"সই" বন্ধুত্বের আদি এক নাম
কালক্রমে বাঙ্গালী সমাজে বিভিন্ন ঐতিহ্যগত বিষয় পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মধ্যকার সম্পর্কেরও পরিবর্তন হচ্ছে। ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী স্যারের একটা প্রবন্ধে পড়েছিলাম-বাঙ্গালী সমাজে কিছু ঐতিহ্যগত সম্পর্কের মধ্যে "সই" পাতানো ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল একটি ব্যাপার। তখন গ্রামে মেয়েরা তেমন স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ পেতনা। নিজেকে শেয়ার করার জন্য তাই তারা কোন না কোনভাবে কারো সাথে "সই" পাতাতো। একটি মেয়ের জন্য সই ছিল খুবই জরুরী। কোন মেয়ের যদি সই না থাকত তবে তার মন-মানসিকতা ভাল থাকত না। শরের মেয়েরাও কিন্তু সই পাতানোয় পিছিয়েছিলনা। তবে শহরের মেয়েরা সইকে সই সম্বোধন নাকরে ফ্রেন্ড সম্বোধন করতো। এই সই/ ফ্রেন্ড পাতানোতে শুধু সই-এ সই কিম্বা ফ্রেন্ড-এ ফ্রেন্ড-এ এই সম্পর্ক হতো না। দুইটি পরিবারের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হতো। সাথে সাথে কিছু ঐতিহ্যগত নিয়ম-কানুনও পালন করা হতো। কে কার সই হবে সেটা নির্দিষ্ট করা ছিল খুবই কঠিন। চাইলেই যে কেউ কারো সই হতে পারত না, গ্রামে পারিবারিক অনুমতি নিয়ে সবাইকে জানিয়ে সই পাতানো হত। কিন্তু শহরে পাশাপাশি থাকার কারনে বা একসাথে পড়ার কারনেই কিম্বা এমনি এমনিই ফ্রেন্ড হয়ে যেত, হয়ে যায়! তবে তখনকার দিনে গ্রামের একটি মেয়ের ১০/১১ বছর হলেই যে একটি মেয়ের সই হতেই হবে এটি নিশ্চিত ছিল। সই-এ সই-এ এত ভাব হয় যে, নিজের বোনের সাথেও এতো ভাব হয় না। ঘটা করে এক সই'র বাড়িতে অন্য সই/ফ্রেন্ড তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে আসতো, থাকতো। সই-সহ পরিবারের সবাইকে মূল্যবান জিনিসপত্র উপহার দেয়া হতো। এক সই'র বাড়ি থেকে রান্না করে পিঠা, মিস্টি, চিড়া, বিশেষ বিশেষ খাবার পাঠানো হত। সই সইকে রেখে কোন বিশেষ কিছু খেতেই পারত না। সই'র বাড়িতে এসে বেড়ানো একটা রেওয়াজ ছিল।
পরিবারের সবাই তাকে বিশেষভাবে আদর-যত্ন করত। এক সই'র বিয়ে হলে এই বিয়ের অনুষ্ঠানে তার সই'ই থাকত সব। বাবা-মা তাদের সন্তানকে কোন মূল্যবান জিনিস উপহার দিলে তার সইকেও সেই জিনিসটি দিতে হত। মোট কথা, বাবা-মাও এ বিষয়ে জড়িত থাকেন খুব নিবিড় ভাবে। সামাজিক বন্ধন, রক্তের বন্ধন ছাড়াও এক নিবিড় সম্পর্ক হচ্ছে সই পাতানো। কিন্তু এখন আর সেই সই পাতানো লক্ষ্য করা যায় না। আমার স্ত্রীর স্কুল জীবন কেটেছে দর্শনায়। প্রায় ৩০/৩৫ বছর পুর্বে ওখানে তারও এমন সই ছিল। কিন্তু এখন সেই সইকে আর খুঁজে পাচ্ছেন না-তার জন্য এখনো তাঁকে হা-হুতাশ করতে দেখি!
এখন স্কুল, কলেজে গেলে স্রেফ বান্ধবী হয়-অনেক অনেক বান্ধবী হয়। সেই গ্রাম্য ঐতিহ্যগত সই পাতানো হয় না। আগে প্রায় সব গ্রামেই প্রতিটি ঘরে মেয়েদের মেয়েদের মধ্যে এরকম সই পাতানো হত। শহরে এখন প্রতিজন মানুষের অনেক অনেক ফ্রেন্ড থাকে। এইসব "ফ্রেন্ড"দের মধ্যে কি খুঁজে পাওয়া যায় সেই আদি বন্ধুত্বের 'সই'র স্বাদ! যে সইয়ের স্বাদ এখনো আমার "ইভানা বুজী" অন্তরে লালন করে প্রায় ৩৮ বছর পরেও সইয়ের ছোট ভাইকে একটু স্নেহের পরশ দিয়ে তাঁর সইয়ের সৃতিকে সজীব করতে ছুটে আসেন সুদুর লন্ডন থেকে!
(ডাক নাম ইভানা। ইভানা আমার প্রয়াত বুবুর "সই" ছিলেন। আমি তাঁকে ডাকতাম "বু্জী"। ১৯৫৬ সনে ওয়ারীর র্যংকিং স্ট্রীট এর বাড়ি ছেড়ে আমরা ধানমন্ডি চলে আসার পুর্ব পর্যন্ত দুই পরিবার পাশাপাশি থাকত-যখন আমার জন্মও হয়নি। বুবুর "সই" হিসেবে ইভানা বুজী এবং তাঁর পরিবারের অন্য সকলেই আমাদের পরিবারের একাত্মা বন্ধু ছিলেন, আপন জন ছিলেন। ঐ পরিবারের সকলেই আমাকে ছোটবেলায় খুব আদর করতেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বুজীর প্রতিবন্ধী বড় ভাইকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। বুজীর বাবা ঢাবি'র শিক্ষক ডঃ কামরুদ্দীন খাঁন বাড়িঘর বিক্রি করে স্বপরিবারে চলে যান ইংল্যান্ড। অকালে বুবু মারা যাবার পরেও বুজী'র পরিবার মাঝে মাঝেই আমাদের খোঁজ খবর নিতেন। ইভানা বুজীর প্রানপ্রিয় সই এর ছোট ভাই হিমু এখনো বেঁচে আছে-তাই সই এর ভাইকে একটু দেখার জন্য সুদুর ইংল্যান্ড থেকে মাত্র ২ দিনের জন্য তিনি হিমুদের বাড়ি এসেছিলেন! ইংল্যান্ডের ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন প্রফেসর ইভানা বুজির বয়স এখন প্রায় ষাট বছর। এতো বছর পরেও বর্তমান পঞ্চাশোর্ধ হিমুকে সেই ছোট্ট হিমুই ভেবে আছেন.....! বুজী'র সই এর প্রতি সই'র বন্ধুত্ব, ভালোবাসা কতইনা প্রবল-তা দেখেই এই লেখার পটভুমি)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২৪ ভোর ৬:৪৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




