জন্ম :
ফরিদপুর জেলার হারোয়া গ্রামে ১৯৩২ সালের ১ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন শিল্পী রশিদ চৌধুরী। ডাকনাম ছিল কনক। পুরো নাম- রশিদ হোসেন চৌধুরী।
ফরিদপুর জেলার হারোয়া গ্রামে রশিদ চৌধুরীর জন্ম হলেও তাঁর শৈশবেই বাবা ইউসুফ সাহেব আবাসভূমি স্থানান্তরিত করে নিয়ে যান নিকটবর্তী রতনদিয়া গ্রামে- বর্তমান রাজবাড়ী জেলায়।
পরিবার-পরিজন:
পিতা ইউসুফ হোসেন চৌধুরী ও মা শিরিন নেসা চৌধুরানী। বড় চাচা আলীমুজ্জামান চৌধুরী। রশিদরা ছিলেন নয় ভাই, চার বোন। তিনি বিয়ে করেছিলেন দুটি। প্রথমে ফরাসি মেয়ে অ্যানিকে, ১৯৬২ সালে। ১৯৭৭ সালে বাঙালি মেয়ে জান্নাতকে। তাঁদের দুই মেয়ে- রোজা ও রীতা।
রশিদ চৌধুরীর আঁকা পোট্রেট (স্ত্রী)
পড়াশোনা:
রজনীকান্ত হাই স্কুল, আলীমুজ্জামান হাই স্কুল ও কলকাতার পার্ক সার্কাস হাই স্কুলের পাঠ শেষে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ভর্তি হন সরকারি আর্ট কলেজে। প্রথম বিভাগে পাস করেন, ১৯৫৪ সালে। ওই বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়াম থেকে শিল্প-সমঝদারি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৫৬-৫৭ সালে বৃত্তি পেয়ে মাদ্রিদের সেন্ট্রাল এস্কুলা দেস বেলিয়াস আর্টেস দ্য সান ফার্নান্দো থেকে ভাস্কর্যে এবং ১৯৬০-৬৪ সালে বৃত্তি পেয়ে প্যারিসের একাডেমি অব জুলিয়ান অ্যান্ড বোজ আর্টস থেকে ফ্রেস্কো, ভাস্কর্য ও ট্যাপিস্ট্রি বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে মার্কিন সরকার প্রদত্ত লিডারশিপ গ্র্যান্টের অধীনে আমেরিকায় শিক্ষাসফর করেন।
কর্মজীবন:
১৯৫৮ সালে সরকারী আর্ট ইনস্টিটিউটে (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাবি) শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু। ১৯৬৪ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকার সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে প্রাচ্যকলা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৬ সালে ওই চাকরি হারান। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম চারুকলা বিভাগে প্রথম শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭২ সালে বেসরকারি উদ্যোগে শিল্প-প্রদর্শনকেন্দ্র 'কলাভবন' (বর্তমানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর চট্টগ্রাম কেন্দ্র) গড়ে তোলেন। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠায়ও ছিলেন মুখ্য উদ্যোক্তা। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ত্যাগ করে ঢাকায় স্থায়ীভাবে চলে আসেন এবং মিরপুরে ট্যাপিস্ট্রি কারখানা গড়ে তোলেন। ১৯৮৪ সাল ট্যাপিস্ট্রি পল্লীর খসড়া প্রণয়ন করেন।
শিল্পকর্ম:
মূলত ছিলেন ট্যাপিস্ট্রি শিল্পী। এছাড়াও চিত্ররচনা করেছেন তেলরঙে, টেম্পারায়, গোয়াশে এবং জলরঙে। পোড়ামাটিতে ভাস্কর্য ও বিভিন্ন মাধ্যমে ছাপাই ছবিও করেছেন। ফ্রেস্কো ও ট্যাপিস্ট্রি মাধ্যমে অজুরার কাজ করেছেন। উল্লেখযোগ্য হলো- ঢাকায় কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, পাট বিপণন সংস্থা ও বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন, ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার গণভবনের সার্বিক সজ্জার কাজ (অসমাপ্ত), ফরাসি সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ম্যানিলা, ইসলামিক ব্যাংক জেদ্দাসহ বিদেশেও রয়েছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সংসদ ভবন ও ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের জন্য বড় আকৃতির ট্যাপিস্ট্রি; টেরাকোটা মাধ্যমে অর্পিত-কার্য করেছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে রয়েছে তাঁর টেরাকোটা মুরাল। তাঁর শিল্পকর্ম দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন ভবন ও প্রতিষ্ঠানে সংগৃহীত রয়েছে। এর মধ্যে বঙ্গভবন, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর দেশাভ্যন্তরে অন্যতম। বিদেশে প্রেসিডেন্ট ভবন, ভারত; প্রেসিডেন্ট ভবন, মিশর; প্রধানমন্ত্রী ভবন, অস্ট্রেলিয়া; প্রেসিডেন্ট ভবন যুগোশ্লাভিয়া; প্রধানমন্ত্রী ভবন, মিয়ানমার; বিদেশ মন্ত্রণালয়, ফ্রান্স প্রভৃতি।
অর্পিত-সম্পাদিত শিল্পকর্মের মধ্যে- ১৯৬৩ সালে ট্যাপিস্ট্রি, ফরাসি সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়; ১৯৬৪ সালে মুরাল, ইস্সোয়াত সরকারি কলেজ, ফ্রান্স; ১৯৬৫ সালে ট্যাপিস্ট্রি, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, ঢাকা; ১৯৬৭ সালে ট্যাপিস্ট্রি, পাট বিপণন সংস্থা, ঢাকা; ১৯৬৯ সালে ফ্রেস্কো, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ; ১৯৭৩ সালে গণভবনের সার্বিক সজ্জার কাজ (অসমাপ্ত); ১৯৭৫ সালে ট্যাপিস্ট্রি, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ম্যানিলা, ফিলিপিন্স; ১৯৭৬ সালে ট্রাপিস্ট্রি, প্রধান কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা; ১৯৭৮ সালে ট্যাপিস্ট্রি, ইসলামিক ব্যাংক, জেদ্দা, সৌদি আরব; ১৯৭৮-৮১ সালে ট্রাপিস্ট্রি ও তৈলচিত্র, ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা; ১৯৭৯ সালে ট্রাপিস্ট্রি, ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল, চট্টগ্রাম; ১৯৮২ সালে ট্রাপিস্ট্রি, ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, ঢাকা প্রভৃতি।
রশিদ চৌধুরীর আঁকা- ফেরিওয়ালী
রশিদ চৌধুরীর আঁকা- বাংলার উৎসব
রশিদ চৌধুরীর আঁকা- হাঁতি
রশিদ চৌধুরীর আঁকা- স্বর্গের রাণী
রশিদ চৌধুরীর আঁকা- ফেরিওয়ালী
রশিদ চৌধুরীর আঁকা- ষরা চিত্র
রশিদ চৌধুরীর আঁকা- বসন্ত-দূয়ার
প্রদর্শনী:
একক প্রদর্শনীর মধ্যে- ১৯৫৪ সালে প্রথম নিখিল পাকিস্তান চিত্রপ্রদর্শনী; ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রামে, ১৯৫৯, ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৪ সালে চিত্রকলা ও ড্রয়িং-এর প্রদর্শনী ফ্রান্সে, ১৯৬৫ সালে ট্যাপিস্ট্রি, চিত্রকলা ও ড্রয়িং-এর প্রদর্শনী ঢাকায় বাংলা একাডেমীতে, ১৯৬৬ সালে চিত্রকলা ও ড্রয়িং-এর প্রদর্শনী পাকিস্তানে; ১৯৬৬ সালে চিত্রকলা ও ড্রয়িং-এর প্রদর্শনী রাজশাহীতে; ১৯৭০ সালে ট্যাপিস্ট্রি ও চিত্রকলার প্রদর্শনী চট্টগ্রামে; ১৯৭২ সালে ট্যাপিস্ট্র ও চিত্রকলার প্রদর্শনী যুক্তরাজ্যে; ১৯৭৩ সালে ট্যাপিস্ট্রির প্রদর্শনী চট্টগ্রামে; ১৯৭৫ সালে চিত্রকলা ও ড্রয়িং-এর প্রদর্শনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; ১৯৮৫ সালে ট্যাপিস্ট্রি ও চিত্রকলার প্রদর্শনী ঢাকায়; ১৯৯৯ সালে ট্যাপিস্ট্রি ও চিত্রকলার প্রদর্শনী শান্তিনিকেতন, ভারত (মরণোত্তর); ২০০২ সালে ট্যাপিস্ট্রি ও চিত্রকলা প্রদর্শনী চট্টগ্রামে (মরণোত্তর)। যৌথপ্রদর্শনীর মধ্যে- ১৯৫১, ১৯৫২, ১৯৫৩, ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭৪, ১৯৮০, ১৯৮১, ১৯৮৫ সালে ঢাকায়; ১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; ১৯৫৯, ১৯৬০, ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান; ১৯৬১, ১৯৬৩ সালে প্যারিস; ১৯৬৬ সালে ইরান; ১৯৭২ সালে ফ্রান্স; ১৯৭৪, ১৯৭৮ সালে ভারত এবং ১৯৮০ সালে জাপানে।
পুরস্কার:
১৯৬১ সালে ছাত্রাবস্থায় ফ্রান্সে পারীস্থ বোজ আর্ট কর্তৃক ফ্রেস্কো চিত্রকর্মের জন্য প্রথম পুরস্কার, ১৯৬৭ সালে ইরানের তেহরানে আর.সি.ডি. দ্বি-বার্ষিক চিত্র প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার, ১৯৭৭ সালে চারুকলায় বিশেষ করে ট্যাপেস্টিতে সৃজন ক্ষমতার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদক, ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার ও ১৯৮৬ সালে জয়নুল পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।
মৃত্যু:
১৯৮৬ সালের ১২ ডিসেম্বর মাত্র ৫৪ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন৷
(তথ্যসহযোগিতা নেওয়া হয়েছে- জীবনীগ্রন্থমালা: রশিদ চৌধুরী, লেখক আলাউদ্দিন আল আজাদ, বাংলা একাডেমী, মে ১৯৯৪; চরিতাভিধান : সম্পাদনা- সেলিনা হোসেন, নূরুল ইসলাম, বাংলা একাডেমী, জুন ১৯৮৫; বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর, লেখক শিল্পী আমিনুল ইসলাম, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, জুন ২০০৩ থেকে)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১:৫৬