প্রেম বলতে যে একটা ব্যাপার আছে তা আমাদের কারো কারো জীবনে, অভিধানে আর নানা রকম গল্প-কবিতায় পাই। সত্যিকার অর্থে তা আছে কি নেই সেই বিতর্কে না গিয়ে বলি যে, ব্যাপারটি আদৌ থাকলেও হয়তো তার ধরন-ধারণ ভিন্নতর। সত্যি কথা বলতে কি, এ ব্যাপারটা আজ অবধি আমার উপলব্ধির বাইরেই থেকে গেছে মনে হচ্ছে। আমার দেখা তথাকথিত প্রেম নামের সম্পর্কগুলোতে জড়িয়ে থাকে খানিকটা মায়া-মমতা, বেশ খানিকটা তিক্ততা। আবার স্বপ্নের মতো কখনো এক-আধটু রসের উপস্থিতিও লক্ষণীয়।
কিন্তু আজ স্বীকার করতে কোনো বাধা নেই বা কারো মানহানিকর কোনো ঘটনা ঘটবারও সম্ভাবনা নেই। যদি পরিষ্কার করে বলি, তাহলে এ কথা বলাটাই সমীচীন যে, তারা ইহজগতে কেউ নেই আজ। রুষ্ট ভাষায় বললে বলা যেত তারা সবাই মরে হেজে গেছে। কেবল আমিই বেঁচে আছি তাদেরকে ঘিরে বেড়ে ওঠা যাবতীয় স্মৃতির ভারবাহী হয়ে। অথবা তাদের মনোজগতে আলাদা যে স্বপ্নগুলো ছিল, যেগুলোর অধিকাংশই বাস্তবায়নের প্রত্যাশা ছিল আমাতে ভর করে। আর সে সব স্বপ্নের অংশীদার হতে না পারার ব্যর্থতা কিংবা তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সমূহকে কাটছাঁট করে আমার সমপর্যায়ে নামিয়ে আনতে না পারার হতাশার গল্প বলে যেতেই টিকে আছি এতটা কাল।
যাদের জীবনে তুষ্টি শব্দটার সঙ্গে পরিচয় না থাকে, যাবজ্জীবন তারা কি পরিবারে, কি সমাজে কাঁটার মতই অস্বস্তিকর। তাদের আড়ালে রচিত গল্পের ছিটেফোঁটা বা কোনো রকম রঙ পৌঁছায় না তাদের সামনে। লোকে তো বলবেই। তাদের অবসরে বিনোদন বলতে একটাই- পরচর্চা; যাতে কান দিলে জীবনের পথে এগোবার পথে নানা আকৃতির খানা-খন্দ তৈরি হয়ে যায়। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী জীবনে পিছিয়ে থাকতে চাইলে কে কী বলল তা কান পেতে শুনতে শুনতে আত্মমগ্ন হয়ে দিনরাত পার করে দেয়া যেতে পারে সেসব কথামালার বিশ্লেষণ আর ব্যবচ্ছেদে।
মানুষ যে বড্ড পরশ্রীকাতর। অন্যের ভালো বা মন্দ কোনোটাই সহ্য হয় না তার। তাই সময়ে সময়ে সে জোট বাঁধে। জোট ভাঙেও। কখনো বা হয়ে যায় আততায়ী। তাহলে কোন ভরসায় এক মানুষ আরেক মানুষের পাশে থাকে? আসলে মানুষ মানুষের জন্যে বা জীবন জীবনের জন্যে হলেও খুব কম মানুষই আছে যারা অন্যকে যন্ত্রণাবিদ্ধ না করে নির্বিঘ্নে সময়গুলো কাটাতে পারে।
পাঠক, ভূমিকাটা কি খুব বেশি বড় হয়ে গেল? আচ্ছা হোক। সবারই তো কিছু না কিছু বলার থাকতে পারে। এমন কি আমার সাবেক প্রেমিকারা, যাদের কথা বলব বলেই এখানে শেকড় গেড়ে বসে আছি সুদীর্ঘকালের সাধনায়। সেই তাদেরও হয়তো কিছু বলার মতো ছিল বা বলেছে যার কোনো কিছুই আমার কর্ণগোচর হয়নি।
পাশের বাড়ির মার্জিয়ার সঙ্গে শেষবারের মতো যখন দেখা হয়েছিল মেঘনা ফেরিঘাটে- অপেক্ষমাণ পূর্বমুখো বাসের জানালা দিয়ে মাথা বের করে আর্তনাদের মতো ডেকে উঠেছিল- মাসুম ভাই!
নিজের নামটা উচ্চারিত হতেই আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। হতে পারে লজ্জায় বা তীব্র ক্রোধের বিবমিষায়। দেহ-মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসার জন কবে কোন অশুভ মুহূর্তে ভাই সম্পর্কের সমান্তরাল হয়ে উঠেছিল জানা নেই। তার কণ্ঠস্বরে আমার মতোই চমকে উঠেছিল আরো কেউ কেউ। যারা ঢাকামুখী গাড়িতে আরোহণের জন্যে ফেরি থেকে নেমে আমার আশপাশ দিয়ে আগু-পিছু হয়ে তাড়া খাওয়া প্রাণীর মতই ছুটছিল যার যার নির্ধারিত বাসের দিকে। যদিও তারা একবার থমকে গিয়ে আর্তনাদের উৎসের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে অবসান ঘটিয়েছিল তাদের চমকের। কিন্তু আমি তা পারিনি বলেই বিপুল অভিমানে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম এন্তেজারিয়া লেখা ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া দ্রুতযান এর জানালার পাশে। যেখানে চাতক-মুখ বের করে প্রতীক্ষায় ছিল মার্জিয়া। আর মনের ভুলে বা বিগত কালের কোনো এক সময়ের অভ্যাস বশে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম- ভালা আছস?
-ভালা আছি। আলহামদুলিল্লা। খালি একটাই অশান্তি- বাচ্চার বাপ বছর কাবারী রুগী।
তারপর পাশ থেকে উঁকি দেয়া একটি শিশু-মুখ জানালার কাছে দুহাতে সামলাতে সামলাতে বলল আবার, তুমি কেমন আছ? বিয়া-শাদী করছ?
-আমারে কে মাইয়া দিব কও?
-কেন দিব না? অহন তো তোমার বয়স হইছে।
বয়স হয়তো আমার নিজের বাড়ছে, বিয়ার লাইগ্যা না।
আহত দৃষ্টি নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল মার্জিয়া। হয়তো ভাবছিল যে, আমার মতো অপদার্থের ভাগ্যে বিয়ে ব্যাপারটা নেই। যে লোক বিয়ে করে বউকে কী খাওয়াবে, কী পরাবে কেমন করে সংসার চলবে তেমন ভাবনায় অস্থির থাকে, তেমন মানুষের বিয়েরই বা কী প্রয়োজন?
যেদিন তার বিয়ে হয়ে যায় তার আগের দিন তাকে বলেছিলাম, রাজি অরাজি যখন তর হাতে, তাইলে বিয়ার কথা মানা কইরা দে।
সে তাৎক্ষণিক ভাবে বলে উঠেছিল, তোমার পড়া কবে শেষ হইব আর কবে চাকরি পাইবা তার তো কিছু ঠিক নাই। তা ছাড়া আমারে বিয়া কইরা তো ঠিক মতন ভাত-কাপড়ই দিতে পারবা না।
হঠাৎ এন্তেজারিয়া লেখা ঢাকা টু ব্রাহ্মণবাড়িয়া দ্রুতযান এর ইঞ্জিন গর্জে উঠবার সঙ্গেসঙ্গে রাস্তার ঢাল বেয়ে গড়াতে থাকে ফেরির দিকে। জানালা দিয়ে মাথা বের করে মর্জিয়া তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি দেখি মার্জিয়ার কণ্ঠার হাড়, তেলহীন উসকোখুসকো লালচে চুল। গালের মেছতা। কালি মাখা কোটরাগত চোখ। কাঁধের পাশে ব্লাউজের গলার প্রান্তে বের হয়ে থাকা ময়লা অন্তর্বাসের স্ট্র্যাপ।
ফেরিতে বাসগুলো উঠে গেলে নিরাপত্তা বেড়া লাগিয়ে ফেলা হয়। হয়তো এখনই ফেরিটা যাত্রা করবে। হঠাৎ মনে পড়ে, আহা মার্জিয়াকে একবার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, স্বামীর ঘরে ঠিক মতো ভাত-কাপড় পায় তো? কিন্তু ততক্ষণে ফেরি চালু হয়ে গেছে। পানিতে আলোড়ন তুলে বাঁক নেবার জন্যে পেছন দিকে যাচ্ছে। আমি যে বাসের যাত্রী হয়তো সে বাসের ড্রাইভারই ঘনঘন হর্ন বাজাচ্ছিল আমার উদ্দেশ্যে।
মার্জিয়ার অভাব খুব বেশিদিন অনুভব করতে হয়নি আমাকে। দিন কয়েক প্রচণ্ড রোদে নেতিয়ে পড়া চারাগাছের মতো বিষণ্ণ ছিলাম কেবল। আর সেই অবসরে আমার অরক্ষিত মনের খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছিল কুড়িগ্রামের নুরী। মানে নুরুন্নাহার। তিতুমির কলেজ থেকে সিট বদল করে যে ভর্তি হয়েছিল আমাদের ডিপার্টমেন্টে।
মার্জিয়ার কথা মাঝে মধ্যে মনে হলেও নুরীর প্রগলভতা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সময়ের অচেনা চরাচরে। আমাদের পারস্পরিক মুগ্ধ পদচারণের অদৃশ্য ছাপে ভরে উঠতে থাকে ঢাকা শহরের ছোট বড় রাস্তা আর ফুটপাত। মুহূর্তগুলো প্রায়ই আটকে থাকে লাইব্রেরি আর টিউটোরিয়ালের নির্মম রজ্জুতে। তার ভেতর দিয়েই আমরা পরস্পর ঋদ্ধ হই নানা প্রতিশ্রুতির আশীর্বাদে। সেই সঙ্গে আটকে যেতে থাকি নানা স্বপ্নের সূক্ষ্ম জালে। কিন্তু স্বপ্ন তো স্বপ্নই। বেশির ভাগ মানুষ স্বপ্ন দেখে হতাশ হবার জন্যেই। স্বপ্ন তৈরি হয় কোনো একদিন ভেঙে যাবে বলে। জীবনের কিছু একটা গড়া-পেটা করতে হলে চাই সঠিক পরিকল্পনা। আমাদের পরিকল্পনা থাকলেও তার ভেতর যে ঢের ফাঁক-ফোকর আড়াল হয়েছিল তার সবগুলোই ধরা পড়েছিল নুরীর চোখেই।
রেজাল্ট বের হবার মাস খানেক আগেই একদিন বাংলাদেশ ডাক বিভাগের লোগো লাগানো হলুদ খামে পুরোনো এক ডায়রির ছেঁড়া পাতায় মাত্র চারটে লাইন লিখেছিল নুরী। এখনও এতকাল পরও দেখতে পাই জ্বলজ্বলে অক্ষরের লেখাগুলো। তবে ডায়রির ছেঁড়া পাতায় মোটে চারটে লাইন দেখেই আমার মনে কু ডেকে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল আমার জন্যে নুরীর ভালবাসা আর অবশিষ্ট নেই। প্রেম নামের সেই গানের কোকিলটা বৃক্ষ বদল করেছে। যে কারণে আমার জন্যে খাম, কাগজ, কালি আর সময় সবই বাড়ন্ত। তাই যতটা সম্ভব কম অপচয় করতেই লিখেছিল, মাসুম, আমার হাতে মোটেও সময় নেই। নয়তো আমিই তোমার সঙ্গে দেখা করতাম। চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসতে চেষ্টা করবে। খুব জরুরি কথা আছে। আগামী ১৩ তারিখ পর্যন্ত বিকেল চারটা থেকে পাবলিক লাইব্রেরিতে থাকব। নুরী।
সত্যিই সময় ছিল না নুরীর। দেখা হতেই এগিয়ে এসে সে বলেছিল, ওহ মাসুম, তোমাকে বোঝাতে পারবো না যে, ঘরের চাপ আর আত্মীয়-স্বজনের চাপে কী যে অবস্থা হয়েছিল আমার। চারদিকের এত চাপ নিতে পারছিলাম না। শেষে মত দিতেই হলো। সামনের সপ্তাহে ওর সঙ্গে আমেরিকা চলে যাচ্ছি। এ নিয়ে মন খারাপ করবে না কিন্তু।
আমি তাকিয়ে দেখছিলাম নুরীর ঝলমলে চেহারা আর পোশাকের চ্ছটা। এমন একটা জীবনই যেন প্রত্যাশিত ছিল তার। তাই প্রথম সুযোগেই ঝেড়ে ফেলেছে কুটো-কাঁটা সম পুরোনো প্রেমিক। আচ্ছা যা হবার তা তো হয়েছে। এ জীবনটা দীর্ঘ হলেই নুরীর স্বার্থপরতা আমার মনে ঘৃণার জন্ম দেবে না।
-এনি ওয়ে, মাসুম!
নুরী হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটায়। বনানীতে বাড়ি, নিজেদের গাড়ি, শ্বশুর আর ভাসুরদের বিশাল ব্যবসা। আমেরিকায় ওর ভালো বেতনের চাকরি। তোমার গাড়ি-বাড়ি না হোক একটা চাকরি-বাকরি থাকলেও বাড়িতে রুখে দাঁড়াতে পারতাম। কিন্তু তোমার কারণেই পায়ের নিচে মাটি পেলাম না। আচ্ছা চলি। সন্ধ্যায় আবার পার্টি আছে। ভালো থেকো। বাই!
নুরীর কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল যে, এখানে আসবার আগে এ কদিন কী বলবে মনেমনে রিহার্সাল দিয়েছে ভালো মতই। তাই হয়তো গড়গড় করে বলে যেতে পারল কথাগুলো। আসলে সবার জন্যেই কোনো না কোনো একটি অজুহাত তৈরি হয়ে যায়। বিবেকের কাছে সরাসরি ছোট হতে চায় না কেউ। চকচকে একটি গাড়িতে চড়ে চলে গিয়েছিল সে। আমার সামনে দিয়ে যেতে যেতে তার পাশের জানালার কাচ তুলে দিয়ে আড়াল করে নিয়েছিল মুখটা।
চিঠি পেয়েই মনেমনে কিছুটা অনুমান করতে পেরেছিলাম। তবু ব্যাপারটা অতটা জোরালো হয়ে আমাকে আঘাত করবে ভাবনায় ছিল না। মাস খানেক প্রায় শয্যাগত ছিলাম বলা যায়। বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করতো না। বাবা-মা প্রতিদিনই একই কথা বলতেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে- তর হইছে কী রে?
আমি নির্লিপ্ত জবাব দিতাম, কিছু না। আর টুকটাক অসুখ-বিসুখ তো মানুষের হয়ই। নাকি হয় না?
বাবা-মা বিষণ্ণ চোখে পুত্রকে দেখেন। হৃদয় ছেনে পুত্রের মানসিক বৈকল্যের কারণ অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হন। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে হতাশ কণ্ঠে বলেন- এমন হাসি-খুশি পোলাডার হইল কী?
মাস কয়েক পরই ওপি ওয়ান নামে একটি বিশাল চমক আর আশার জাহাজ হয়ে অকস্মাৎ সব শ্রেণির মানুষের দরজাতেই কড়া নেড়ে দিয়ে গেল। চাষা-ভুষো বন্ধুদের উৎসাহে নিতান্তই বাধ্য হয়ে বলা যায় বিবাহিত বলে একটি আবেদন পত্র পুরো করে পাঠিয়েও দিয়েছিলাম। অথচ সেই লটারি আমার ভাগ্যে লেগেছে কি লাগেনি সে সংবাদ পাবার আগেই মায়মুনার চাচা ধোলাই খালের ফুটপাতের সওদাগরী একদিনের জন্য বন্ধ করে দিয়ে সরাসরি বিয়ের পয়গাম নিয়ে হাজির।
নিজের পরিচয় দিয়ে লোকটা বলেছিল, আপনের হগল খবরই লইছি। বুচ্ছেন নিকি? দেড়-দুই লাখ ট্যাকা খরচা কইরা আপনের মতন পোলা আম্রিকা যাইবার পারবেন না। আমার ভাতিজি মায়মুনারে বিয়া কইরা লগে লিয়া যান। বিয়া থাইকা শুরু কইরা আম্রিকা ইস্টাব্লিশ কইরা দেওন তক সব খরচাপাতি আমরা করমু। আপনে কোনো চিন্তা কইরেন না!
সে সময় নুরীর কথা মনে পড়ছিল খুব। মায়মুনার চাচার প্রস্তাবকে বাবা-মা কেউ পাত্তা দিলেন না। এমন কি ওপি ওয়ান লটারি জিতেছি সে কথাও তারা বিশ্বাস করেননি। উলটো মায়মুনার চাচাকে ঠগ-বাটপার আরো অনেক কথা বলে অপমান করে দিয়েছিলেন। কিন্তু গ্রামের লোকজন আর আত্মীয়-স্বজন সবাই মিলে কথাবার্তা এগিয়ে নিলো। বন্ধুদের মাঝে বেশি চালাক হাবু নিজে যোগাযোগ করে সব খবর নিয়ে এসে বাড়িতে জানাতেই, সবাই চেপে ধরল বাবা-মাকেও। বুঝতে পারছিলাম নুরীর সমস্যাটা কোথায় ছিল। তার সঙ্গে আরো একটা জিনিস খুব ভালো বুঝতে পেরেছিলাম যে, নিজের প্রয়োজনটা যেখানে বড় হয়ে ওঠে সেখানে অন্যান্য হিসেব নিকেশ গোণা-গুণতির বাইরেই রাখতে হয়।
মায়মুনার খালা-খালু দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন নিউজার্সির নেলসন লেনের কাছাকাছি একটি বাড়ির বেইজমেন্টে। যেখানে সারাদিন লাইট জ্বলে। ঘরের ভেতর কখনো কখনো চলাফেরা করতে হয় মাথা নিচু করে। বাচ্চা দুটো স্কুলে থাকলে তেমন একটা সমস্যা হয় না। মায়মুনা আর তার খালা-খালুর মতে আটলান্টিক সিটি এলাকায় কাজকর্ম পেতে সুবিধা হবে। সে সঙ্গে ড্রাইভিং লাইসেন্স আর সিকিউরিটি ট্রেনিঙের সার্টিফিকেট হাতে পাওয়া জরুরি।
ড্রাইভিং স্কুলে যাওয়া আর সিকিউরিটি ট্রেনিং স্কুলে খালু নিজেই আনা নেওয়া করেন নিয়ম করে। বাকি সময়টা মায়মুনার সঙ্গেই কাটে। কখনো বাইরে হাঁটাহাঁটি করি। এ দোকান ও দোকান ঘুরে বেড়াই। এরই মাঝে আমার ট্রেনিঙও শেষ হয়ে আসে। ড্রাইভিং লাইসেন্সও পাওয়ার সময় হয়ে আসে। যখন মনেমনে ভাবছিলাম মায়মুনা মেয়েটা বুঝি টিকেই গেল আমার সঙ্গে। আর তাই তার ওপর পুরোপুরি ভরসা করবো করবো ভাবছি, তখনই একদিন সে বলল যে, তার কোনো এক বান্ধবী জ্যাকসন হাইটে থাকে। সে খুব করে ধরেছে যাওয়ার জন্য। তার বাচ্চাদের দেখাশুনার কেউ নেই। সে ভর্তি হবে হাসপাতালে। বললাম, কাগজপত্র হাতে পেয়ে দুজনে একসঙ্গেই যাই।
সঙ্গে সঙ্গেই সে জানিয়ে দেয়, অত টাইম নাইক্যা। আর হপ্তা পরে আপনের কাগজ হইবো এমন সুম আপনে অত দূর যাওন ঠিক হইবো না। নাইলে তো আমিই আপনেরে লগে লিয়া যাইতাম! কাইল বিয়ানে যামু ঠিক করছি। গাড়ি লিয়া লোক আইবো। আর চিন্তা কইরেন না কলাম, ফুনে আপনের খবর লিমু!
আসলে মায়মুনা আমার মতামতকে পাত্তা না দিলেও পারতো। যেহেতু তার দরকার ছিল এখানে আসা আর আমার দরকার ছিল এখানে আসতে যা প্রয়োজন তা পাওয়া। আমরা যার যার স্বার্থ উদ্ধার করে ফেলেছি এক অর্থে। কিন্তু অতটা স্বার্থ ভাবনা আমার ভেতর প্রবল হয়ে ওঠেনি তখনো। ভেবেছিলাম বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবো একসঙ্গে। কিন্তু তার তাড়াহুড়া দেখে আমার মনের ভেতর ফের কু ডেকে ওঠে। তাহলে কি সুতোটা ছিঁড়েই যাচ্ছে? নতুন নতুন এখানে ওখানে গোত্তা খাবে, উড়তে উড়তে কোথাও খানিকটা আটকাবে। আবার জোর বাতাস এলে ভাসতে থাকবে। তার মানে ফিরে আসবে না আর?
মায়মুনা নেই তো হয়েছে কী? পুরুষ মানুষ এসব নিয়ে মন খারাপ করে নাকি? তারা আটলান্টিক সিটিতে কাজ খুঁজছিল। কথায় কথায় খালা বলছিল, ওইটা হইল জুয়ার আখড়া বুঝছ জামাই? দিনরাইত ডলারের খেলা। ওইখানের কিছু একটাতে যদি তোমারে ফিট করবার পারি। খালি ডলার গিনবা!
আমার নৈঃসঙ্গ্য কাটাতে বাচ্চা দুটোও চেষ্টা করতো। খালা খালু চেষ্টা করতেন সময় দিতে। কাজ থেকে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে তারা বাইরে বের হলে আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এভাবে অনেক রাত অবধি ঘোরাঘুরি চলত। কিন্তু যে কদিন সেখানে ছিলাম, আমি জানতে পারিনি কখনো যে দুজনের পেশা কী ছিল। তারা কখনো বলতেন, রাস্তাঘাট, দোকানপাট চিন্যা লও। বাঙ্গালের তো টেস্কি চালানি, দোকানদারি, ক্লিনার, সুইপার ছাড়া তেমন ভালা কাজ নাইক্যা।
আমেরিকা আমার জন্যে যেমন দুঃস্বপ্নময় ছিল, জীবন-যাত্রাও ছিল আরো শ্বাসরুদ্ধকর। অভ্যস্ত হতে যেমন কষ্ট হয়েছে, তেমন সময়টাও লেগেছে বেশি। তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে অল্প দূরত্বে একটি ছোটখাটো পার্ক আছে। যেখানে বাচ্চা আর বৃদ্ধদেরই দেখা যায় বেশি। সেটা ছাড়িয়ে আরো বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে গাড়ি পার্ক করলেন খালা। মাঝে মাঝে খালাও ড্রাইভ করেন। খালু বললেন, চল জামাই আইজকা একটা নয়া খাওন খাই। বিয়ার খাইছ কোনোদিন? ব্রান্ডি,হুস্কি, ভডকা?
এসবের নাম বিভিন্ন লেখায় পেয়েছি। খাওয়ার ভাবনা মাথায় আসেনি কখনো। যে যেমন ওজনের তার বন্ধুরাও তেমন। কাজেই শহুরে বন্ধুদের মুখেও এসব খাওয়ার কথা শুনিনি। বার কাম রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই আমার চোখ পড়ল গিয়ে সর্ট স্কার্ট আর টি-শার্ট পরনে ছেলেদের মতো ছোট করে ছাটা চুলের এক ওয়েট্রেসের ওপর। চেহারাটা কেমন যেন খুব চেনা মনে হতেই ভেতরে ভেতরে কিছু একটা খচখচ করতে থাকে। মেয়েটি এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে যাওয়ার সময় একজন কালো লোক তার নিতম্বে হালকা চাপড় দিতেই মেয়েটির মুখে বিব্রতকর হাসি ফুটে উঠল।
খালু হয়তো আমার দৃষ্টি অনুসরণ করেই বলে উঠলেন- মাইয়াটারে চিন নাকি? আমাগো দেশি। জামাইটা ভালো চাকরি করলেও দুইজনের বনিবনা নাই। দুইজন দুইখানে থাকে। মাইয়াটা আমাগো লগে সাবলেট আছিল ছয় মাস। টুকটাক আলাপে এক আঢটু জানছি। তাও হালার বাঙ্গাল মাইয়ারা কি সব খোলাসা কইরা কয়? বলতে বলতে একটা খালি টেবিল দেখে চেয়ারে বসে পড়েন তিনি।
বাচ্চা দুটি বসতেই খালা কেমন ফস করে বলে উঠলেন, থামবা তুমি? আজাইরা প্যাঁচাল পাইলে মুখ আর বন হইবার চায় না। রাবিশ!
খালুর বকবকানি থামলেও খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চোখ রাখি মেয়েটির ওপর। আমার সন্দেহ হলেও তেমন কোনো জোরালো যুক্তি খুঁজে পাই না যে, মেয়েটি নুরীই হতে পারে।
খাওয়া শেষ করে বাচ্চা দুটো আগে আগে উঠে পড়ে একজন বলল, আমরা অন ফুট পার্কটাতে যামু। ওইখান থাইকা পিক কইরা নিও।
তারপর কারো মতামতের অপেক্ষা না করেই তারা ছুটে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে।
খাওয়া শেষ করে খালা হাত ধুতে গেলে খালু ফিসফিসিয়ে বললেন, একদিন আলাপ কইরা যাইও। একলা মাইয়া মানুষ! বলেই চোখ টিপলেন।
পরদিন হেঁটে হেঁটেই বাসায় ফিরবো বলতেই তারা আমাকে রেস্টুরেন্টে ছেড়ে বিল দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু নুরীকে একবার দেখলেও পরে আর দেখতে পাই না। কাউন্টারে বসা লোকটিকে তার কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল, ওহ নরুন? ও তো ছুটি নিয়ে চলে গেছে। হাসপাতালে যাবে বলল।
হতাশ হয়ে আমি কার্পেন্টার স্ট্রিট আর নেলসন লেনের কোণে পার্কের উদ্দেশ্যে হাঁটি। সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরবো। পার্কের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পাই সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। বলল, হাই!
আমিও জবাবে একই শব্দ উচ্চারণ করি।
-আমার না হয় মাথা বিগড়েছিল, তোমার এ দুর্মতি হলো কেন?
-অদৃষ্টে ছিল বলে ওপি ওয়ান পেয়ে গিয়েছিলাম।
-সে কোথায়?
-কার কথা বলছ?
-যার কাঁধে চড়ে এদেশে ঢুকেছ।
-আছে অথবা নেই। এখনো নিশ্চিত না।
-এ এলাকাতেই থাকবে নাকি অন্য কোথাও কাজ খুঁজবে?
-দেখি।
-অমন হুটহাট আমার খোঁজ-খবর করতে যেয়ো না। আমার আশপাশে তোমাকে দেখলে বিপদে ফেলে দেবে।
-তুমি আছ কোথায়, তা তো বলবে!
-না। সে চেষ্টা করতে যেয়ো না ভুলেও।
তারপরই সাইকেল টেনে ফুটপাত থেকে রাস্তায় নেমে সাইকেলে উঠে বিপরীত দিকে কার্পেন্টার স্ট্রিট দিয়ে দ্রুত চলে যেতে লাগলো প্যাডেল চেপে। রাস্তার একটি বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেলে নুরীর উদ্দেশ্যে বলি, ভালো থাকবে বলেই তো আমাকে ছেড়েছিলে, কিন্তু পারলে না কেন?
না নুরী, না মায়মুনা। কারো সঙ্গে পরের বার কোথাও দেখা হওয়া দূরের কথা আলাপও হয়নি আমার। মায়মুনার খালা একবার বলেছিলেন, মাইয়াটা বরবাদ হইয়া গেল! হুনলাম বিয়া-শাদী ছাড়াই আমাগো মহল্লার আরমানের লগে থাকতাছে। মন খারাপ কইরো না তো মাসুম! যে নষ্ট হইছে তার আশা ছাড়ান দেও। ভালা মাইয়ার খোঁজ করতাছি তোমার লাইগা।
-মাইয়া খোঁজাখুঁজির কাজ নাই খালা!
-তোমার সামনে সারাটা জীবনই পইড়া আছে। মৌজ-মস্তি তো অখনই করবা। আম্রিকার বাতাস লাগলে দেখবা পিছনের সব কিছু ঝাপসা!
খালার কথায় হয়তো ভুল কিছু ছিল না। হয়তো আমার ভাবনাগুলোও সঠিক ছিল না। তবে একটি কথা স্বীকার করতেই হবে যে, আমার প্রেমিকারা আমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে না পারলেও একটি ব্যাপার শিখতে বেশ সাহায্য করেছে। আর সেটা হচ্ছে সহনশীলতা। আজকাল আমি কিছুতেই হতাশ যেমন হই না, অস্থিরও হয়ে উঠি না। সহ্য ক্ষমতা আর ধৈর্য শক্তি বেড়েছে অনেক। শুধু তাদেরই ধৈর্য ছিল না। ছিল না বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে চলবার ক্ষমতা। এমন কি তাদের কারো ভেতর ছিল না কোনো অনুশোচনা বা লজ্জা বোধও
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১৪ রাত ২:০৯