somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কী ভাবিয়া মনে এ দুটি নয়নে উথলে নয়নবারি- ৫ম পর্ব

২০ শে জুলাই, ২০১৬ সকাল ৮:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


৮.
সকাল সাড়ে দশটা। হাসপাতালের বহির্বিভাগের ১৩ নং রুমে আমার চেম্বার। এখনো রোগীদের আনাগোনা তেমন একটা বাড়ে নি। অবসর পেয়ে পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি। সহসা একটা মিষ্টি নারী কণ্ঠ আমার কানে প্রবেশ করল।
-আমি নুসরাত।
পেপার থেকে চোখ তুলে তাকালাম।
লাল-সাদা জামা পরা ২৩-২৪ বছরের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। হালকা পাতলা গড়নের মেয়েটির রং উজ্জ্বল শ্যামলা। ডিম্বাকৃতি মুখের গড়নে কালো হরিণ চোখগুলোর পেনসিল-সরু ভ্রুগুলো নাচিয়ে মিটিমিটি হাসছে সে। ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো যেন আমার চেম্বারের ছোট্ট রুমটায় আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়েটিকে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে বলেন।
-কিছু হয়নি তো! আমি নুসরাত। গতকাল আপনার সাথে কথা হয়েছিল।
গতকালকের সেই মেয়েটি যে এভাবে ঠিক ঠিক চলে আসতে পারে এ আমি একেবারেই ভাবিনি। তাই কী বলবো ভেবে পাচ্ছি না। পত্রিকার দিকে চোখ পড়াতে আলাপের বিষয় খুঁজে পেয়ে গেলাম।
-দেখেছেন, সালমান খান তার খান অ্যাকাডেমি করে কী রকম বিখ্যাত হয়ে গেল!
-ও মা! আপনি জাদু জানেন নাকি? মেয়েটি চিৎকার করে উঠল।
-এখানে জাদু জানার কী হল? আমিও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
-আরে, সালমান খান যে আমার ফেভারিট নায়ক এটা আপনি জানলেন কিভাবে? আপনাকে তো এটা এখনো বলা হয় নি!
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কাকে কী বলছি আমি! খান একাডেমির সালমান খান যে নায়ক সালমান খান নয়- বুঝতে পারলাম এ বিষয়টা মেয়েটাকে বুঝিয়েও কোন কাজ হবে না। তাই বললাম,
-সালমান খান বুঝি আপনার ফেভারিট নায়ক?
-হ্যা। আমি রীতিমতো উনার ফ্যান। আর তাছাড়া...তাছাড়া আরেকটা কথা জানেন?
-কী?
মেয়েটির গালের উজ্জল শ্যামলা রং কিঞ্চিত লাল বর্ণ ধারণ করল। আমি শুনতে পেলাম,
-আপনি দেখতে অনেকটা সালমান খানের মতো! তাইতো আপনাকে আমার এতো পছন্দ!
-আমাকে পছন্দ! আমাকে কি আপনি আগে কখনো দেখেছেন?
-হ্যা। আপনি তখন মনে হয় নতুন ডাক্তার হয়ে এখানে এসেছেন। তখন আমি আমার মাকে নিয়ে এখানে এসেছিলাম। ঈদের সময় ছিল সেটা। আমাদের পারিবারিক ডাক্তার বেড়াতে গিয়েছিলেন বলে বাধ্য হয়ে এখানে এসেছিলাম। আপনাকে দেখে আমি তো রীতিমতো ক্রাশ! সালমান খানের সাথে এতো মিল আপনার চেহারার! কিন্তু! কিন্তু আপনি আমার দিকে একবারও তাকালেন না! আমাকে তো কোন ছেলেরাই এমনভাবে অবহেলা করতে পারে না কখনো। তাই খুব রাগ হল আপনার উপর। পরে যখন বিয়ের আলাপটা আসলো আমি তো অবাক! এমন কান্ডও বুঝি পৃথিবীতে ঘটে! কিন্তু ঐ ঘটক ব্যাটাটা মনে হয় বাটপার গোছের! ও বোধহয় আপনাদের কাছে আমার ছবি আর বায়োডাটাটা দেয় নি।
- না, সেটা নয়। লোকটা সবকিছুই দিয়েছে।
-তাহলে? এতো দেরী করছেন কেন আপনারা?
কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। এমন সময় মুরুব্বী মতো একটা লোক চেম্বারে ঢুকে বলল,
-ও ডাক্তার ব্যাটা। আমার প্রেসারটা একটু মেপে দাও তো। লোকটা নুসরাতের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দেখে তাকে আমার পাশের চেয়ারে এসে বসতে বললাম। কী যে একটা উদ্ভট গন্ধ বেরুচ্ছে লোকটার শরীর থেকে! তাড়াতাড়ি প্রেশার মেপে দিয়ে বললাম,
-প্রেশার ঠিক আছে। কোন সমস্যা নেই।
-কীইইই? আবার দেখ।
মুরুব্বী মানুষ। অগত্যা প্রেশারটা আবার মাপলাম।
-নাহ! প্রেশার ঠিক আছে।
-ওষুধ দিবা না?
-না। ওষুধ লাগবে না।
-কি কও? ওষুধ দিবা না? তাইলে তুমি কিয়ের ডাক্তার হইসো?
এই হল আমাদের দেশের বিনা পয়সার রোগীদের অবস্থা! এখানে বেশির ভাগ মানুষ রোগ দেখাতে আসে না। আসে বিনা মূল্যের ওষুধ নিতে।
অগত্যা এক পাতার একটা ভিটামিন ওষুধের নাম লিখে দিলাম।
এরপর এক সাথে পাঁচ-ছ জন হুড়মুড় করে এসে চেম্বারে ঢুকল যেন বা সবার আগে না ঢুকলে আর ডাক্তার দেখানো হবে না। তাদের অনেক করে বললাম, লাইনে দাঁড়াতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সবাই হুমড়ি খেয়ে টেবিলের সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকল। আমি ওভাবেই রোগী দেখতে থাকলাম।
প্রথম জন এসে রিপোর্ট দেখাল। দেখলাম, সবগুলো ওসুধই রেজিসট্যান্ট হয়ে আছে। এদেশের রোগীরা ইচ্ছা মতো যার তার পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক খায়, আর সে ওষুধ রেজিসট্যান্ট হয়ে যায়! অনেক ঘেঁটেঘুঁটে একটা ওষুধ পেলাম যেটা এখনো রেজিস্ট্যান্ট হয় নি। রোগীকে সেটা লিখে দিয়ে বললাম, ওষুধটা বাইরে থেকে নিতে হবে।
-বাইরে থেকে? কেন বাইরে থেকে নেব? হাসপাতালে এতো এতো ওষুধ আসে। ওগুলো কোথায় যায়?
-আরে, আরে! উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আসলে এ ওষুধটা হাসপাতালে নাই। থাকলে অবশ্যই ওখান থেকেই দিতাম।
-আরে ডাক্তার সাহেব! মনে করেছেন আমরা বুঝি না আপনারা ওষুধ সব কী করেন? আমরা সব বুঝি। আপনাকে মজা দেখাবো, দাঁড়ান।
হাসপাতাল হচ্ছে আসলে পাতি নেতাদের মাস্তানি করার ট্রেইনিং সেন্টার। এখান থেকেই এরা মাস্তানি শিখে নিয়ে পরে বড় বড় মাস্তান হয়। নুসরাত মেয়েটা না জানি কী ভাবছে! বেচারি! হাসাপাতালে না আসলেই পারতো।
ছেলেটি চলে গেলে অন্যরোগীদের দেখছি। এতো রোগী আর রোগী। আজ আবার রবিবার। টিকা দিবস। টিকা দিবসে রোগীদের সংখ্যা যেন আরো বেড়ে যায়। বেশির ভাগই কেবল ওষুধ নেয়ার জন্য আর ঝামেলা পাকানোর জন্য এখানে আসে। একটু পর এক হোমড়া চোমড়া গোছের লোক আর সাথে কয়েকজন সাঙ্গ-পাঙ্গ প্রবেশ করল। চোখে চশমা পরা সরু গোঁফওলা একটা ছেলে নিজেকে সাংবাদিক বলে পরিচয় দিয়ে বলল, গত মঙ্গলবার ইমার্জেন্সিতে আপনি ছিলেন না?
আমি হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম। না জানি কোন আগ্নেয়াস্ত্র ধেয়ে আসছে আমার দিকে!
-আপনি তো উনার বড় ভাইকে শেষমেষ মেরেই ফেললেন!
-আমি! কিভাবে বলেন তো? (এমন আক্রমনে আমি অভ্যস্ত এখন।)
-উনার বড় ভাইকে আনার পর বললেন তাড়াতাড়ি রোগীকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য।
আমার ঘটনাটা মনে পড়ল। বললাম,. হ্যা উনার অবস্থা বেশ নাজুক ছিল।
-যাবার সময় একটা ওষুধ দিয়ে বলেছিলেন ওটা খাওয়াতে। ওটা খাওয়ানোর পরই রোগী মারা যায়।
আমি উনাদের বুঝাতে চাইলাম, ওষুধটার নাম ইকোস্প্রিন। ওটা হার্ট অ্যাটাকের রোগীদের খাওয়াতে হয়। আমি ভুল কিছু করি নি।
-আরে মিয়া, তোমার ওষুধ খাওয়াবার পরেই রোগী মারা যায়। আর বলছো , ভুল কিছু করোনি! তোমার জন্য আমার বড় ভাইটা মারা গেছে! তুমি খুনি! তোমার ফাঁসী হওয়া উচিত।
-আপনার নামে আজকেই পত্রিকাতে রিপোর্ট করব আমি! এতো হৈ চৈ এর মধ্যে সাংবাদিকটার গলা আমি ঠিক চিনে ফেললাম।
কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে যার ভাই মারা গেছেন সেই লোকটি আমার কলার ধরে ফেলল। আমি ঝাঁকি মেরে তার হাত ছাড়িয়ে ফেললাম। ১৩ নাম্বার রুমের হৈচৈ শুনে হাসপাতালের স্টাফরা ছুটে আসল। নুসরাত ভয় পেয়ে দৌড়ে বের হয়ে গেল।
এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক। এমন ভয়াবহ ঘটনা দেখে নুসরাত নিশ্চয়ই আর আমাকে বিয়ে করার জন্য এমন পাগল হবে না! (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৬ সকাল ৮:৫০
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

Testimony of Sixty- By Edward Kennedy বাংলাদেশের রক্তাক্ত সত্যের এক আন্তর্জাতিক স্বীকারোক্তি

লিখেছেন কিরকুট, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৩




১৯৭১ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর বৈপরীত্যের বছর। এটি যেমন ছিল অন্ধকার ও রক্তাক্ত, তেমনি ছিল সত্যের প্রতি অবিচল এক সময়কাল। এই বছরের গণহত্যা, শরণার্থী স্রোত ও মানবিক বিপর্যয়ের বিবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×