somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহান বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ দুপুর ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
বয়স কত? একুশ। পরনে মালকোঁচা ধুতি। মাথায় গৈরিক পাগড়ি, গায়ে লাল ব্যাজ লাগানো শার্ট। ইনিই দলনেতা। এক হাতে রিভলবার, অন্য হাতে হাতবোমা। দলের সদস্যসংখ্যা সাত। সবার পরনে রাবার সোলের কাপড়ের জুতো। সবাই প্রস্তুত। দলনেতার মুখে ‘চার্জ’ শুনতেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রুর ওপর। তারা তখন ক্লাবে মত্ত নাচ-গানে। পিকরিক অ্যাসিডে তৈরি বোমাটি বর্জ্রের মতো ভয়ংকর শব্দে ফেটে পড়ল; হলঘরে তখন শুধু ধোঁয়া। দলনেতাই এগিয়ে গেল সবার আগে। অথচ এটাই তার প্রথম অভিযান। বোমার বিস্ফোরণ, গুলির শব্দ, শত্রুর মরণ চিত্কার—সব মিলে এলাকাটা যেন পরিণত হলো এক দক্ষযজ্ঞে!
এটা কোনো অ্যাডভেঞ্চার ফিল্মের দৃশ্য নয়। এটি ইতিহাসের এক অনন্য ঘটনা। আমরা আরও রোমাঞ্চিত হই—যখন জানি, ২১ বছরের সেই দলনেতা পুরুষ বেশে একজন নারী! বাংলাদেশেরই নারী! নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
১৯৩২ সাল। যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই বাঙালি নারী। তত্কালীন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। পরাক্রমশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ‘প্রীতিলতা’। আত্মদান করে প্রমাণ করেছেন, মেয়েরাও পারে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবন উত্সর্গ করতে।
১৯১১ সালের ৫ মে, মঙ্গলবার প্রীতিলতার জন্ম। মা প্রতিভা দেবী। বাবার নাম জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার। তিনি মিউনিসিপ্যালিটির হেড ক্লার্ক। ছয় ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন প্রীতিলতা। মা আদর করে ডাকতেন রানী বলে। ছাত্রী হিসেবে ঝলমলে সব রেকর্ড। ১৯২৭ সালে চট্টগ্রামের খাস্তগীর উচ্চবিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন এবং ভর্তি হন ঢাকার ইডেন কলেজে। ১৯২৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহিলাদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে আইএ পাস করেন। পরে কলকাতায় গিয়ে বেথুন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩২ সালে চট্টগ্রামে ফিরে নন্দনকানন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা পদ গ্রহণ করেন। ছোটবেলায় যখন দাদা পূর্ণেন্দুর দেওয়া বইয়ে ‘ক্ষুদিরামের ফাঁসির’ কথা পড়তেন, তখন ভাবতেন এও কি সম্ভব! মনে তাঁর প্রশ্ন জাগে, আমরা মেয়েরা কি এঁদের মতো হতে পারি না?
বেথুন কলেজে পড়ার সময় ‘দিপালী সংঘের’ সঙ্গে পরিচয়। সংঘের দিদিদের দেওয়া বইয়ের প্রচ্ছদে ছিন্ন লালপাড়ের শাড়ি পরা এক শৃঙ্খলিত নারীর ছবি। নিচে লেখা ‘ভাঙ্গনের পালা শুরু হল আজি, ভাঙ্গ ভাঙ্গ শৃঙ্খল।’ এ বই পড়েই উত্তেজিত প্রীতিলতা। তিনিও ভাঙতে চান ব্রিটিশদের শৃঙ্খল। কিন্তু পথ খুঁজে পান না। একদিন পত্রিকায় খবর হয়, ‘চাঁদপুর স্টেশনের ইন্সপেক্টরের’ হত্যাকারী দুই বাঙালি যুবক গ্রেপ্তার। তাঁদের নাম রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও কালিপদ চক্রবর্তী। প্রীতিলতার সঙ্গে রামকৃষ্ণের পরিচয় ছিল না। নিজেকে বোন পরিচয় দিয়ে জেলের ভেতর ৪০ বারের মতো রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন প্রীতিলতা। তাঁর মুখেই শোনেন সূর্য সেনের দৃঢ়চরিত্র ও বীরত্বের কথা। দাদা রামকৃষ্ণের কাছেও প্রীতির একই প্রশ্ন, ‘আমরা মেয়েরা কি তোমাদের মতো হতে পারি না, দাদা?’
১৯৩২ সালের মে মাসে রানীর জীবনে এল সেই স্মরণীয় দিন। জীর্ণ এক ঘরের কোনায় জ্বলছিল একটি প্রদীপ। ঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ‘মাস্টারদা’। সেই প্রথম দেখা মাস্টারদার সঙ্গে। এমন সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা বাড়িটি ঘিরে ফেলে। শুরু হয় দুই দিক থেকে গুলি চালাচালি। সে যুদ্ধে প্রাণ দেন বিপ্লবী নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন। সূর্য সেন প্রীতিলতাকে নিয়ে বাড়ির পাশে ডোবার পানিতে ও গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন। সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর মাস্টারদা বলেন, ‘প্রীতি, তুমি বাড়ি ফিরে গিয়ে স্কুলের কাজে যোগ দেবে, তাহলে গত রাতের ঘটনায় কেউ তোমাকে সন্দেহ করবে না।’ ধলঘাটের সেই যুদ্ধে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ক্যামারুনও নিহত হন।
মাস্টারদা উপলব্ধি করতে লাগলেন মেয়েরাও দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারে। এর আগে সশস্ত্র সংগ্রামে গুটিকয় মেয়ে কর্মী ছিল। কিন্তু এদের কাজ ছিল বিপ্লবীদের খবর আদান-প্রদান, অস্ত্রশস্ত্র জমা রাখা, চাঁদা তোলা এবং বিপ্লবীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। সামনাসামনি অস্ত্র হাতে শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করেনি। সূর্য সেন সিদ্ধান্ত নেন ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে নেতৃত্ব দেবে ‘প্রীতিলতা’।
শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। সাতজনের দলে দলনেতা প্রীতিলতা ছাড়াও ছিলেন—বিপ্লবী কালীকিংকর, শান্তি, সুশীল, মহেন্দ্র, বীরেশ্বর, প্রফুল্ল ও পান্না। অভিযানের আগে পড়া হলো ইশতেহার। মাস্টারদা বললেন, ‘জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্তঋণ, ওদের রক্ত দিয়েই আজ শোধ করতে হবে। এ দায়িত্ব তোমাদের। সবাই দেখবে অপমানে জবাব দিতে আমরা আর পিছিয়ে থাকব না।’
১৯৩২ সাল। ২৪ সেপ্টেম্বর। ইউরোপীয় ক্লাব থেকে বিপ্লবীদের সংকেত পাওয়ার পর, প্রীতিলতার নেতৃত্বে সাতজন তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়লেন ইংরেজদের ওপর। সফল(!) হলো বিপ্লবীদের অভিযান। সকলেই নিরাপদে ফিরে এলেন, ফিরে এলেন না দলনেতা প্রীতিলতা। ধরা পড়ার অপমান ঠেকাতে ‘পটাশিয়াম সায়ানাইড’ খেয়ে আত্মদান করলেন। পরের দিন পুলিশ ক্লাবের পাশে পড়ে থাকা লাশকে পুরুষ ভেবেছিল। কিন্তু মাথার পাগড়ি খুলে লম্বা চুল দেখে শুধু ব্রিটিশ পুলিশ নয়, গোটা ব্রিটিশ সরকারই নড়েচড়ে উঠল। আলোড়িত হলো গোটা ভারতবাসী।
যাওয়ার আগে মায়ের কাছে চিঠি লেখেন প্রীতি, ‘মাগো, অমন করে কেঁদোনা! আমি যে সত্যের জন্য, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না? কী করব মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী বিদেশির অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভাবে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা!
তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উত্সর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?’
আগামীকাল সেই ২৪ সেপ্টেম্বর, মহান এই বিপ্লবীর ৭৯তম আত্নাহতি দিবস। বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি মহান বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের প্রতি।
১৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×