আমার দুই বছরের ছেলে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে কথা বলা শুরু করল। আমাদের সবার খুশি হবার কথা কিন্তু খুশি হতে পারলাম না। কারন তার কথা আমরা কেউ বুঝতে পারছিলাম না। ছোট বাচ্চারা কথা বলার প্রথম দিকে, মানে ভাষা শেখার প্রথম দিকে আবোল তাবোল অনেক শব্দই উচ্চারন করে। কিন্তু না, তার অনবরত কথা বলার ধরন দেখে, কিছু কিছু শব্দের পুনরোচ্চারন দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল সে কোন না কোন ভাষা ব্যবহার করছে। কিন্তু আমরা কেউই তা বুঝতে পারছিলাম না। সে কিন্তু আমাদের বাংলা কথাও বেশ বুঝতে পারছিল। বাবু, এদিকে আসো বললে, দৌড়ে কাছে চলে আসছে। টিভি রিমোটটা এগিয়ে দাও বললে, টিভির পাশে রাখা রিমোট এগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো করে কথা বলছে না। সময় এগুতে থাকল, বাবুর সেই উদ্ভট ভাষার বাক্যগুলাও দীর্ঘতর হতে থাকল। আর আমাদের উদ্বেগও বাড়তে থাকল। একের পর এক শিশু বিশেষজ্ঞ দেখাতে থাকলাম, এক পর্যায়ে সাইকিয়াট্রিস্ট ও দেখালাম। কিন্তু সবাই ব্যর্থ হচ্ছিল রহস্যের কিনারা করতে। একসময় বাবুর উদ্ভট ভাষায় আমরাও অভ্যস্ত হয়ে গেলাম এবং হাল ছেড়ে দিলাম। বাবু আমাদের হয়তো বা বাক প্রতিবন্ধী হয়ে গেল ভেবে মনের ভেতরটা পুড়তে লাগল।
বাবুর বয়েস তখন পাঁচ, হঠাৎ করে অফিস থেকে পনের দিনের ছুটি পেয়ে গেলে আমি বাসার সবাইকে নিয়ে মালয়েশিয়া ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।
মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট থেকে কুয়ালালামপুর ইন হোটেলে যাওয়ার জন্য একটা ট্যক্সি ডেকে তাতে চড়লাম। মালয়েশিয়ার বিশাল রাস্তা আর তার আশেপাশের বিশাল বিশাল সব দালান দেখে আমরা তিনজন(আমি বাবুর মা আর বাবুর ফুপি) খুব আনন্দিত। ট্যাক্সির ভেতর বসে বাবুর লাফালাফি দেখে বুঝতে পারিছলাম সে ও যথেষ্ট আনন্দিত। হঠাৎ গাড়ি চালানোর ফাঁকে ড্রাইভার বাবুর দিকে তাকিয়ে কী জানি বলে উঠল। মনে হয় মালয় ভাষায় কিছু একটা বলতে চাইছে। আমরা মালয় না, মালয় ভাষা বুঝার প্রশ্নই আসে না। আমি অনুমান করে নিলাম হয়তোবা আমাদের গন্তব্য আবারো জানতে চাইছে। যে হোটেলে যাব তার নাম আবার উচ্চারন করলাম। উত্তরটা তার পছন্দজনক হল না মনে হয়, তাই ড্রাইভার আবারো শব্দগুলা উচ্চারন করল- বেরাপা উমু আন্দা। আমি আবার হোটেলটার নাম বলার আগেই বাবু বলে উঠল, সায়া বেরুমুর লিমা তাহুন। আয়নায় ড্রাইভারের মুখ দেখে বুঝতে পারলাম সে তার করা প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছে। এরপর আমরা অবাক হয়ে দেখতে পেলাম বাবুর সাথে ড্রাইভার খুব মজা করে কথা বলছে। আমাদের বুঝতে আর বাকি থাকল না, বাবু যে ভাষায় কথা বলে তা ড্রাইভারের ভাষার সাথে মিলে যায়। কিভাবে এ সম্ভব হল? বাবু বাংলা ভাষায় কথা না বলে মালয় ভাষায় কথা বলা শিখলো কিভাবে? আমরা বাংলা-ভাষী তিনজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকলাম। হোটেলে পৌছেই রিসিপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করলাম সে মালয় ভাষা জানে কি না। সে জানাল জাতিতে চাইনিজ হলেও মালয় ভাষার উপর তার দক্ষতা আছে। তাকে ডেকে আমাদের রুমে নিয়ে এসে দোভাষীর ভুমিকা নেবার অনুরোধ করলাম। সে রাজী হল।
দোভাষীর মাধ্যমে বাবুর সাথে কথা বলে যা জনাতে পারলাম তাতে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বাবু জানালো, অনলাইনে ফুপির সাথে বসে বসে উপিন ইপিন নামক কার্টুন দেখতে দেখতে মালয় ভাষা শিখে নিয়েছে। কিছুটা বড় হয়ে যখন সে বুঝতে পেরেছে বাংলা কোন কার্টুনের চাইতে মালয়েশিয়ার সেই কার্টুনটি অনেক মজাদার আর বাংলার চাইতে মালয় ভাষাটাই তার কাছে সহজ বলে মনে হচ্ছে তখন মালয় ভাষাতেই কথা বলা শুরু করে। ঘটনা শুনে বাবুর ফুপির দিকে তাকালাম। সে বলল, তোমরা বাবা মা দুজনই অফিস চলে যেতে, বাবুকে সামলাতে গিয়ে দেখলাম ইউটিউবে কার্টুন দেখলে বাবু চুপচাপ থাকে; বিশেষ করে উপিন ইপিন কার্টুন দেখালেই সে চুপচাপ সেটা দেখতে থাকতো। তাই বাধ্য হয়েই সারাক্ষণ তাকে উপিন ইপিন দেখাতাম। এবার বাবুর মা কথা বলে উঠলেন, সেই প্রথম থেকে খাওয়াবার সময় হলেই তাকে উপিন ইপিন দেখিয়ে দেখিয়ে খাওয়ানো হতো। তবে কখনো কার্টুনটা কোন দেশের বা কোন ভাষার সেটা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি।
বাবুর এ ঘটনাটা জানার পর ভাবতে কসলাম। আমি নিজে যে প্রডাক্শন হাউসে কাজ করি, সেখানে কেবল বড়দের মনোরঞ্জনের কথা চিন্তা করা হয়। ছোটদের জন্য কোনকিছু তৈরী করার কথা ভাবা হয় না। বাবুর একটা কথা বার বার কানে বাজছিল। তোমরা তো কেবল মিনা রাজু কার্টুনের কথাই ভাবতে পারো। আর বিশেষ দরকার হলে ডরেমন বাংলায় ডাব করার কথা। বাবুর কথাগুলো এতোটাই সঠিক যে আমি কোন উত্তর দিতে পারি নি তখন। তবে হ্যা এবার আমি ঠিক করলাম ছোটদের নিয়ে কিছু একটা করবো। এমন কিছু তৈরী করবো যাতে ছোটরা ডরেমন বা অন্যান্য বিদেশি ভাষার ছবি না দেখে বাংলা ভাষার ছবি দেখে। এমন ভাবে কার্টুনটা তৈরী করতে হবে যাতে বাংলাদেশের শিশুরা তো সেগুলি দেখবেই, এমনকি বাইরের দেশের শিশুরাও বাংলা ভাষার কার্টুন দেখে বাংলা ভাষায় কথা বলা শুরু করে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




