somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন মোস্তাক হোসেনের দিনরাত

২৫ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(ফোটো: গুগুল)

প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে বের হয়ে দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে পাশের নিমগাছটার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে মোস্তাক হোসেন। সে সময়টাতে আর কেউ তার এমন ব্যাপার দেখলে ভাববে যে, লোকটার তার পুরোপুরি না ছিঁড়লেও মোটামুটি জট পাকিয়ে গেছে। নইলে কোনো সুস্থ মানুষ এভাবে গাছের সঙ্গে হেসে হেসে কথা কয়?

অবশ্য এমন একটা সম্ভাবনার কথা নিজেও ভাবে সে। হতে পারে সে গাছের সঙ্গে কথা বলে তার মাথায় গণ্ডগোলের কারণেই। কিন্তু সে নিশ্চিত পুরোটা সন্ধ্যা থেকে পরদিন অফিসে যাবার সময়টা পর্যন্ত কারো সঙ্গে কোনো কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না। যদিও এক সময় আলেয়া আর তার দু ছেলের হট্টগোলে সরব থাকতো ঘরের ভেতরটা। কিন্তু মাঝখান দিয়ে একটা ছোট্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। মা ছাড়া ঘরে ভালো লাগে না বলে মাঝে মাঝে চিৎকার চেঁচামেচি করত দুজনেই। একদিন সকালের দিকে রাগারাগি করে বেরিয়ে গেলেও আর ফিরে আসেনি ওরা।

সন্ধ্যার দিকে কৃষাণী যেমন তার হারিয়ে যাওয়া হাঁস কিংবা ছাগল ছানা খুঁজতে বের হয়, তেমন করে ছেলেদের অনুসন্ধানে মোটেও আগ্রহ হয় না মোস্তাক হোসেনের। এমন হতো তারা হারিয়ে গেছে কিংবা ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে পথে বের হলেও ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছে তেমনটাও নয়। ইচ্ছে করেই যারা ঘর ছেড়ে গেছে তাদের ফেরানোর ভাবনাটা অমূলক। হতে পারে তারা তাদের মায়েরই অনুগামী হয়েছে। সুতরাং তাদের উদ্দেশ্যে পত্রিকায় যেমন বিজ্ঞাপন দেখা যায় ফিরে এসো, তেমন কিছু করবার ইচ্ছে নেই মোটেও।

দরজায় তালা লাগানো হয়ে গেলে মোস্তাক হোসেন পকেটে চাবি রাখবার আগে টেনেটুনে তালা পরীক্ষা করে দেখে ঠিকঠাক মতো লেগেছে কিনা। পকেটে চাহি রেখে ফিরতেই চোখে পড়ে পাশের ঘরে নতুন আসা ভাড়াটিয়ার ছোট বাচ্চাটা ঘরের সামনেই পথের ওপর বসে বসে একমনে তার বর্জ্য পরিত্যাগের কাজটা করছে। একবার ইচ্ছে হয় যে, চিৎকার করে সে পাশের ঘরের লোকজনের উদ্দেশ্যে বলে বাচ্চাটির কথা। অনেক সময় রাতের বেলা বিদ্যুৎ না থাকলে অন্ধকারেই মুখস্থ পথে হেঁটে আসতে হয়। এমন অবস্থায় সতর্ক হয়ে পথ না চললে জুতোর তলায় খানিকটা নমুনা থেকে যেতে পারে।

বড় রাস্তায় উঠে এলে খালি রিকশা নিয়ে তাকে অতিক্রম করতে করতে ঘাড় ফিরিয়ে চালক জানতে চায়, কই যাইবেন?

মোস্তাক হোসেন নীরবে মাথা দুদিকে নেড়ে না করে দেয়। চালক এতেই তার অসম্মতির কথা বুঝে যায় হয়তো। না থেমে গতি বাড়িয়ে চলে যায় সে।
পকেটের ভেতর হঠাৎ সেল ফোনটা বেজে উঠেই থেমে যায়। পরপর তিনবার একই অবস্থা হয়। সেটটা পকেট থেকে বের করে মোস্তাক হোসেন। আজকাল তেমন একটা ফোন আসে না তার। দু চারদিন বা এক দু সপ্তাহে তার কল আসে অফিসের কোনো কলিগের কাছ থেকে। তা ছাড়া মাঝে মধ্যে মিসকল দেয় রুবী। হতে পারে আজও সে মিসকল দিয়েছে। মিসকল লিস্ট চেক করতেই ভেসে ওঠে রুবীর নাম।

কল ব্যাক করতেই ও প্রান্তে শোনা যায়, দোস্ত আছ কেমন?

মোস্তাক হোসেন বিরক্ত না হলেও বলে, খাজুরে আলাপের সময় আমার নাই।

-খাজুরে কেন হবে? তোমার খোঁজ-খবর কি নিতে পারি না? তা ছাড়া একলা পুরুষ মানুষের খোঁজ-খবর না রাখলে কোথায় গিয়ে ডুব দিয়ে ফেলে তারও তো ঠিক নাই।

-তা খোজ-খবর তো করতেই পারিস। আর তাই আগেই তোকে জানিয়ে দিচ্ছি যে, আমি ভালো আছি। ছেলেদের কেউ ফিরে আসেনি বা ফোনও করেনি। আর কিছু?

-শুনলাম তোমার বউ ভেগে গেছে। এমন অবস্থায় ভালো আছ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না।

-আমি তো কাউকে রিকোয়েস্ট করছি না যে বিশ্বাস করতে হবে। এখন সোজা সাপটা বল, কেন ফোন করেছিস?

-আমি সব খবরই জানি। তার বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে। ট্যানারিতে গরু-ছাগলের চামড়া সাপ্লাই দেয় লোকটা। বেশ টাকাঅলা!

-তোর পছন্দ?
বলেই হেসে ওঠে মোস্তাক হোসেন।

-আমার কি আর সে কপাল আছে?

-তাহলে আর কেন বলিস?

-তোমার বউ ভালো থাকবে। সারা বছর তো তার টাকা টাকা করেই কাটতো। ভেবেছিল সরকারি চাকরি তোমার। দু হাতে কামাবে। মোটা মোটা গু খাবে। তাই অমন পাগল পাগল হয়ে বিয়েটা দিয়েছিল তোমার সঙ্গে।

-চুপ করবি তুই?

মোস্তাক হোসেনের কণ্ঠে বিরক্তি বা রাগ গোপন থাকে না। তারপর আবার বলে, আজাইরা গ্যাজানো বন্ধ কর। এখন বল তোর অবস্থা কী, বাচা-কাচ্চা কেমন, বয়রাটা কোথায়, কাজ কাম কিছুতে ঢুকেছে কিনা, নাকি এখনও তার পিঠ বিছানা ছাড়তে রাজি না?

-কাল তো শুক্রবার। সকাল সকাল চলে আস না! নয়তো আমাকে কোথাও আসতে বল।

-ঘর তো খালিই আছে। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বরং তুইই চলে আয় কালকে। বিকেলের দিকে বাসে তুলে দেবো।

-আমি একা আসলে তোমার সমস্যা কী?

-আমার সমস্যা না থাকলেও ঘরের আশপাশে যারা আছে তাদের অনেক সমস্যা। সবাইকে নিয়ে চলে আয়। তাহলে কাল বাজার-হাট করি ভাল করে। নিজে রান্না-বান্না করে খেয়ে যাবি।

-তোমার ওদিকে খাসির গোস্ত পাওয়া যাবে?

-তা যাবে না। শহরে যাওয়া আসা পোষাবে না। তবে গরু জবাই হয় প্রতি শুক্রবার। তুই বললে দু-চার কেজির কথা বলে রাখি। বড় কোনো মাছের ব্যবস্থাও করব।

-আচ্ছা। তবে বয়রাটাকে আনা যাবে না। বিছানা থেকে নামতে চায় না। তা ছাড়া শাশুড়িও আছে।

-বড় মেয়েটাকেও সঙ্গে নিয়ে আসবি। একটা জিনিস কিনে রাখতে বলেছিল।

কথা শেষ করেই মোস্তাক হোসেন তাকায় রশিদের দোকানের দিকে। এখনও সার্টার নামানো। মফস্বল এলাকায় এতটা বেলা করে কেউ দোকান খোলে না। কিন্তু রশিদই ব্যতিক্রম। সকালের দিকে ক্ষেতের কাজ সেরেই তবে দোকানে বসে।

রশিদের দোকানের সামনেই গরু জবাই করে। কেউ কেউ বলে এগুলো চুরির গরু বলেই মোটামুটি দামে সস্তা হয়। যাতে সহজে বিক্রি হয়ে গিয়ে চিহ্ন আড়াল হয়ে যায়। অরা কয়েকজন লোক দেখানোর খাতিরে আশপাশের গ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে গরু দেখে দরদাম করে। কখনো দু একটা কিনেও ফেলে। তবে তা ছ মাসেও একবার ঘটে কিনা সন্দেহ। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে কোথা থেকে গরু আসে এ নিয়ে কারো তেমন মাথা ব্যথা নেই বলেই মনে হয়। নয়তো অতটা নির্ঝঞ্ঝাটে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারতো না। জবাই করা গরুর গোস্ত ভাগা দিয়ে বিক্রি করে। কেউ কেউ আগাম নাম তুলে দিয়ে যায় প্রয়োজনীয় ভাগার কথা বলে।
অফিসে যাবার জন্যে অতটা তাড়া নেই মোস্তাক হোসেনের। আজ বৃহস্পতিবার। দেরি করে গেলেও সমস্যা হবে না। হম্বিতম্বি করবার মতো কেউ আসবে আজ। তবু বিনা কাজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বা ঘুরঘুর করাটা কেউ ভালো চোখে দেখে না। তা ছাড়া যে লোকটি প্রতিদিন বড় রাস্তায় উঠেই রিকশা থামানোর জন্যে হাত দেখায়, সেই লোক আজ দাঁড়িয়ে থেকে বিনা কারণে এদিক ওদিক তাকালে লোকজন সন্দেহ করবেই। কেউ জিজ্ঞাসাও করে ফেলতে পারে। তারচেয়ে ভালো হয় বিজনের রেস্টুরেন্টে বসে নাস্তাটা সেরে নেওয়া। ভাবনাটা মনঃপূত হতেই সে সোজাসুজি হাঁটে বিজনের রেস্টুরেন্টের দিকে।



গরু কাটাকাটি হয়ে গেলেও ভাগে ভাগে সাজানো শেষ হয়নি এখনও। পাল্লায় ওজন করে সমান সমান মাপের বসানোর কাজ চলছে। খানিকটা দূরেই একটি গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল টিএনও অফিসের টাইপিস্ট কাম কেরানি হযরত আলি। সেখান থেকেই দেখতে পেয়ে হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলল, ভাইজান, আপনে একা মানুষ। খাতায় দেখলাম লেখাইছেন চাইর ভাগা। ঘটনা কী?

মোস্তাক হোসেন হাসে। বলে, একা হলেই যে, এক ভাগা লেখাতে হবে আর দশজন হলে বেশি তা কিন্তু ঠিক না।

-এই তো আমার সরল কথাটারে প্যাঁচাইয়া ফেললেন। আপনের লগে কথা কওনও তো বিপদ!

-প্যাঁচের কথা তো আপনিই শুরু করলেন। বলতে পারতেন চার ভাগা লেখালাম কেন? তখনই উত্তরে জানাতাম আমার এক আত্মীয় আসতেছে তার বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে।

-হুম, আসলে ভ্যাজালটা আমিই লাগাইছি বুঝতে পারতাছি।

হযরত আলি বোকার মতো হাসতে হাসতে মাথা চুলকায়। শেষে গলা পরিষ্কার করে নিচু কণ্ঠে বলে, একলা একলা থাকেন, খারাপ লাগে না?

মোস্তাক হোসেন মনে মনে হাসে। ইচ্ছে করলে হযরত আলির একথাটাকেও নানা ভাবে পেঁচিয়ে তাকে বিড়ম্বনায় ফেলে দিতে পারে। কিন্তু তা করে না সে। বলে, সব সময় খারাপ লাগে না। মাঝে মধ্যে মনে হয় একা একা থাকাটা ঠিক হচ্ছে না।

-দোকলা হওনের ইচ্ছা থাকলে আমারে বইলেন সময় সুযোগ মতন।

-কী করতে পারবেন আপনি, আপনার সাবেক প্রেমিকাকে গছাবার কথা ভাবছেন নাকি?

হযরত আলি বিব্রত ভাবে মোস্তাক হোসেনের চোখের দিকে তাকায় একবার। তারপর কান চুলকে বলে, আপনে খুব কঠিন মানুষ। ইচ্ছা কইরা মানুষরে বেইজ্জত কইরা মজা পান নাকি?

-আরে আমি তো এমনিই বললাম!

বলে, হাহা করে হেসে ওঠে মোস্তাক হোসেন। তারপর বলে, মাফ করবেন, সাপ বেড়িয়ে পড়বে বুঝতে পারিনি।

হযরত আলি সন্দিহান দৃষ্টিতে আশপাশে দেখে নিয়ে জিহ্বা দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে ফিসফাস স্বরে বলল, কিছু শুনছেন নাকি আমার ব্যাপারে?

-আরে ভাই অস্থির হবেন না। ওটা এমনিই কথার পিঠে চলে এলো বলে বলেছি।

-পুরুষ মানুষ বেশিদিন একলা থাকন ঠিক না।

-আমার তো তেমন খারাপ লাগে না। নিজে রান্না-বান্না করলে বা কাপড়-চোপড় ধুতে হলে সত্যিই খারাপ লাগতো।

-শরীলের কষ্ট কি সহজে যায়!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হযরত আলি এক ঝলক মাথা ঘুরিয়ে তাকায় গরুর ভাগা সাজানো প্রক্রিয়ার দিকে।

হযরত আলির কথাটা শুনবার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় মোস্তাক হোসেন। ব্যাটা এবার ঠিক জায়গাটাতে খোঁচা লাগাতে পেরেছে। তবু এ প্রসঙ্গে বাইরের মানুষের সঙ্গে কিছু বলাটা ঠিক হবে কিনা ভাবে সে। রাস্তাঘাটে, বা দোকানপাটে খাজুরে আলাপে উৎসাহী লোকজন একজনের কথা নিয়ে অন্যজনের কানে ঢেলে দিতে দেরি করে না। বলবে তো বলবে, আবার এও বলে দেবে- কাউকে বলবেন না যেন। পাগলকে সাঁকো নাড়াতে মানা করা আর কি! তাই ব্যাপারটার সহজ ইতি টানবার উদ্দেশ্যেই সে বলে, বড় ফুপু মেয়ে দেখে রেখেছেন। দুদিন পরপরই ফোন করছেন কেন যাচ্ছি না। কিন্তু ছুটি চাইলে তো পাবো না তিনদিনের বেশি।
-আরে ভাই তিনদিন তো অনেক বেশি!

উৎসাহে ফেটে পড়ে যেন হযরত আলি। একদিনে যাবেন, পরের দিন খরচাপাতি আর বিয়া-শাদি সারবেন। পরের দিন বউয়ের হাত ধইরা ব্যাক করবেন।

-সেই ভুরুঙ্গামারী। এখান থেকে যেতেই দেড় দিন লেগে যায়। আপনার কথা মতো কাজটা স্টেশনেই সারতে হবে ফিরতি ট্রেনের আগে আগে। নয়তো সম্ভাবনা দেখি না।

-তাইলে গার্লস ইশকুলের অংক মাস্টারনিরে দেখেন না কেন? বিধবা হইছে বেশিদিন হয় নাই। বয়সও কম আছে।

-নাহ, সেদিকে আগাবো না। মেয়েটার কান্নাই তো বন্ধ হয়নি। দেখি কী করা যায়। তা ছাড়া ফুপুর তো অধিকারটা বেশি।

আসলে বিয়ে শাদির ঝামেলায় আর যেতে চায় না সে। বাপের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে বেশি সম্পর্কযুক্ত মেয়েরা এমনিতেও বোধ-বিবেচনাহীন বেশির ভাগ। মাস্টারনির ঘরবাড়ি আত্মীয়-স্বজন তো সবই এখানে। এই মেয়ে যে আলেয়ার চেয়ে সুবিধা জনক হবে তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? তা ছাড়া সারাদিন মাস্টারি করে ঘরে ফিরে এমনিতেই ক্লান্ত হয়ে থাকবে। একটি সংসারের প্রধান দুজনই যদি ঘরে ফিরে ক্লান্ত থাকে, তাহলে কে কাকে দেখবে? এসব ঝামেলা নিয়ে বছর দুয়েক কিছুই ভাবতে চায় না মোস্তাক হোসেন। একা থেকে জীবনটাকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চায়। ঠুলি আঁটা বলদের মতো তো জীবনের বাকি দু ভাগের আধা।

হযরত আলি হঠাৎ বলে উঠল, আপনের কোন আত্মীয় আসতেছে?

-আমার এখানে তো একজনই আসে মাঝে-মধ্যে।

-কে, রুবী নাকি জানি নাম?

-হুম। তার আসা যাওয়াতেই কিছুটা কম সময় লাগে। দিনে দিনে ইচ্ছে করলে ফিরতেও পারে।

-কই, এখনো তো আসলো না।

-ভোর ছটায় উঠেছে বাসে। কম করে হলেও ঘণ্টা চারেক লাগবে। আচ্ছা, ভালো আর বড় মাছ পেতে কোন বাজারটা ভালো হবে?

-বাজারের কী দরকার? বিমলরে বইলা দেন দুপুরের আগে আগেই ব্যবস্থা কইরা ফেলবে। বাজারের মাছে তো বিষ দিয়া রাখে। কয় মাস আগের মাছ বুঝনের সাধ্য নাই!

মোস্তাক হোসেন হঠাৎ হাসতে হাসতে বলে, এই প্রথম একটা ভালো পরামর্শ পেলেম আপনার কাছে।

-আগে সবই কুবুদ্ধি দিছিলাম নাকি?

খানিকটা উষ্মা যেন মিশে থাকে হযরত আলির কণ্ঠস্বরে। তারপর আবার বলে, ওই যে, বদলি হইতে চাইছিলেন জিলায়, মানা কইরা কি খারাপ করছিলাম? এখন তো মনে হয় পইড়া যাইতেন ছাঁটাই হওনের দলে!

-তাহলে কথাটা কারেকশন করে বলতে হবে যে, মাঝে মধ্যে আপনার কাছ থেকে দু একটা ভালো পরামর্শও পাই।

-আপনেরে নিয়া আর পারি না ভাইজান! সহজে স্বীকার করতে সমস্যা কি আপনের?

হযরত আলি যেন এবার সত্যিই ক্ষেপে ওঠে।

মোস্তাক হোসেন বলল, সমস্যা নাই। চলেন ভাগা দেওয়া মনে হয় শেষ। ডিপ ফ্রিজে গোস্ত রেখে আমাকে যেতে হবে বিমলের খোঁজে।

হযরত আলি সঙ্গে আসে কি আসে না, তা দেখে না মোস্তাক হোসেন। রশিদের দোকানের সামনে গিয়ে পকেট থেকে পলি-ব্যাগটা বের করে ছুঁড়ে দেয় রশিদের ভাই রফিকের দিকে।

রফিক চারটে ভাগা ব্যাগে তুলে দিতে দিতে বলে, এইবারের ভাগা সোয়া কিলো কইরা পড়ছে। বাজারে গেলে হাজার ট্যাকায় পাঁচ কেজি গরুর গোস্ত পাইবেন না!

ব্যাগটা হাতে নিতে নিতে মোস্তাক হোসেন বলে, তা অবশ্য। তা ছাড়া সেগুলো সত্যিই গরু না মহিষের গোস্ত তা চেনা, আবার এমন তরতাজা পাওয়া দুটোই কঠিন।

গোস্তের ব্যাগ হাতে পথ চলতে চলতে মোস্তাক হোসেনের মনে হয়, আজ পাঁচ কেজিই যেন খুব বেশি ভারি মনে হচ্ছে। আগের সময়গুলোর তুলনায় কি সে আরো বেশি দুর্বল হয়ে গেছে? নাকি পাঁচ কেজি সত্যিই বেশ ভারি? এর আগে পাঁচ কেজি এক সঙ্গে নেবার কোনো দরকার পড়েনি। তাই হয়তো ব্যাপারটা আগে থেকে জানা জানা ছিল না বলেই আজ এমন মনে হচ্ছে।


এতকাল ফ্রিজ খুলবার কোনো প্রয়োজন হয়নি বলে জানা ছিল না ফ্রিজের ভেতর কী আছে বা নেই। গোস্তের ব্যাগটা মেঝেতে রেখে ওপরকার ডিপ ফ্রিজারের দরজা খুলতেই দেখতে পায় ভেতরটা পুরোপুরিই ফাঁকা। দুটো থাকের মাঝখানে বাটা রশুনের বাটিটা আছে মাত্র। এখনো সামান্য পরিমাণ রশুন লেগে আছে বাটির প্রান্তে। তাহলে কি সব শেষ হয়ে গেলেও কিছু জানায় নি বা সব কিছু শেষ হবার পরই ছেলেরাও বের হয়েছিল কিনা বুঝতে পারে না মোস্তাক হোসেন।
যদিও আলেয়ার বোনেদের মুখ থেকে মাঝে মধ্যেই শোনা যেত তাদের বোন পাকা মুসুল্লি। পাঁচ অক্ত নামাজ পড়ে সব সময়। এমন কি তাহাজ্জুদও বাদ থাকে না। অথচ মোস্তাক হোসেনের চোখে কখনো পড়েনি আলেয়া কখনো পুরোপুরি নামাজ পড়েছে। অবশ্য গ্রামের বাড়িতে মেজ ভাইয়ের বউয়ের চেহলামেও তার কাজ-কারবার সন্তোষ জনক ছিল না। ছেলেরা প্রতিবাদ করতে চাইলে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে। বলেছে, চুপ থাক, নয়তো মার খাবি!

কিন্তু সব কাজেরই কোনো না কোনো সাক্ষী থেকে যায়। আলেয়ার কত অপকর্মের কথা মার খাওয়ার ভয়ে ছেলেরা হজম করতে বাধ্য হয়েছে তা কে বা বলতে পারে।

শূন্য ডিপ ফ্রিজে গোস্তের ব্যাগটা ঠেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে নিচের অংশটার দরজা খুলতেই একই অবস্থা দেখা যায়। হয়তো ছেলেরা এ ব্যাপারে কিছু জানতে পারে। সে নিজের হাতে বাজার করে না বেশ কয়েক বছর। তাই শূন্য ফ্রিজ দেখে সে ফের ঘর থেকে বের হয়ে আসে। রাস্তার মাঝ পথে আসতেই তার একবার মনে হয়েছিল ফিরে গিয়ে দেখে আসে কি কি নেই। কিন্তু গিয়েই বা কী হবে। সব কিছুই তো কিনতে হবে নতুন করে। কাঁচা বাজারও আনতে হবে। সেই সঙ্গে তেল নুন মশলা যা যা প্রয়োজন সবই।

ভাবতে ভাবতে সে বিমলের বাড়ির রাস্তায় উঠতেই ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠে। কিন্তু থেমে না গিয়ে ক্রমাগত বাজতেই থাকে। কিছুটা অবাক হয়ে ফোন বের করে সে দেখতে পায় রুবীর নাম্বার। ফোন ধরেই সে বলে, কি রে, কী এমন জরুরি কথা?

-মাছ কিনতে হবে না। আমি নিয়ে আসছি।

-মাছ কেনতে গেলি কেন? ফরমালিন দেওয়া পচা মাছ, কতদিন আগের কে জানে!

-আরে না, যে বাসে উঠেছি সে বাসের ছাদেই মাছ তুলেছে। পুকুরের অনেক বড় মাছ। একেকটা পাঁচ ছয় কেজি হবে।

-তুই তো তাহলে মুড়ির টিনে আসছিস। দুপুর পার হয়ে যাবে।

-হলে হবে। মুড়ির টিন সহজে এক্সিডেন্ট করে না। তুমি বাজারে যাও। সামনে আর তিনটা স্টেশনে বাস থামবে। রাখি।

মোস্তাক হোসেন হতবিহবল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কী মাছ তা তো জানা হলো না। মাছের নাম জানা হলে বাজারে গিয়ে তরি তরকারি কিনতে অসুবিধা হতো না। আবার ফোন করে জেনে নেয়া যেতে পারে কী মাছ। থাক। যে মাছই হোক। আনাজপাতি তার নিজের মনোমতো নিয়ে নেবে। সব কিছুতেই পারফেক্ট হতে হবে এমন কোনো কথা নেই।

যাত্রী শূন্য একটি চলতি রিকশাকে হাত দেখাতেই সেটা তার পাশে এসে থেমে পড়লে মোস্তাক হোসেন তাতে চড়ে বসে জানায় বড় বাজার চল।

শীত নামতে খুব বেশি বাকি নেই। এখন কোন ধরনের সবজী পাওয়া যেতে পারে তা নিয়ে চলতি রিকশায় বসে ভাবছিল মোস্তাক হোসেন। শীতের আগাম কিছু কিছু সবজি পাওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া আজকাল বারোমাসই লাউ কুমড়া বেগুন আর টমেটো পাওয়া যায়। আলু তো আছেই। বাজারে ঢুকবার মুখেই রাস্তার পাশে বসে থাকা এক বিক্রেতার ঝাঁকার দিকে চোখ আটকে যায় তার। বেশ কিছু পাকা কাগজী লেবু নিয়ে বসে আছে লোকটা। সিরকায় চুবিয়ে রাখলে অনেকদিন ঘরে রাখা যায়। আর স্বাদের দিক দিয়েও অনেকটা ভিন্ন হয়ে ওঠে। রিকশায় বসেই সে দর জানতে চায়- লেবুর হালি কত?

লেবুর দামের কথা শুনতেই হয়তো রিকশা থামায় লোকটা।

-আট ট্যাকা!

-দাম তো অনেক বেশি।

বলেই, মোস্তাক হোসেন রিকশাওয়ালাকে বলে, আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও।

-বাজারের ভিতরে যাইতেন না?

-যদি দেরি হয়?

-হইলে কত আর দেরি করবেন। দরদাম কইরা লন!

মোস্তাক হোসেন রিকশা থেকে নেমে ঝাঁকা থেকে একটি লেবু তুলে নিয়ে নাকের সামনে নিয়ে ঘ্রাণ নেয়। তারপর লোকটিকে জিজ্ঞেস করে, লেবু কতগুলা হবে?

-সাতাইশ হালি আনছিলাম। পনের হালি ব্যাচা হইছে!

মোস্তাক হোসেন মনেমনে হিসেব কষে বলে, তার মানে বার হালি আছে এখন। চার বার আটচল্লিশটা। সবগুলো কত টাকায় নিতে পারবো?

-ইমানে যদি কই, বলে লোকটা হেসে উঠল। এতক্ষণ ছয় ট্যাকা হালি বেচছি। আপনে যদি সব কয়ডা নেন, পাঁচ ট্যাকা কম দিয়েন।

মোস্তাক হোসেন মনে মনে হিসেব কষে আবার। বলে সবগুলা পঞ্চাশ টাকা দেই।

-আপনে তো পাঁচ ট্যাকারও কম দর কইলেন!

-আরো পাঁচ টাকা দেই। পঞ্চান্ন টাকা।

-লন!

সবগুলো লেবু নিয়ে দাম পরিশোধ করে রিকশায় উঠতেই, রিকশাওয়ালা লোকটি বলল, এত লেমু দিয়া কি করবেন, হোটেলে সাপ্লাই দেন নিকি?
-নাহ। সিরকায় চুবিয়ে রাখলে অনেকদিন খাওয়া যায়।

লোকটি হয়তো তার জবাব পেয়ে গেছে। প্যাডেলে চাপ দিয়ে বাজারের ভেতরের দিকে রিকশা নিয়ে আগাতে থাকে চুপচাপ।




ঘরে আসবার পর অল্প কিছুক্ষণ নিজেদের স্বভাব ভুলেছিল রুবীর ছেলেমেয়েরা। কুশল বার্তা বিনিময়ের পরই যেন তারা যার যার খোলস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল সবাই। প্রথমেই রুবী উঠে এসে ফ্রিজ খুলে দেখল ওপর নিচ। আর সঙ্গে সঙ্গেই যেন তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপরই সে ফিরে গিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে একটি ছোট টিফিনের বাটি বের করে এগিয়ে দিল মোস্তাক হোসেনের দিকে।

বাটিটা হাতে নিতে নিতে সে জিজ্ঞেস করল, কী আছে এতে?

রুবী যতবারই এসেছে প্রতিবারই একটা না একটা মিষ্টি খাবার নিয়ে এসেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। বাটি খুলতেই মোস্তাক হোসেন দেখতে পায় থকথকে গাজরের হালুয়া। চকচকে চোখে সেটা শুঁকে খাঁটি ঘিয়ের গন্ধে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, একেবারে খাঁটি ঘি?

-দুধের সর জমিয়ে ঘরেই বানিয়েছিলাম খানিকটা।

-তোরা খেয়েছিস?

মোস্তাক হোসেনের কথা শুনে হেসে ওঠে রুবী। বলে, আমরা খেয়ে অতটুকু বাঁচল বলেই তোমার জন্য নিয়ে এলাম।

হাতের আঙুলের মাথায় নিয়ে বাটি থেকেই গাজরের হালুয়া তুলে মুখে দিতে দিতে বলল মোস্তাক হোসেন, আর কিছু না হোক তোর হাতের তৈরি যে কোনো খাবারই চমৎকার হয়!

-অথচ দেখ, আমাকে করতে হয় চাকরি। তাও আবার কেরানির!

যেন মোস্তাক হোসেনের বাকি কথাগুলোই উচ্চারণ করে রুবী।

-না। চাকরির সঙ্গে এর কী সম্পর্ক? আলেয়ার ডাল, মুরগি বা মাছের তরকারির স্বাদ একই হতো। সে তো চাকরি করতো না।

-একটা দিনও চাকরি করতে ইচ্ছে হয় না আমার। কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেল না, থেকে যাই বাকি জীবন।

-আজকের দিনটার জন্যেই বলেছি যে, বিকেলে বাসে তুলে দিয়ে আসবো। আগের কোনদিনগুলোতে বলেছিলাম চলে যা?

-আমি কিচেনে যাচ্ছি। যা দেখলাম একটু খানি ডাস্টবিনের চেয়েও খারাপ অবস্থা।

রুবী কিচেনের দিকে চলে যেতেই তার বড় মেয়ে সীমা হাতের ইশারায় জানতে চাইলো, কিছু। মোস্তাক হোসেন সেটা দেখে আঙুলের মাথায় লেগে থাকা হালুয়া চাটতে চাটতে বলল, আছে, আছে। ভালোটা এনেছি।

তখনই মেয়েটা চট করে এগিয়ে এসে মৃদু স্বরে জানতে চাইল, কই?

তারপর আয়! বলে, হালুয়ার খালি বাটি রেখে দিয়ে মোস্তাক হোসেন তার শোবার ঘরে ওয়ারড্রবের ওপর একটি প্যাকেট দেখিয়ে দেয় দরজা থেকে।

এক ছুটে গিয়ে প্যাকেটটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়েই ফিরে আসতে আসতে প্যাকেট খুলে জিনিসটা বের করে মডেল নাম্বার দেখে নিয়ে বলল, এটার তো অনেক দাম! কত নিল মামা? বছর খানেক আগে ছিল এক হাজার টাকা।

-ভালো জিনিস দাম তো বেশি হবেই! আর এটা দিয়ে তোর মাস্টার্স পর্যন্ত চলে যাবে।

মোস্তাক হোসেনের কথা শুনেই হয়তো সীমার মুখ কালো হয়ে যায়। বলে, আমার তো মাস্টার্স পর্যন্ত পড়া হবে না মামা?

-কেন হবে না শুনি?

-বাবা কদিন আগে মাকে বলছিল, ইন্টার শেষ হলেই বিয়ে। রেজাল্টের অপেক্ষায় থাকবে না। এখনই বাবা বিছানা থেকে নামতে পারে না। ততদিনে কী হয় আল্লাই জানে!

-বেশি বিপদে পড়লে পালিয়ে চলে আসিস। বাকিটা আমি দেখব।

হঠাৎ কিচেন থেকে রুবী গলা বাড়িয়ে বলল, মামু ভাগ্নিতে এত কী কুটুর মুটুর হচ্ছে। তেল কোথায় খুঁজে পাচ্ছি না তো!

মোস্তাক হোসেন না ফিরেই বলল, খুঁজে দেখ ভালো মতো।

-তেলের খালি বোতলও নেই।

-আচ্ছা যাচ্ছি এখনই।

-কোথায়?

মোস্তাক হোসেন ফিরে কিচেনের দিকে মুখ করে বলল, বাজারে।

-বাজারে যেতে হবে না। আসবার সময় সামনে একটা দোকান দেখেছি, সেখান থেকেই অল্প কিছুটা তেল নিয়ে এসো।

-আচ্ছা।

সীমা তখনই কিচেনের দরজায় গিয়ে বলল, আম্মু বলছিলাম না মেলায় যাব, এখন যেতে দিবা?

-রান্না হোক। দুপুরে খেয়ে যাবি।

-তখন তো যাবোই। এখন একটু ঘুরে আসি না!

-না। বাইরে অনেক রোদ এখন!

-বেশিক্ষণ ঘুরবো না। যাবো আর আসবো।

-আচ্ছা যা!

-লবণও লাগবে!

এটা কাকে উদ্দেশ্য করে বলা মোস্তাক হোসেন ঠিকই বুঝতে পারছে। সে সীমাকে বলল, তেলটা-নুনটা আগে নিয়ে আসি।
সীমার ছোট সীমান্ত বলে উঠল, আমিও যাবো।

একেবারে ছোট সিয়াম বলল, আমি যাবো না। তোমরা আমার জন্য একটা চরকি নিয়ে আসবা।

-টাকা দে!

বলে, সিয়ামের সামনে হাত বাড়ায় সীমা।

সে খানিকটা গম্ভীর কণ্ঠে বলে, তোমার টাকা থেকে আনবা।

-এখনই তুই এমন চালাক?

-আচ্ছা তোরা তৈরি হয়ে নে তোদের মতো। ছাতাটা সঙ্গে নিয়ে নিস।

-ছাতা আমার ভালো লাগে না। বাড়তি একটা ঝামেলা!

সীমার নাকি প্রতিবাদ শুনে খানিকটা হাসে মোস্তাক হোসেন। কিন্তু কিছু না বলে বাইরে বের হতে হতে বলল, দরজাটা লাগিয়ে দিস।



হয়তো রোদের প্রাবল্য হেতু মেলায় লোকজনের সমাগম কম। তবে কম বয়সের ছেলে মেয়ে অনেক আছে নানা দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিছু ছেলেমেয়ের পরনে স্কুলের পোশাকও আছে। হয়তো স্কুল ফাঁকি দিয়ে এসেছে নয়তো অবেলায় ছুটি হয়ে যাওয়াতে সুযোগ পেয়ে চলে এসেছে।

সীমা বলল, মামা, নাগরদোলায় চড়বো।

মোস্তাক হোসেন কাঠের সেকেলে নাগরদোলার দিকে তাকিয়ে বলল, পার্কের ইলেকট্রিক নাগর দোলায় চড়িস নাই কখনো?

-ওগুলো তো এগুলোর মতন অত জোরে ঘোরে না!

-তাহলে চরকি, রোলার কোস্টার এসবে চড়তে পারতি।

-আমার পছন্দ না। মাথা ঘোরে।

-রোলার কোস্টারে উঠবার শখ অনেক দিনের। কিন্তু আমার শুধুই মনে হয় দম বন্ধ হয়ে বুঝি মারা যাবো।

কথা শুনে সীমা হাসে। হয়তো সে কথার সূত্র ধরেই বলে, তোমার চেয়ে আরো বেশি বয়সের মানুষদেরও চড়তে দেখেছি।

-তুই উঠেছিলি?

-বললাম না মাথা ঘোরে!

-না উঠলে কেমন করে বুঝলি যে, মাথা ঘোরে।

-দেখলেই অমন মনে হয়। ভয় চলে আসে।

-তুইও ভয় পাস?

-আমার ভয়টা তোমার মতন না।

-তোর ভয়টা কেমন?

মোস্তাক হোসেন মিটমিট করে হাসতে থাকে।

-আমার মনে হয় চলতে চলতে ওটা যদি ছিটকে পড়ে। চাকাগুলো খসে যায়? একটা ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হলেই মানুষের কী বিপদ হয়ে যায়, আর অতটা উঁচু থেকে পড়লে...! উফ, ভাবতে পারি না।

-তাতে কি? না হয় মরেই গেলি। একদিন তো মরতেই হবে।

-সে জন্য না।

-তাহলে?

-মারা গেলে তো গেলামই। সমস্যাও মিটে গেল। যদি হাত-পা ভেঙে ল্যাংড়া-লুলা হয়ে বা কোমায় পড়ে থাকি? আমার তো সুচিকিৎসা হবে না। বাবা কাজ করে না। আম্মুর একার আয়ে এমনিতেই আমাদের সব খরচ মেটে না। কী করে বেঁচে থাকা আবার চিকিৎসা চলবে?

-হুম, তোর ভাবনাটা ভালো। মাকে খুব ভালবাসিস না?

-আমার কাছে আম্মুই সব কিছু।

-বাবাকে পছন্দ না?

-বাবাকেও পছন্দ করি। কিন্তু কাজকর্ম করতে পারে না যে। বিছানায় শুয়ে শুয়েই বাকি জীবন পার করতে হবে বাবাকে।

-তোদেরও তো ভালোবাসে লোকটা।

-তা ঠিক। কিন্তু বন্ধুদের কাছে লজ্জা পেতে হয়। আত্মীয়দের অনেকে খারাপ খারাপ কথাও বলে মাকে নিয়ে। কেউ কেউ আবার আমার চেহারা তোমার চেহারায় মিল খুঁজে পেয়ে আরো বিশ্রী কথা বলে।

-এটা ঠিক যে, আমার চেহারার সঙ্গে অনেকটা মিল আছে তোর। কিন্তু আমি ভাবি এ নিয়ে তোর কোনো জিজ্ঞাসা বা কষ্ট আছে কি না।

-না। সত্যটা তো আমি বুঝি।

-কী সেই সত্য?

-মায়ের যখন বিয়ে হয় তখন তুমি দেশে ছিলা না। এ ছাড়াও আরও অনেক ব্যাপার আছে, যা থেকে আমি নিশ্চিত যে, তুমি আমার জন্মদাতা নও।

-আরেকটা কাজ করা যেত, ডিএনএ টেস্ট। অবশ্য খরচটা আমিই দিতাম। তবু চেষ্টা করতাম জন্ম নিয়ে যেন তোর মনে কোনো হীনম্মন্যতা কাজ না করে।

-না। এসব না। তবে এটাই ভেবে পাই না লোকজন তোমাদের নিয়ে কেন গল্প বানায়?

-এটা হলো একটা সামাজিক অবস্থা। কোনো একটা ব্যাপার যখন অবশ্যম্ভাবী তখন তা লোকের মুখে ফিরতে থাকে অনেক আগে থেকেই। যেমন আমাদের দেশ যখন যুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছিল, তার অনেক আগে থেকেই, সেই সাতচল্লিশের পরপরই মানুষের ভেতর জানা হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে পারবে না। আস্তে ধীরে তা বিশ্বাসে পরিণত হলো। পরিণামে যুদ্ধ।

-তাহলে তোমার আর আম্মুর ব্যাপারটাও এমন কিছুর দিকে যাচ্ছে?

-হুম। আমার তাই মনে হচ্ছে। মানুষের মুখে মুখে গল্প। আমাকে বা তোর মাকে নিজেদের মানুষের কাছে হেনস্থা হওয়া। আত্মীয়-পরিজনের নানা রকম জিজ্ঞাসার জবাব দিতে দিতে মনের ভেতর এই বিশ্বাসটাই পাকা হয়ে বসে যাওয়া যে, কথা তো শুনতেই হচ্ছে। তাহলে পাকাপাকিই শুনি। এ থেকে একটা অঘটন বা নতুন ঘটনার ভেতর দিয়ে কিছুটা সময় আমাদের পাড়ি দিতে হতে পারে।

-ফলাফল কী?

-কিছুই না। মানুষ কিছুদিন আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবে। তারপর আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আচ্ছা বাদ দে ওসব। সব কথায় গুরুত্ব দিতে হয় না।

তারপরই মোস্তাক হোসেন বলে উঠল, আচ্ছা তোর একটা ভাই না আমাদের সঙ্গে এসেছিল?

-হ্যাঁ, সীমান্ত!

সীমার মুখটা কেমন ব্যথিত হয়ে উঠল। তাকে তো আশপাশে দেখছি না।

-তাহলে চল, আগে খুঁজে দেখি।

-কোথায় খুঁজবো?

-মেলার বাউন্ডারির ভেতরেই আছে। তার আগে দেখি কোথায় কোথায় অদ্ভুত ব্যাপার মানে ম্যাজিক, সার্কাস, জুয়া, পপকর্ণ ভাজা, হাওয়াই মিঠাই তৈরি হচ্ছে বের করি।

মেলার জায়গাটার দিকে এগোতে এগোতে সীমার সঙ্গে কথা বললেও মোস্তাক হোসেন চোখ রেখেছিল সীমান্তের ওপর। মেলার মেইন গেট পার হয়েই সে ছুটে গিয়েছিল যেখানে হাওয়াই মিঠাই বানাচ্ছে। তারপর যেখানে অনেক ছেলেমেয়ে যাদু যাদু লেখা একটি ব্যানারের চারপাশে জটলা পাকিয়ে গোল একটা দেয়াল তুলে রেখেছে, সেদিকে গেলেও সেখান থেকে তাকে বের হতে দেখা যায়নি।

যাদুর জটলাটার দিকে যেতেই হঠাৎ উঁকি মেরে মোস্তাক হোসেন দেখতে পায় মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে সীমান্ত। সে চাচ্ছিল ভাইকে সীমা নিজেই আবিষ্কার করুক। তাই সে বলল, আয় কী যাদু দেখাচ্ছে দেখে যাই।

-কিন্তু সীমান্ত?

-ও নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। আমাদের খুঁজে না পেলে নিজেই বাসায় চলে যাবে।

-না চিনলে যদি হারিয়ে যায়?

-তাহলে এখানেই আগে খুঁজি।

ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েদের মাথার ওপর দিয়ে উঁকি দিতেই সীমা প্রায় লাফিয়ে উঠে বলে, ওই তো সীমান্ত!

যাদু দেখানো লোকটি তখন দু হাতে দুটো চোঙ তুলে ধরে সবাইকে দেখিয়ে বলছিল, দেখেন ভিতরে কিছুই নাই। সবটাই ফাঁকা। এমন জাগায় কবুতর আসবে ক্যামন কইরা? সেইটার নামই যাদু!

এমন একটা বিষয় দেখে সীমাও যেন বেশ কৌতূহলী হয়ে বিষয়টার ভেতর তখনই যেন ডুবে গেল সে। ছোট ভাইয়ের কথাটা হয়তো মনেই ছিল না আর।




কিছু কিছু অপ্রাপ্তির কষ্ট থাকা ভালো। এতে করে নিজের প্রতি মনোযোগ আর মমতা বাড়ে। মোস্তাক হোসেনের মনে কোনো দুঃখ নেই তা যেমন পুরোপুরিই সত্য নয়, সুখের নাগাল কখনো পায় না তাও পুরোপুরি ভুল। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই মানুষ তার আশপাশের যাবতীয় কিছুর বিচার করে। কিন্তু সে বিচারই সবকিছু নয়। এই যে রুবীর পুরো জীবনের আক্ষেপ, মোস্তাক হোসেনের নির্বিকার দাসত্ব তার কোনোটাই চিরস্থায়ী নয়।

যদিও কখনো রুবীর জীবনের আক্ষেপ ঘুচে যায় তাতে সে কতটা সুখী হবে বলা মুশকিল। এই যে দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর পরস্পর মুখোমুখি বসে আছে, পাশের ঘরে ছেলেমেয়েরা কিছু একটা নিয়ে হুটোপুটি আর হাসি তামাশা করছে, তার সব কিছু ছাপিয়ে যেন মোস্তাক হোসেনের ভাবনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নিজের দু সন্তানের অদর্শনের কষ্টটুকু। যে কষ্টের তুলনায় রুবীর জীবনে তেমন কোনো কষ্টই নেই। যদিও দুটো বোধ ব্যক্তি ভেদে দু রকমের, তবু তার মাঝে যেন মোটা দাগে একটি স্থায়ী উঁচু নিচু প্রভেদ টানা আছে।

মোস্তাক হোসেনের বুকে একটি লালচে দাগের ওপর তর্জনী রেখে রুবী বলল, এটা কিসের কামড়?

তারপর হাতটা সরিয়ে নেবার সময় বাকি আঙুল আর হাতের চেটো নামিয়ে আনে সেখানটায়।

ব্যাপারটা লোভের হাতছানি দিলেও মোস্তাক হোসেন মাথার নিচে বালিশের ওপর রাখা হাত দুটো বের করে আনতে উৎসাহ বোধ করে না। বলে, হবে কিছু একটা। শরীরের এদিক ওদিক কত রক্তের ধারা শুকিয়ে কালচে হয়ে থাকে তা টের পাই না।

এবার বিছানার ওপর দু পা তুলে হাঁটু মুড়ে বসে রুবী আরো ঘনিষ্ঠ হয় মোস্তাক হোসেনের। তারপর একটি হাত তার মাথার নিচ থেকে টেনে নিয়ে মুঠোতে চেপে ধরে বলল, তুমি কবে যাবা বল।

-কবে যাই তা কি করে বলি? কয়েক মাসের ভেতর ছুটিও পাবো না। অফিসে অনেক ঝামেলা চলছে। তা ছাড়া তোদের ওখানে গেলে তো তো তোদেরই অশান্তি বাড়বে। তোর মহারাজা আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে চোখা চোখা কথা বলবে।

-শান্তি কি আমার জীবনে আগেই ছিল? এখন অশান্তি হলে কতটুকুই বা হবে? ওসব নিয়ে আমি কিছুই ভাবি না আজকাল।

-আচ্ছা দেখা যাক। আস্তে ধীরে তুই তৈরি হয়ে নে। ঘরে তো আবার তোর রুগী ফেলে এসেছিস।

হেসে উঠে রুবী বলল, রুগী তো আমরা সবাই। শুধু রোগ আর চিকিৎসা আলাদা।

-বেশি দেরি হয়ে গেলে আবার ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে। রিকশা-টিকশা কিছুই পাবি না পরে।

রুবী হঠাৎ কাত হয়ে মোস্তাক হোসেনের বুকে মাথা রেখে দুপাশ আঁকড়ে ধরে বলল, আজকে থাকি না। তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছ কেন?

-কাল তোর অফিস আছে। বাচ্চাদের স্কুল আছে। ঘরে অসুস্থ মানুষ আছে।

রুবী মাথা না তুলেই বলল, কালকে পরশু ছুটি নিয়েছি। বাচ্চাদের স্কুলও সপ্তাহ খানেক বন্ধ। ঘরে ওদের দাদি আছেন। আস্তে ধীরে সবই পারে লোকটা। শুধু আমার দরকারে তার জান চলে না।

রুবীর কথা শুনে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় মোস্তাক হোসেন। বুকের ওপর রুবীর কান আর গালের স্পর্শ পাচ্ছিল বলে মনের ভেতরটা বেশ উসখুস করছিল তার পিঠে অথবা ঘাড়ে একটি হাত রাখবার বাসনায়। তবু সে আরেকটি হাত মাথার নিচ থেকে বের করে না। আলগা করে না রুবীর মুঠো থেকে বাকি হাতটিও। নিজেকে নিষ্কাম সাধক বা অতি ভালো মানুষ হিসেবে তুলে ধরবার ইচ্ছে নেই তার। ওঘরে বাচ্চারা আছে। ব্যাপারটা চোখে পড়লে তাদের মনে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। যার দায় বাকি জীবন হয়তো তাদের দুজনকেই বয়ে বেড়াতে হবে। কী দরকার একটু সংযমের অভাবে দশটা দিকের বাকি ন'টা দিক হারানোর? সব দিক যাতে রক্ষা হয় তার জন্যে খানিকটা কষ্ট মেনে নিলে কী এমন ক্ষতি। যেখানে পুরোটা জীবনই ক্ষতিগ্রস্ত, সামান্য ক্ষতির প্রভাব অতটা বড় হবে না।
আম্মু! আম্মু!

সীমার উত্তেজিত ডাক শুনে চট করে উঠে বসে রুবী। বিছানা থেকে ত্রস্ত পায়ে নেমে গিয়ে ছুটে যায় পাশের রুমে। মোস্তাক হোসেনও শুয়ে থাকতে পারে না।
রুবী সীমান্তের একটি হাত চেপে ধরে রেখেছে। দুজনের হাতেই রক্ত লেগে আছে। ফোঁটায় ফোঁটায় মেঝেতেও গড়িয়ে পড়ছে।

-কী করে হলো?

বলতে বলতে মোস্তাক হোসেন আলমারি খুলে তুলো আর কার্বলিক এসিড বের করে।

সীমা একটি পুরোনো কনডেন্সড মিল্কের মরচে ধরা কৌটা দেখিয়ে বলল, এটা দিয়ে কেটেছে।

আলেয়া হাড়ি-বাসন মাজার সময় এটাতে ছাই রাখতো।

তুলোতে কার্বলিক এসিড লাগিয়ে কাটা জায়গা পরিষ্কার করতে করতে মোস্তাক হোসেন জিজ্ঞেস করে, টিটেনাস ইনজেকশন আগে নিয়েছিল?

রুবী মুখ বাঁকিয়ে বলে, কীসের টিটেনাস আবার! এমন কাটাকুটি তো মাসের ভেতর কয়েকবারই হয়।

-হাসপাতাল বা ফার্মেসিতে যায় না?

-না।
পাশ থেকে ঝলমলে কণ্ঠে সীমা জানায়, বাবা কী সব লতাপাতা দিয়ে বেঁধে দেয়, এক রাতেই ঠিক হয়ে যায়!

মন থেকে সায় পায় না মোস্তাক হোসেন। আমতা আমতা করে বলে, পুরোনো জং ধরা টিন। কি থেকে কি হয়ে যায় আবার! আমার ভালো লাগছে না। চল!
বলে, মোস্তাক হোসেন উঠে পড়ে প্যান্ট-সার্ট পরে নেয়।

রুবী বলল, অত ঝামেলার দরকার নাই। এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে!

রুবীর কথায় কান দেয়া জরুরি মনে করে না মোস্তাক হোসেন। সীমান্তের একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে বলল, চলো তো বেটা!

তারপর সীমাকে বলল, তুই চল!

বাইরে এসে একটি খালি রিকশাকে ডেকে থামায় সে। সীমান্তকে নিয়ে উঠে বসতেই দেখা যায় সীমাও বের হয়ে আসছে। দরজায় প্রশান্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে রুবী।



রাতের বেলা ভীষণ জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে কেঁদে ওঠে সীমান্ত। ঘাবড়ে গিয়ে রুবী বলে ওঠে, ব্যাপারটা কি খারাপের দিকেই গেল? আশপাশে এমন ডাক্তার নাই যে খবর পেলেই চলে আসবে?

মোস্তাক হোসেন বলল, তুই চুপচাপ শুয়ে থাক। ভয় পাওয়ার মতো কিছু ঘটে নাই। এমনটা হলে কি করতে হবে ডাক্তার বলেছে আমাকে।

-কি বলেছে ডাক্তার?

বলতে বলতে উদ্বিগ্ন রুবী মোস্তাক হোসেনের বাহু আঁকড়ে ধরে।

রুবীর হাতে চাপ দিয়ে হয়তো আশ্বস্ত করতেই মোস্তাক হোসেন বলল, তেমন কিছু না। জ্বরটা বাড়লে প্যারাসিটামল আর সম্ভব হলে শরীরটা ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিতে বলেছে।

-আমি তো এত কিছু বুঝি না। তুমি একটু বস না, প্লিজ!

-আমি তো আছিই। তুই বরং ঘুমিয়ে পড়।

প্যারাসিটামল বা শরীর মুছিয়ে দেবার ফলে খুব দ্রুতই জ্বর নেমে যায় সীমান্তের। ওদিকে অল্প কিছুক্ষণের ভেতরই শুনতে পাওয়া যায় রুবীর মৃদু নাসিকা ধ্বনি।
কিছুক্ষণ পরপর জ্বর মেপে নিশ্চিত হয়ে নেয় মোস্তাক হোসেন যে, জ্বর এক ডিগ্রিও নেই। তখনই সে একটি চেয়ারে বসে পা দুটো মেলে দেয় মেঝের ওপর।
ঘুমন্ত রুবীর অসুখী মুখের দিকে তাকিয়ে মোস্তাক হোসেনের ইচ্ছে হয় ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু চুরি করে এটা করতে চায় না সে। তা ছাড়া এমনিতেই সে মুখিয়ে আছে দীর্ঘ দিন ধরে। হয়তো মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়েই আছে। সে নিজে এক ইঞ্চি আগালে রুবী আগাবে দশ ইঞ্চি। যেটা খুব স্বাভাবিক আর স্বেচ্ছায় ঘটবার সম্ভাবনা বেশি, সেখানে চুরি করে চেখে দেখবার মাঝে কোনো স্বস্তি বা সুখ নেই।

মোস্তাক হোসেন উঠে গিয়ে সীমান্তের কপালে হাত রাখে। না, জ্বরের লেশমাত্র নেই। অঘোরে ঘুমুচ্ছে ছেলেটা। মুখটা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। রুবীরও এ স্বভাবটা আছে। ঘুমুলে ঠোঁট দুটো ঈষৎ ফাঁক হয়ে থাকে। দু একটা মশা ওড়াওড়ি করছে তাদের মুখের চারপাশে। আশা করা যায় ছেলেটার বিপদ কেটে গেছে পুরোপুরি। বাকিটা সকালের আগে বোঝা যাবে না হয়তো।

পাশের ঘর থেকে সীমার কথার শব্দ ভেসে আসছে কিছুক্ষণ পরপর। হয়তো ঘুমের ভেতরই কথা বলছে। জেগে থাকলে ভাইয়ের অবস্থা দেখতে একবার হলেও আসতো হয়তো। ওদের ভাই বোন দুটোকে মশা জ্বালাচ্ছে কিনা বা মশারী টানানো হয়েছে কি না তা দেখার প্রয়োজন মনে করলেও সেদিকে যেতে সাহস হয় না তার। অতটা নির্ভেজাল মনের পুরুষ বলে নিজেকে মনে করতে পারে না সে। তা ছাড়া মেয়েরা যে ঘরে ঘুমিয়ে থাকে, সেখানে পুরুষ মানুষের উঁকিঝুঁকি না দেয়াটাই উচিত বলে মনে করে। হঠাৎ খাটের ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে দৃষ্টি ফেরায় মোস্তাক হোসেন। রুবী এতক্ষণ কাত হয়ে ঘুমাচ্ছিল। এখন চিত হয়েছে। কিন্তু চিত হয়ে শোবার ফলে রুবীর বুকের আঁচল সরে গিয়ে ব্লাউজে ঢাকা বুক উন্মুক্ত হয়ে গেছে। সেদিকে কিছুক্ষণ বুভুক্ষুর মতো তাকিয়ে থাকলেও নিজেকে একটি সীমায় আটকে রাখে। কিছুক্ষণ পরপর সেদিকে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে বলে, খানিকটা ঝুঁকে পড়ে আঁচলটা টেনে বুকটা ঢেকে দিতেই রুবী বলে উঠল, সাহসে কুলালো না আর?

মোস্তাক হোসেন হেসে ওঠে। তুই ঘুমাস নাই?

-ঘুম কি হয়? আলাদা একটা দুর্ভাবনা থাকলে ঘুমানো কঠিন!
বলতে বলতে উঠে বসে রুবী।

-আচ্ছা, তাহলে এবার তোর ছেলেকে তুই পাহারা দে, আমি শুয়ে পড়ি!

-এসো।

বলে, মোস্তাক হোসেনের হাত ধরে টানে রুবী। তারপর পাশে বসিয়ে দিয়ে বলে, শুয়ে পড়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।

মোস্তাক হোসেন না করতে পারে না। এমন অবস্থায় না করাটা তাকে অপমানের শামিল। তাই এক পাশে সোজাসুজি হয়ে শুয়ে পড়তেই মাথাটা টেনে নিজের ঊরুতে উঠিয়ে ফেলে রুবী।

চোখ বুজে শরীরটা শিথিল করে দিতে দিতে মোস্তাক হোসেন ভাবে যে, শেষ পর্যন্ত কতটা নির্বিকার থাকতে পারবে রুবী? তখনই চুলের ভেতর আলতো হাতের স্পর্শ অনুভব করে মোস্তাক হোসেন।

(সমাপ্ত)

*** গল্পটি অন্য কোথাও প্রকাশিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১২:৪৮
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×