শহীদ মতিউর এবং নবকুমার ইনস্টিটিউটঃ
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ মতিউর রহমানের স্কুল ঢাকার বকশি বাজারের নবকুমার ইনস্টিটিউশন। যদিও প্রায় ৯২ বছর আগে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তবু "মতিউরের স্কুল" বলেই অনেকের নিকট এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি পরিচিত। মতিউরের স্মৃতি নিয়েই স্কুলটি আজও দাঁড়িয়ে আছে। এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা "নবকুমার" স্কুলের পরিচয় দেয়ার চেয়ে "মতিউর" এর স্কুল বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। জানা যায়, ১৯১৬ সালে বর্তমান বদরুন্নেসা কলেজের জায়গায় নবকুমার ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওটিই ছিল স্কুলের মূল ভিত্তি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ইডেন কলেজের শাখা খোলার প্রয়োজনে নবকুমার ইনস্টিটিউশন-এর জায়গা এবং ভবনাদি রিকুইজিশন করা হয়। পরবর্তীকালে ৫০-এর দশকে স্কুলটি ১৬ উমেশ দত্ত রোড, বকশি বাজারে স্থানান্তরিত করা হয়। সেই অবাধি নবকুমার ইনস্টিটিউটটি এখানেই অবস্থিত।
স্কুলটির জায়গা এবং সম্পত্তি জোর করে রিকুইজিশন করার ঘটনায় নবকুমার ইনস্টিটিউটি ঐ সময় বদরুন্নেসা কলেজের বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়। সেই মামলা এখনও চলছে। নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নাম নিয়ে অনেকে অনেক সময় দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। অনেকে খ্যাতিমান সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস "কপালকুন্ডলা"র নায়ক নবকুমারের নামানুসারে স্কুলটি নামকরণ করা হয়েছে বলে মনে করে। কিন্তু আসলে তা নয়। জমিদার এবং সমাজসেবী নবকুমারের নামানুসারে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জানা যায়, পাকিস্তান আমলে নবকুমার ইনস্টিটিউশনে বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে বাংলা কলেজ মীরপুরে স্থানান্তরিত হয় এবং সরকারী কলেজে রূপান্তরিত হয়।
শহীদ মতিউর সম্পর্কে জানা যায়, ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় সে এই স্কুলের দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র ছিল। সেই থেকে নবকুমার ইনস্টিটিউট প্রতিবছর ২৪ জানুয়ারী গণঅভ্যুত্থান দিবসে বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের মধ্যে দিয়ে শহীদ মতিউরকে স্মরণ করে। আজও স্কুলের দেয়ালে সাঁটানো রয়েছে মতিউরের কয়েকটি পোট্রেট। মতিউরের মৃত্যুর ৩৮ বছর পরেও তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আজহার উদ্দিন মল্লিক প্রায়শই এ স্কুলটিতে আসেন। খুঁজে ফিরেন তার অকালপ্রয়াণ সন্তানের স্মৃতি। জানা যায়, স্কুলটিতে এসে তিনি মতিউর যে ক্লাশে বসে ক্লাস করতেন সেখানেও মাঝে মাঝে যান। এছাড়া মতিউরের বাবা যখনই স্কুলটিতে আসেন তখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। স্কুলের শিক্ষকরা জানান, শোকে কাতর মতিউরের বাবা অসহায়ভাবে এবং আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে জীবন-যাপন করছেন।
১৯৭৩ সালে নবকুমার ইনস্টিটিউটের কলেজ শাখা খোলা হয়। যা বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদিত ড. শহীদুল্লাহ কলেজ নামে পরিচিত। দুটি প্রতিষ্ঠানই একই গভর্নিং বডির দ্বারা পরিচালিত হয়।
লেখাপড়ায় নবকুমার ইনস্টিটিউশন অতীতে খুব উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। ৮০'র দশক পর্যন্ত স্কুলটি এসএসসি পরীক্ষায় বরাবরই ভালো ফলাফল করেছে। প্রাক্তন আইন বিচার ও সংসদগ বিষয়কমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ খান, যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শেখ ফজলুল হক মনি, সাবেকমন্ত্রী মরহুম মশিউর রহমান যাদু মিয়া, এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) সদরুদ্দীন, সাবেক সচিব শামসুর রহমান, ডেসার সাবেক চেয়ারম্যান মুয়িদ হোসেন, খ্যাতিমান সঙ্গীতশিল্পী নিয়াজ মোহাম্মদ, নীলু বিল্লাহ, টিভি প্রযোজক রিয়াজ উদ্দীন বাদশাহ, অলিম্পিক এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বশির আহমদ প্রমুখ এই বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও স্কুলটি রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ফুটবল এবং ক্রিকেটে জাতীয় পর্যায়ে অনেকে খেলেছেন যারা এ স্কুলের ছাত্র। ফুটবলে খেলেছেন মালা, ইউসুফ, বড় নাজির, ছোট নাজির, ক্রিকেটে জাভেদ ওমর, পোল ভল্টে মিরাজ উদ্দীন। স্বাধীনতার পর আন্তঃস্কুল ফুটবলে নবকুমার ইনস্টিটিউশন কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
শুরু থেকে নবকুমার ইনস্টিটিউশনে কত ছাত্র ছিল তা জানা যায়নি। তবে বর্তমানে শিশুশ্রেণী থেকে ডিগ্রী পর্যন্ত ছাত্রের সংখ্যা ১৭ শত। ৩৫ শতাংশ জমির উপর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে চারতলা এবং ছয়তলা দুটি ভবন। মোট শিক্ষক সংখ্যা ৬৫। স্কুলটি খুব অল্প জায়গায় হওয়ায় এখানে নেই কোন খেলার মাঠ। স্কুলটিতে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় পাশের হার ৭০ শতাংশ। অতীতে এখান থেকে প্রায় প্রতিবছরই দু'একজন ছাত্র মেধা তালিকায় থাকতো।
নবকুমার ইনস্টিটিউশনের প্রিন্সিপাল চৌধুরী সাহিদ হোসেন স্কুলটি সম্পর্কে বলেন, আগে স্কুল ছিল কম। এখন বেশী স্কুল হওয়াতে আশানুরূপ মেধাবী ছাত্র পাওয়া যায় না। এছাড়া এ অঞ্চলের অভিভাবকরা সেভাবে সচেতন নয়। অধিকাংশই নিম্নবিত্ত অভিভাবকদের ছেলেরা এখানে পড়াশুনা করে। অভিভাবকদের ডাকলেও সাড়া দেয় না। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে স্কুলটি অতীতের চেয়ে ভালো ফলাফল করছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:২২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



