গোয়ালঘর পাহারা দিতো।

বাবা মায়ের কথাবার্তা শুনবার তেমন আগ্রহ থাকতো না মতিনের। তার মন পড়ে থাকতো বাইরে। আবার বেশির ভাগ সময়টাই কেটে যেতো কুটিলার প্যাট্রিক সায়েবের স্কুলেই। ছাত্র হিসেবে ভালো ছিল বলে তাকে ফাদার প্যাট্রিক জনসন খুব পছন্দ করতেন। তবে, সেখানে যাওয়াটা পছন্দ করতেন না জুম্মা মসজিদের খবির মাওলানা। তিনি চাইতেন মতিন তার কাছে কারিয়ানা শিখবে। ভালো আলেম হবে। আরো বড় পাশ দিতে তাকে উজানি মাদ্রাসায় পাঠাবেন। কিন্তু খবির মাওলানার চাইতে তার বেশি পছন্দের ছিলেন প্যাট্রিক সায়েব। সে মুসলমান বলে তাকে কখনো ফাদার বলেনি। ফাদার বলবে সায়েব-মেমরা। মুসলমানরা সায়েবদের হুজুরকে ফাদার বললে ইমানের জোর কমে যায়। আস্তে আস্তে মুসলমান থেকে তার নাম খারিজ হয়ে যায়। আল্লাহকে খুব ভয় পায় মতিন। দোযখে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তার। কিন্তু পড়াশুনা না করলে জীবনের কোনো উন্নতি নাই। এ কথাটা সে নিজে নিজেই বুঝতে শিখেছে।

খুব তো বেশিদিনের কথা নয় যে, রায় বাড়ির বিশু প্যাট্রিক সায়েবের কাছে বছর পাঁচেক পড়েই কোনো এক সায়েব কোম্পানিতে কাজ পেয়ে বিলাত চলে গেছে। সেখানে গিয়ে মেম বিয়ে করেছে। মতিনেরও এমন একটি ইচ্ছে আছে। এই গাঁও গ্যারামের অন্ধকার, কাদা-ধুলা মাখা জীবন তার পছন্দ নয়। কথাটা সে মাকে জানাতে ভয় পায়, যদি তিনি কান্নাকাটি করেন, তাকে যদি বাড়ি থেকে কোথাও যেতে না দেন। তার বাবাও নাকি কলিকাতায় সায়েবদের সঙ্গে মাখামাখি করতে গিয়েই হারিয়ে গেছেন। মায়ের ভাষায়, মেমের পাল্লায় পইড়া তর বাপে শ্যাষ অইছে।

মেমগুলো তো অনেক সুন্দর। একেকজনের রঙ যেন পাকা টসটসে ডুমুর। তাদের বাচ্চাগুলোও তেমন। প্যাট্রিক সায়েবের মেয়েরাও মেম। তাদের কথা কিছুই বোঝে না সে। অনেক আগে একবার তাদের দেখেছিল। বর্ষাকালে নৌকায় চড়ে এসেছিল তারা। মতিনের হাতে স্লেট-খড়িমাটি দেখে একজন বলেছিল, হাউরুরু?

সেদিন ভীষণ ভয় পেয়েছিল সে। মেমেরা নাকি ছোট ছোট কালো বাচ্চাদের পুড়িয়ে খায়। তারপর অনেকদিন আর পড়তে যায় নি সে প্যাট্রিক সায়েবের কাছে। নিজের গায়ের রঙ নিয়ে সব সময়ই লজ্জিত থেকেছে সে।

সিদ্ধেশ্বরী গ্রামের প্রায় শেষ সীমানায় কুলু বাড়ির আস্তাকের সঙ্গে দেখা হয় তার। কাঁধে একটি কোদাল আর কোদালের হাতলের সঙ্গে ঝুলানো মাটি বওয়ার বেতের কাড়া লাগানো খারি নিয়ে খানিকটা দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিল। সে হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে ডেকে বলল, আস্তাইক্যা এমন বেইন্যালা কই পথ দিসস?

আস্তাক মতিনের ডাক শুনেই হয়তো পেছন ফিরে তাকিয়ে থামল। বলল, তুই জানস না?

মতিন আস্তাকের কাছাকাছি হতেই সে জানালো, আমি ত রেল রাস্তায় কাম লইছি।

কথাটা বুঝতে না পেরে মতিন ফের জানতে চেয়েছিল রেল রাস্তা কেরুম?

আস্তাকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, অনেক মাডি দিয়া ওচা করছে। লোয়া দিয়া মোডা মোডা তক্তার রাস্তা। হেই রাস্তা দিয়া চলবো লোয়ার বানাইন্যা রেলগাড়ি। যার চাক্কাও লোয়ার। কয়লা পুড়তে পুড়তে হেই গাড়ি চলে। কুউউউ কইরা ডাক দেয়। ধোমা ছাড়ে ভুসভুস কইরা। রাস্তার কাম শ্যাষ অইলেই লোয়ার গাড়ি ঝমঝমাইয়া আইবো হুনসি।

মতিনের কেমন যেন ধন্দ লেগে যায়। লোহার রাস্তা দিয়ে চলবে লোহার গাড়ি। কয়লা পুড়বে। ধোঁয়া ছাড়বে ভুসভুস। ব্যাপারটা যেন, বদিউজ্জামাল পরী কিংবা চিত্রসেন বাদশা অথবা মলুয়া সুন্দরী কি লক্ষ্মীন্দরের কেচ্ছার চেয়েও মনোমুগ্ধকর। তার একবার ইচ্ছে হয় আস্তাকের সঙ্গে সঙ্গেই চলে যেতে রেল রাস্তার দিকে। কিন্তু হাতে দুধের কাইরা আর দুধ নিয়ে যাবে কীভাবে। ব্যাপারটা নিয়ে অন্য কোনো সময় ভাবা যাবে। আইচ্ছা তুই যা। আমি আড়ং মুহি যাইতাছি!

দুজনে ফের দুদিকে যাত্রা করলেও যেন আস্তাকের বর্ণনা পুরোপুরিই তার ভাবনায় শেকড়-বাকর মেলে স্থায়ী হয়ে যায় তখনই।

(ব্লগার প্রফেসর শঙ্কুর ভাবনা দিয়ে যাত্রা শুরু হলো এই কাহিনীর। কিন্তু আমি জানি না এর কী পরিণতি। তবে আন্তরিক চেষ্টা থাকবে এটিকে কোনো একটি সার্থক পরিণতির দিকে পরিচালনার। ধন্যবাদ প্রফেসর শঙ্কু।)





সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৪ বিকাল ৪:৪২
১৪টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×