somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-২

৩১ শে মে, ২০১৪ রাত ১১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ব্লগার প্রফেসর শঙ্কুর গল্প-ভাবনা#৪
কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-১

প্যাট্রিক জনসন খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন মতিনের কথাগুলো। শুনতে শুনতে হঠাৎ তার চোখে মুখে কেমন এক ধরনের কৌতুকের আমেজ ফুটে উঠল। মুচকি হেসে আবার বললেন, কি কহিলে, লোয়ার গাড়ি! হোয়াট ইজ দ্যাট? হামি বুজে না কুসু!

-লোয়ার গাড়ি! উফ, বুজ না কিয়ারে সাব?

খানিকটা হতাশ আর বিরক্ত হয়ে ওঠে যেন মতিন। তারপর প্যাট্রিক সাহেবের পিঠের কাছে জানালার পাশে ঝুলিয়ে রাখা তরবারিটা দেখিয়ে বলল, এইডা মেইড লোয়া! বুজলানি?

এবার সাহেবের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। নাউ আই আণ্ডারস্ট্যান্ড! তুমি বলিটেসে লোহার গাড়ি?

-হ সাব! লোয়ার রেলগাড়ি!

-হুম, আই সি! লোহা মিনস আয়রন।

প্যাট্রিক জনসনের চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে। তারপর আবার বললেন, টুমি রেলগাড়ি ডেকিয়াসে?

মাথা নেড়ে না করে মতিন।

-ওকে, তুমি বৈকালে আসিও। পারিবে?

-পাইরাম।

অতি উৎসাহে মাথা ঝাকায় সে।

-অল রাইট! টোমার মাদারকে মাস্ট জানাইয়া আসিবে। হামি টোমাকে রেলগাড়ির ফোটো ডেখাইবে।

-আইচ্ছা।

তারপর থেকেই তার মন পড়ে আছে ফাদার প্যাট্রিক জনসনের কাছে। মাথায় ঘুরছে ভুসভুস করে ধোমা ছাড়ছে রেলগাড়ি। কিন্তু তার কল্পনায় আসে না দেখতে কেমন এই রেলগাড়ি। চাকা তো গরু আর ঘোড়ার গাড়ি নয়তো সাইকেলের দেখেছে। কিন্তু অত ভারী গাড়িতে কতগুলো চাকা হলে চলবে? এমনই নানা উদ্ভট ভাবনায় তার সময় পেরিয়ে যায়। বাড়ি ফেরার পর সে ভুলে যায় গাই দুটোকে খৈল-ভূষি খাওয়ানোর কথা। এমন কি মাঠ থেকে ঘাস তুলে আনবার কথাটাও তার মনে রইলো না।

আজগর দুপুরের দিকে পাট খেতে নিড়ানি দিয়ে বাড়ি ফিরে দেখলো গাই দুটোর সামনে ঘাস তো দূরের কথা, ঘাসের ঝাঁকা যেটাকে তারা জুহুন বলে জানে সেটাও নেই। সে বেশ কিছুটা অবাক হয়ে ভাবলো যে, আজ কি মতিন বাড়ি ফেরেনি? ভাবতে ভাবতে সে হাতের নিড়ানিটা ঘরের বেড়ার ফাঁকে গুঁজে দিয়ে ডাকল, মমতাজ, হুনছস?

মমতাজের কোনো সাড়া না পেয়ে সে আবার ডাকলো, মায় আছনি?
কিন্তু সাড়া নেই কারো। অথচ ঘরের দুটো দরজাই খোলা। সে কাঁধের গামছা দিয়ে বুক পিঠের ঘাম মুছতে মুছতে ঘরের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলতে লাগলো, গেল কই মানুডি!

ঠিক তখনই ঘরের পেছনের দরজার কাছে পানি ঢালবার শব্দ শোনা যায়। আজগর খানিকটা অপেক্ষা করতেই শুনতে পেল, মানুডি আছে। বড় মাইনষ্যের পুতে অ-বেইলে মানু বিছরায় কোন কামে?

বলতে বলতে মমতাজ ঘোমটা টানতে টানতে ঘরের ঝাঁপের আড়াল থেকে মুখ বাড়ায়। মুখটা তার কেমন দুষ্টু দুষ্টু হাসিতে ভরে আছে। সেই সঙ্গে কৌতুক চকচক করছে দুচোখের তারায়।

আজগরের দৃষ্টি হঠাৎ চলে যায় মমতাজের পায়ের দিকে। ভেজা পায়ের চিহ্ন লেগে আছে মাটির মেঝেতে। ফের স্ত্রীর মুখের দিকে দৃষ্টি তুলে বলল, গাই দুইডার পেটটি পইড়া রইছে। মতিন্যায় কি আধার পানি দিছে না আউজগা?

-মতিন বাইরে দেখছিলাম একবার। নাইন্দের ভিত্রে ততা হ্যান-পানি দিয়াই আমি বাইরে গেলাম।

মমতাজের নাকে দুলতে থাকা নোলকেরর সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটের ওঠা নামা আজীবন-কালের পরিচিত দৃশ্যের কথাই যেন মনে করিয়ে দেয় তাকে। ছোট বেলায় মা দাদি নানি চাচি খালা সবার নাকেই এই বস্তুটি দেখে দেখে তার মুগ্ধতায় কোনো হেরফের হয়নি আজ অবধি। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছোট ভাইয়ের ওপর ফেনিয়ে ওঠা রাগটা যেন কখন হারিয়ে যায় বুঝতে পারে না। হয়তো বা রাগের কথা ভুলে গিয়েই বলে ওঠে, আইচ্ছা আমি দেখতাছি।

সে আবার উঠোনে নামে। গোয়াল ঘরের পাশে শুয়ে শুয়ে জাবর কাটতে থাকা গাই দুটোর দিকে একবার তাকায়। তারপর গোয়ালের ভেতর বাঁধা বাছুর দুটোকে দেখে নিয়ে ঘরের দিকে ফিরে আসতে আসতে দেখে মমতাজ একটি বেতের কাঠায় করে খৈল-ভুষি নিয়ে আসছে। আজগরের দিকে সেটা বাড়িয়ে ধরে বলল, ধরেন। আমি গরম পানি আর নুন লইয়া আই।

মমতাজ ফিরে যেতে যেতে আজগর হাতের কাঠা থেকে খইল ভুষি জাবনায় ফেলে। তারপরই জাবনার পানিতে হাত দিয়ে দেখল ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তারপর সে পানিতে খৈল-ভূষি মেলাতে মেলাতে কণ্ঠ উঁচিয়ে বলল, নাইন্দের পানি দেহি ট্যালক অইয়া রইছে। পানি ততা অইছেনি?

-অইছে, অইছে!

বলতে বলতে বড়সড় একটি মাটির হাঁড়ির মাঝামাঝি দুপাশে ন্যাকড়া দিয়ে চেপে ধরে নিয়ে আসে মমতাজ। জাবনায় পানিটা ঢেলে দিয়ে হাঁড়িটা এক পাশে নিরাপদ দূরত্বে মাটিতে রেখে গোয়াল ঘরে গিয়ে গাই দুটোকে ছেড়ে দেয়। আর তখনই প্রায় ছুটে এসে প্রাণী দুটো মুখ বাড়িয়ে হামলে পড়ে জাবনায়।

দৃশ্যটা দেখে মুখে চুকচুক শব্দ করে আজগর বলে, ইশ, দেখছনি বালা, তিয়াসে দুইডা কেমন পাগল পাগল অইয়া রইছে!

-বাছুর দুইডারও লাগে এমন লাগতাছে!

গোয়াল ঘরের ভেতর থেকে বলে ওঠে মমতাজ। তার কথা ফুরোবার আগেই বাছুর দুটোও ছুটে এসে আলাদা আলাদা ভাবে গাই দুটোর বানে মুখ লাগিয়ে লেজ নাড়াতে আরম্ভ করে।

প্রতিদিনের এ কাজগুলো নির্দিষ্ট করা আছে মতিনের জন্য। যে কারণে গাই-বাছুর নিয়ে তাদের কারো মাথা ঘামাতে হয় না কখনো। কিন্তু আজ কী এমন হয়েছে যে, মতিনের মতো অতি উৎসাহী কিশোরের কোনো দৃষ্টি নেই নিজের প্রিয় প্রাণীগুলোর প্রতি? তখনই সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে যে, ছোট ভাইয়ের মনের ভেদ তাকে জানতে হবে। রাগারাগি করে কোনো ফল হয়তো পাওয়া যাবে না। এমনিতেই তাদের দুজনকে সে অপছন্দ করে বলেই খানিকটা সন্দেহ হয়। নয়তো মমতাজ এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছে আজ বেশ কয়েক মাস হয়ে গেছে অথচ দুজনের মাঝে তেমন একটা আলাপ সালাপ আছে বলে মনে হয় না। দেবর ভাবির মাঝে কিছু নিয়ে রসিকতা তো দূরের কথা কোনো কিছু নিয়ে পরামর্শের ব্যাপারও তার চোখে পড়েনি।

গাই দুটোর খিদে হয়তো খুব বেশিই লেগেছিল। আর তাই দেখা যায় জাবনার সব সাবাড় করে দিয়ে প্রাণী দুটো তলানি চাটতে আরম্ভ করেছে। দেখলা কী হাল করছে? বলেই পাশ ফিরে তাকিয়ে মমতাজকে দেখতে না পেয়ে বেশ অবাক হয়ে যায় আজগর। কিছুক্ষণ আগে মাটিতে রাখা হাঁড়িটাও নেই। কোন ফাঁকে সে সে হাঁড়ি নিয়ে চলে গেছে ব্যাপারটা মোটেও তার দৃষ্টিতে পড়েনি। কেমন মানুষ মমতাজ? একটু আভাসও দিয়ে গেল না যে সে চলে যাচ্ছে?

বাছুর দুটোর পেট ভরা হয়ে গেলে যে আবার বেঁধে রাখতে হবে সেটাও কি তাকে শিখিয়ে দিতে হবে? খানিকটা অভিমান বা রাগের বাষ্প জমা হয়েই বুঝি ফুলিয়ে দেয় তার নাকের পাটা। আর সে অবস্থাতেই সে গাই দুটোকে জাবনার পাশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিয়ে বাছুর দুটোর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু তারও খিদে পেয়েছে প্রচণ্ড। কখন গাও-গোসল দেবে কখন খাবে? এ ভাবনা তাকে খানিকটা অস্থির করে তোলে।

শরবতের নেসা ডান হাতে ছোটখাটো কালোপনা একটি মাটির হাঁড়ির কানা ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে আসছিলেন। তাকে দেখতে পেয়েই আজগর খানিকটা রোষের সঙ্গে বলে উঠলো, মাগো তোমার পুতে গেল কোহানো?

শরবতের নেসার মনটা কোনো কারণে হয়তো বেশি প্রসন্ন ছিল। তাই তিনি হাসি মুখে বললেন, তুইও ত আমার পুত!

-তোমার ছোড পুতের কতা কই!

-মিশন সাবের কাছে যাইবো কইলো।

-মিশন সাবের কাছে কী এত? এ বি সি পইড়া জজ ম্যাজেস্টার অইবোনি? কাজ-কামের কিছু কি তার দেহন লাগে না?

-পুত, তে না তর ছোড ভাই! বড় ভাই অইছত তাইলে কোন কামে?

-সব আমার উপরে দিয়াই যাউক, আর তোমার ছোড পুত হান্ডু হান্ডু কইরা দৌড় পারুক!

-তর উপরে দিয়া না কার উপরে দিয়া যাইবো? মতিন্যায় ম্যাজেস্টার অইলে কি তর কাছে আইয়া বইয়া থাকবো? এই ঘরবাড়ি, ক্ষেতি-খোলা ত তহন সবই তর!
বলে শরবতের নেসা মিটিমিটি হাসতে থাকেন।

-হ। কত দেইখ্যাম না! বলে নিজেও হেসে ওঠে আজগর।

ছেলের হাসি দেখতে পেয়ে শরবতের নেসা বললেন, যা, গাও-গোসল দিয়া আয়। আমি ভাত দেই।

-বাছুর দুইডা বাইন্ধা যাইতাছি।

-আইচ্ছা আয়। তর জেডি জালা পিডা দিল। বলেই, তিনি ডাকতে আরম্ভ করলেন, বউ! ও বউ।

-আইতাছি আম্মা!

বলেই রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আসে সে।

আজগর বাছুর দুটোকে গোয়াল ঘরে বেঁধে রেখে বের হবার সময় কেবল এক ঝলক দেখতে পায় মমতাজকে।

(চলবে)
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×