somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ লালু (প্রথম অংশ)

২৮ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক

ওলিপুর গ্রাম ডিঙিয়ে আমতলা বাজার যাওয়ার পথে রাস্তার বা’দিকে যে কয়টি টিনের ছাপরা দেখা যায় তার একটির একচ্ছত্র অধিপতি লালু। আজ প্রায় ছয়মাস ধরে ঘরটাকে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দিচ্ছে সে। একটা নিম কাঠের সস্তা চৌকী, তেল চিটচিটে আঠালো বালিশ আর একটা ছেঁড়া কাঁথা ছাড়া পাহারা দেবার মত তেমন কিছুই নাই লালুর ঘরে। তবুও লালু ঘর ছেড়ে কোথাও যায় না। উত্তরের জানালাটা দিয়ে শির শির করে শীতের ঠান্ডা বাতাস এসে ঘরভর্তি মাকড়শার জালগুলোকে নাচিয়ে আধখোলা ভাঙা দরজাটা দিয়ে বেড়িয়ে যায়। লালু ছলছল চোখে জালগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ ছাপিয়ে দু’ এক ফোটা জলও গড়িয়ে পরে মাঝে মাঝে। মাকড়সার জালের অর্থহীন আন্দোলনে মাঠভরা ফসলের নাচন লালু খুঁজে পায় কিনা কে জানে?

বছর দুয়েক আগের কথা। রজব আলীর থেকে বর্গা নেয়া দু’বিঘার জমিটায় মাটি কাটছিল লালু। হাতির পা পিছলে পড়ার মতই সেদিন লালুর হাত পিছলে কোদালটা মুহূর্তের মধ্যেই বা পায়ের ইঞ্চিখানেক অংশ অধিকার করে নিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো। তৎক্ষণাৎ কিছু দূর্বা ঘাস চাবিয়ে পুরু করে পায়ে লাগিয়ে দিল লালু। কিছুক্ষণের মধ্যে রক্ত বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও যখন রক্ত বন্ধ না হয়ে উলটো রক্ত আর শুঁকনো মাটি মিলে বেশখানিকাটা কাদার তৈরী হলো তখন কাজ ছেড়ে অগ্যতা বাড়ির পথেই হাঁটতে হলো লালুকে।

বাড়িতে লালুর কেউ ছিল না। দুদিন আগে রুনুকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাপের বাড়ি রেখে এসেছে সে। লালুর ছেলের মা না হওয়া পর্যন্ত রুনু ফিরবে না। বাড়িতে ঢুকেই লালু কয়েকবার আহত স্বরে রুনু রুনু বলে ডাকলো বটে কিন্তু দরজার বড় তালাটা চোখে পড়তেই থেমে গেল সে। চুন আর ছেঁড়া লুঙ্গির ত্যানা পেঁচিয়ে নিজেই শক্ত করে বেঁধে ফেলল পা। তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আবার মাটি কাটতে চলে গেলো সে।

রাতে জ্বর এলো লালুর। বা পা টা ফুলে ঢোপ হয়ে গেছে। টিনটিন করে ব্যাথা করছে। কোদাল দিয়ে কাটলে নাকি টিটি দিতে হয়। না দিলে ধনুষ্টঙ্কার হয়। ইনজেকশনের সূচ দেখলেই গা শিরশির করে লালুর। ধনুষ্টংকারের ভয়ে ভীরু মনটা ইনজেকশনের দিকে ভোট দিতে চাইলেও অতীতের একটি ঘটনা ভোটটাকে নিমিষেই নিজের করে নেয়। এর আগেও একবার দা দিয়ে হাত কেটেছিল লালুর। বিনা চিকিৎসাতেই সেরে গেছে। কই ধনুষ্টংকার তো হয়নি লালুর!

পরদিন সকালেও ফোলা পা আর জ্বর নিয়ে কাজে গিয়েছিলো লালু। সারাদিন সুস্থ্য মানুষের মত কাজ করেছে। সন্ধ্যায় পায়ের ব্যথাটা টনটন করে ওঠায় মোড়ের মুদি দোকান থেকে ডাইক্লোফেন আর প্যারাসিটামল এনে গিলেছে। ম্যাজিকের মতন ব্যাথা ও জ্বর দুটোই কমে গেছে। দুদিনের মধ্যে পা ফোলাটাও কমে গেছে লালুর। ওষুধ গুলো যে এত কাজে দেয় জানা ছিল না লালুর। নিজেকে হঠাৎ গুণী ডাক্তার মনে হয় লালুর। মানুষ কেন যে এত টাকা খরচ ব্যথা সারাতে ডাক্তারের কাছে যায়! লালুর কাছে আসলেই পারে! লালুর এক বড়িতেই বাপবাপ করে ব্যথা পালিয়ে যাবে। এক’শ পারসেন্ট গ্যারান্টি!

পা কাটার খবরটা শেষ পর্যন্ত আর রানুকে জানায়নি লালু। কাটা যায়গাটায় চুন আর কাপড় বেঁধে প্রতিদিন কাজে যেত আর ফেরার পথে সেই ডাইক্লোফেন আর প্যারিসিটামল নিয়ে ঘরে ফিরতো সে। এভাবেই প্রায় দুইমাস কেটে গেল। এ দুইমাসের দীর্ঘ সময়ে ধনুষ্টংকার লালুর দেখা পায়না, কিন্তু পা টা কেমন হয়ে যায় লালুর। কাটা জায়গাটা জোড়া তো লাগেইনি উলটো হা করে থাকে। দগদগে ঘা হয়েছে চারপাশে। মাঝে মাঝে পুঁজের মত ঘীয়ে রঙয়ের কিছু তরল গড়িয়ে পড়ে। বিষয়টাকে এতদিন উপেক্ষা করলেও শেষপর্যন্ত বাল্য বন্ধু রাখুর শরণাপন্ন হয় সে। তারপর রাখুর সাথে সেদিনই হাসপাতালে যায় লালু।

ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যা বললেন তার সারমর্ম টা ভয়ানক! পায়ে ইনফেকশন হয়েছে লালুর। ইনফেকশনটা গুরুতরই মনে হচ্ছে ডাক্তারের কাছে। শহরে গিয়ে বড় ডাক্তার দেখাতে হবে। বড় ডাক্তার যদি মনে করেন পা টা কেটে ফেলতে হবে তবে জীবন বাঁচাতে লালুকে তাই করতে হবে। আরেকটি ভয়ানক সন্দেহের কথা বলেছেন ডাক্তার। ক্যান্সার! হ্যা, পায়ে ক্যান্সারও হতে পারে লালুর! ডাক্তারকে মনে মনে শত শত গালি দেয় লালু। শালাদের সব ধান্দাবাজী! লালু সুস্থ। কিচ্ছু হয়নি লালুর পায়ে!

হাসপাতালে ডাক্তারের গোষ্ঠী উদ্ধার করলেও বাড়িতে এসে সত্যি সত্যি মূষরে যায় লালু। জমিতে ধান লাগানোর কথা থাকলেও লালু ধান লাগাতে যায়না। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবে সে। সত্যিই কি পা টা কেটে ফেলতে হবে লালুর? পা ছাড়া তো জমিতে কাজ করতে পারবে না সে। তবে? সংসার চলবে কিসে? লালু-রানু না হয় খেয়ে না খেয়েই কাঁটিয়ে দিতে পারবে কিন্তু লালুর অনাগত ছেলেটা না খেয়ে থাকবে কেন? ক্যান্সার হয়ে যদি লালু মরেই যায় তবে ওর ছেলেটাকে মানুষ করবে কে?

পরদিন সকাল সকাল লালুর শালা এসে সুসংবাদটা দিয়ে যায়। ছেলে হয়েছে লালুর!
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×