দু'দিন দেরি হয়ে গেল। ক্ষমা চাইলাম তাই প্রথমে।
এবছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় গেলাম ভাষা আনন্দোলনের দিনটির জন্য।
তারপর ঢাকায় সাভার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, স্টারের বিরিয়ানী ইত্যাদি।
কিন্তু আমার আরেকটি এজেন্ডাও ছিল এবং সেটি একটি আবর্তনের । একটি কষ্টের অনুভূতি বাড়িয়ে নেয়ার।
বাংলাদেশের কনিষ্ঠ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। পেশায় সাংবাদিক হওয়ায়
তার কবর ভারত থেকে বাংলাদেশ এর সীমানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া খুব কাছ থেকে দেখছিলাম।
ঘিয়ে রঙের সাদা কফিন বারান্দায় রাখা। আগরতলায় তার পাশে দাঁড়ানো সশস্ত্র বাহিনীর লোকজন।
খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাংলাদেশের প্রতিনিধি লে: কর্নেল সাজ্জাদ আলি জহির এলেন। পোজ হল ছবি হল। সেদিনই আবার অনেক ভারতীয় জাল টাকা নিয়ে ধরা পড়েছে এক ব্যক্তি, যার পান্ডা বাংলাদেশে অবস্থানরত বলে পুলিশকে জানিয়েছে ধৃত।
সারাদিন ঘুরে ফিরে আমাকেও যেতে হবে কাগজে, লিখতে হবে।
সেই দলে রহমান সাহেবের ছোট ভাইও ছিলেন, মহ: ফৈজুর রহমান। অনেক কথা। অনেক চোখের জল। বাপ-মায়ের কথা। সেদিন ১০ ডিসেম্বর, ২০০৭।
ত্রিপুরার হাতিমছড়ার একটা পুকুরের পার ধরে জল ছুঁই ছুঁই অবস্থায় তার দেহাবশেষ, মানে চুল, দাঁত, ইত্যাদি।
একজনকে পেলাম যিনি তাকে কবরে শায়িত হতে দেখেছেন। তাদের পেলাম যারা এতদিন বীর আছে আমাদের গাঁয়ে বলতেন।
তার বীরত্বের কথা নটউন করে কিছু বলার নেই। সবার জানা।
আমার এতক্ষনের এলোমেলো কথার ধারা কিন্তু অন্য।
সেই কফিনের ধার ঘেসে ঘেসে একটা কথাই মনে হয়েছে।
কোনও কিছু দিয়েই মহিমান্বিত করা যায় না রক্ত, যুদ্ধ, মৃত্যুকে।
কোনও কিছুই দিয়েই মৃত্যুর হিসাব নিকাশ শেষ হয় না । যেমন ভারতীয় বাহিনীর অবদানের কথা বলুন। হানিদুর সাহেব তো ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের, তিনি কোনও ভারতীয় দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, ইত্যাদি।
সীমানা কী জিনিস তা এই খানে খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মৃত ব্যাক্তির কথা বলছি কেমন করে তিনি গ্রেনেড দিয়ে মেরে ছিলেন, কয়জনকে। নয়ত তিনিই মরে যেতেন।
এত বছর পেরিয়েও, সেদিন কিন্তু জল দেখেছি আমি অনেকর চোখে যারা হামিদুরকেও দেখেননি কিংবা সেই যুদ্ধ।
কেউ কেঁদেছেন, কম বয়সের একটি ছেলের জন্য, কেউ ভাইয়ের জন্য, কেউ কেঁদেছেন, একই যুদ্ধে মারা যাওয়া স্থানীয় মানুষ( গুটিকয়) এর জন্য। সীমানা ভেদে সেই মানুষ যারা এখানে শেলে মারা গেলেন তাদের নামও জানি না। কিন্তু মৃত্যুর রূপ এক। এখানে ভুলেও কেউ জাল নোটের কথা বলেন না।
এখনও আমারা বীরত্ব বা বীরগাঁথা গাই, যুদ্ধের বীরত্বে কিন্তু একবার আসুন ভাবি, হামিদুরকে যদি যুদ্ধ করতে না হত, না মরতে হত,
সেই চওড়া বুকে কী ভালবাসা কম হত কিংবা সেই হৃদয় কী এমন কাজ করতেন পারতেন না যা আমাদের করে তুলত তাকে। সেই শিক্ষা কেন আমরা আজও পাই না, হয়ত তিনি সেই প্রশ্নও তুলতেন। আবেগ বেশি ঢেলে লাভ নেই জানি, তবে এত বছর থাকার পরও, তাকে কিন্তু চলে যেতে হল, এই সীমানা পেরিয়ে, সেটা যুক্তি এবং আবেগ কোনওটাতেই কুলোয় না।
সঙ্কীর্নমান যুক্তিতেও দেখি, এই যুদ্ধই হয়ত হোত না ( আমি বলছি না আমাদের সার্বিক অবস্থা পাল্টে যেত), সীমানাহীন এই অঞ্চলে।
এই সব বোকা কথা মাথায় জট পাকিয়ে যায়।
কাগজে তিন দিন ধরে লিখে চলি সেই কথা। গুছিয়ে লিখতে হয়।
সব বিলাপ, কান্না, আলির ইন্টারভিয়্যুর ফাঁকে ফাঁকে বাজে কথাও চলে আসতে থাকে---------------------------------
হামিদুর শেষ পর্যন্ত সেই দেশে, তার মাতৃভূমি। যা তিনি চেয়েছিলেন।
তারপরই লিখে ফেলি, চোখের জলে বিদায়, এক বাড়ি থেকে অন্যবাড়ি, হোম ফ্রম অ্যাওয়ে হোম .............
আজ নিজেদের অক্ষমতা ঢেকেও কেউ কেউ মনে করেছেন, এই বীরশ্রেষ্ঠ যেন শেষপর্যন্ত সেই দেশ গড়ার প্রেরনা হয়ে ওঠেন, যেখানে এই যুদ্ধের কোনও প্রয়োজন হবে না। হাতিমছড়ার পাশ দিয়ে সেই পথ ঘুরে যাবে ঢাকা, করাচি বিনা বাধায়।
আরও অনেক কিছু লেখা ছিল। ছিল অনেক ছবি।
তারপর একদিন আক্রোশে সব মুছে ফেলি মেশিন থেকে।
ঢাকা ঘুরে এসে বলি, এত সুন্দর ( লক্ষ্য করুন, কীরকম অভ্যাস 'সুন্দর')
স্মৃতিসৌধ আর দেখি নি।
তবে মেয়েকে বলেছি, দেখো বাবা, এইভাবে তারাও বাবার কোলে করে বেড়াতে যেতে পারত কিংবা বাবারা আসতে পারত। সেই কথাই এই বিশাল দেয়ালের মাঝে এই জানালা। দেখো এই অন্ধকার সন্ধ্যায়ও এই জায়গাটা দিয়ে ঠিক আলো আসছে।
মেয়েকে একবারও বলি না, মামনি, তোর কথাও পাসপোর্টে লেখতে হয়।
তুই হাতছানি দিয়ে ডাক, যেভাবে করছিস, এই দেড় বছর বয়স থেকে বড় হতে হতে মাথা ছাড়িয়ে, আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়া। যাদের আজ ডাকছিস হাত নেড়ে, তারা কেন জল বিক্রি করছে, নিজে না খেয়ে, তার জবাব দিতে বাধ্য করিস তাদের।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:২৬