somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন'

১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিএসসি পাশ করেছিলো যে-বছর মেয়েটি, সেই বছরেই বিয়ে হয়েছিলোতার।
গরীব বাপের আদুরে মেয়ে। বাবার অর্থকষ্ট থাকা সত্বেও পড়ালেখার প্রতি খুব মনোযোগী মেয়েকে বলেছিলেন, 'আমার কি আছে না আছে হেইদিকে তুই খেয়াল করিস না রেমা, পড়ালেহা যদ্দুর করতে চাইবি করবি, আমার মাইয়া সনমানী (সম্মানী) মানুষ হইছে হেইডা দেখবার চাই, নিজে পড়ালেহা করি নাই,তয় বুঝবার পারি বিদ্যার দাম আছে।'
মধ্যবয়সী কৃষক যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন তার ভিজে ওঠা চোখের দৃষ্টিতে মোহনীয় আলো কণাদের তেজদীপ্ত মহড়া চলছিলো। ঘরের বারান্দায় শীতল পাটিতে বসে তখন মেয়েটির মা নকশী কাঁথা সেলাই করছিলেন। পাশেই বসে আছে মেয়েটি। আজ তার আনন্দের দিন। আজতার বিএসসি'র রেজাল্ট বেরিয়েছে। সে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছে।
কিন্তু বাবার মায়াভরা কথা আর তার ভিজে ওঠা চোখের দিকে তাকিয়েমেয়েটিও অশ্রুসজল হয়। বাবাকে কিছু বলতে যেয়ে থেমে যায়। চৈত্রের আকাশের দিকে এক নজর চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আবার বাবার দিকে তাকায়। তার মনে হয় বাবা পরিচয়ের এই মানুষটির কোনো তুলনা হয় না।
পরের দিন গ্রামের মেঠো পথে বান্ধবীদের সাথে খোশ গল্প করে করে ফিরছিলো বাড়ি। মাঝপথে মোটরসাইকেল আরোহী এক বিদেশ ফেরত তরুন তাদের অতিক্রম করে যাবার সময় মেয়েটিকে দেখে। মায়াবী চেহারার মেয়েটিকে তার মনে ধরে। সে বিয়ে করবে এই মেয়েটিকে। তরুন মেট্রিক পাশ করে নি। তাতে কি? বিদেশে তার জমজমাট ব্যবসা। তার মতো ধনী লোকআশেপাশের চার গ্রামে আছে মাত্র ছয় পরিবার।
যে-কৃষকের মেয়ের কথা বলছি, সেই কৃষকের গ্রাম থেকে দুই গ্রাম তফাতে ওই তরুণের গ্রাম।
তিন দিন পর তরুণের পক্ষ থেকে বিয়ের পয়গাম আসে কৃষকের বাড়ি। কৃষক কখনো কল্পনাও করেন নি ওই গ্রামের ওই বাড়ি থেকে তার মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব আসবে। তিনি বরপক্ষকে জানান তার মেয়ে ইউনিভার্সিটি পাশ করার পর বিয়ে করবে বলে জানিয়েছে। বরপক্ষ জানায়, পড়ালেখা চালিয়ে যাবে কোনো অসুবিধা হবে না। তারা মিথ্যে কথা বলে। বলে, হবু বরেরও লেখাপড়া কম না। দেশে মেট্রিক পাশ করে নাই কিন্তু বিদেশে পড়ালেখা করে ডিগ্রী হাসিল করেছে। এটাও মিথ্যেকথা। তরুনটির গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও গায়ে-গতরে সুঠাম সুদর্শন। চেহারাও মন্দ না।
কৃষক বরপক্ষের কাছে এক সপ্তাহ সময় চান।
সপ্তাহভর আত্মীয়-স্বজনের সাথে শলা-পরামর্শ করেন। বেশিরভাগ স্বজনেরা বিয়ের পক্ষে মত দেন। যে-কথার কারণে কনে পক্ষে বিয়ের সিদ্ধান্ত পাকা হয়, সেটা হলো, 'আইজকাইল দিন-মাদান যা পড়ছে টেকা-পয়সা ধন-দৌলত না থাকলে শিক্ষিত জ্ঞানী গুণীর কদর নাই।'
অতঃপর তরুণটির সাথে মেয়েটির বিয়েহয়।
বিয়ের পাঁচদিন পর মেয়েটি টের পায় তার শ্বশুরবাড়ির নাম-ডাক বাইরে যা, ভেতরে তার উল্টা। প্রাচুর্যে ভরা বাড়িটিতে কুসংস্কার আর অজ্ঞতায় ভরে আছে প্রতিটি মানুষেরঅন্তর। মারাত্মক হলো তাদের চালচলনের ত্রুটি কেউ ধরতে পারবে না। তাদের অন্ধকারাচ্ছন্নত ¬াই ঠিক। বাইরে বাইরে পরহেজগারী আর ভেতরে ভেতরে টাকার গরিমা গোয়ার্তুমী।
মেয়েটিকে ইউনিতে পড়ার সুযোগ দেয়াহয় নি। স্বামী বাহাদুর খুবকায়দা করে বলেছে, 'তুমি আমার অমতে চললে দ্বীন দুনিয়া সব হারাইবা।'
মেয়েটি সংস্কৃতিমনা। নজরুল রবীন্দ্রনাথ ডি এল রায়ের গান শুনতে চায়, নাটক দেখতে চায়, কবিতা আবৃত্তি শুনতে চায়, পারে না। শ্বশুর বাড়ির সবাই বাধা দেয়। তারা বলে ওইসব ফাউলামী এখানে চলবে না। শিল্পপ্রেম মানে তাদের কাছে ফাউলামী। মেয়েটি আহত হয়; প্রতিদিন বিক্ষতহয় তার হৃদয়। স্বামীর কাছে একদিন আবদার করেছিলো নজরুলগীতিশুনার ব্যাপারে। স্বামী মহাশয় জবাব দেন, 'এসব পেরেম-চেরেমের গান হুননের দরকার নাই, ফালতু।' মেয়েটিচুপ হয়ে যায়। একদিন শহরেবেড়াতে যাওয়ার কথা বলায় বড় ননদ বিদ্রুপ করে বলে, 'হেহে রে ! ফুটানী কতো! বেড়াইবার চায়! তুমি বেড়াইতে গেলে আমাগো খাদিমদারী করবো কেডা।'
স্বামী শ্বশুর শাশুড়ী ননদ দেবর সবাই মেয়েটিকে সারাক্ষণ চাপের মধ্যে রাখে নানান ছল-ছুতায়।
মেয়েটির মনে হয় সে জাহান্নামে আছে। কিন্তু কেন? মেয়েটি নিজেকেইপ্রশ্ন করে- 'আমি এই জাহান্নামে কেন? আমার অপরাধ কি?' কিন্তু নিজেদের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না! বাপের বাড়িগিয়ে মাঝে-মধ্যে কাউকে কিছু বলেনা। শুধু মাকে বাবাকে ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। কান্নার কারণ জিগ্যেস করলে বলে- 'না ভালোই আছি, কান্দি তোমাগো মায়ায়!'
বাপের বাড়ি আসে হিসেবের দশ দিনের জন্য। ফিরতে একদিন দেরী হলে স্বামীসহ সকলের তির্যক কথার তুফান ছোটে।
দেশের আইন আদালতের আশ্রয় নেয়ার কথা ভেবেছিলো একবার মেয়েটি। কিন্তু সুবিচার না পাওয়ার অজস্র সংবাদ সে পত্রিকায় পড়েছে। প্রভাবশালী মহলের দৌরাত্মের কথা সে জানে। তাই থেমে যায়। উৎপীড়ন সহ্য করে।
বছরের মাথায় মেয়েটি এক কন্যা সন্তানের জননী হয়। স্বামী তার তিন চার মাস পর পর দেশে আসে। মাসখানেক থাকে। আবার চলে যায়। স্বামী লোকটাকে তার অচেনা দূরের মানুষ মনে হয়। শয্যাসঙ্গী হওয়া ছাড়া প্রাণোচ্ছল ভালোবাসাময় কথা বিনিময় হয় নি কখনো। একদিন সে আবিস্কার করে তার স্বামীর স্বভাবভালো না। বাইরে সম্পর্ক আছে বিস্তর।
মেয়েটি জীবম্মৃত হয়ে গেছে! বেঁচে থাকার কোনো মানে খুঁজে পায় না। সংসারমুক্ত হতে ইচ্ছে করে কিন্তুঘুমন্ত শিশুকন্যাটির দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল হয়!পাশের জানালাদিয়েবিবাগী দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় আকাশের দিকে। তার কন্ঠে উচ্চারিতহয় জীবনানন্দ দাশের পংক্তি- 'আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন'।

(একটি বাস্তব জীবনের ছায়া অবলম্বনে
লিখেছেনঃ সারওয়ার চৌধুরী)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০১৩ ভোর ৫:১৮
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×