থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রয়ুত চান অচাহ্ (Prayut Chan Ocha) একবার সংবাদ সম্মেলনে নিজের কাট আউট (সমান উচ্চতার নিজের একটি ছবি, যার বাড়তি অংশ কাটা) নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। সেদিন 'শিশু দিবস' উপলক্ষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। উল্লখ্য যে, ১০১৪ সালে রক্তহীন এক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসেছিলেন প্রয়ুত। তিনি ছিলেন থাইল্যান্ডের সেনা প্রধান। সেসময় নির্বাচনের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এলেও বিভিন্ন অজুহাতে সময় নিচ্ছিলেন তিনি। এজন্য তখন রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের যেকোন প্রশ্ন এড়িয়ে যেতেন।
ফলে সেদিন নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে কথা বলার পর তিনি মাইক্রোফোনের সামনে কাট আউট দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন যাতে সাংবাদিকরা অন্য কোন বিষয়ে প্রশ্ন করতে না পারেন। প্রধানমন্ত্রীর এ আচরণে সাংবাদিকদের মধ্যে প্রচুর হাস্য রসের জন্ম দেয়। সবাই ব্যাপারটি বেশ উপভোগ করেন।
সংবাদ সম্মেলন ও সাংবাদিক সম্মেলন দু'টি ভিন্ন ধারণা। সংবাদ সম্মেলনকে সাংবাদিক সম্মেলন বলা গুরুতর ভুল। অথচ হরহামেশা আমাদের দেশে ধারণা দু'টির অপপ্রয়োগ হয়। কোন কোন সময় টিভি, রেডিওতেও সংবাদ সম্মেলনকে সাংবাদিক সম্মেলন হিসাবে প্রচার করা হয়। অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যানারে ভুলক্রমে 'সাংবাদিক সম্মেলন' লেখে সংবাদ সম্মেলন করে থাকেন।
যদি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্টান কোন বিষয় সম্বন্ধে বলার জন্য বা প্রচার করার উদ্দেশ্যে সাংবাদিকদের ডেকে বিষয়টি উপস্থাপন করেন এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তাহলে তা 'সংবাদ সম্মেলন'। আবার যদি কোন সাংবাদিক সংগঠন বা সাংবাদিকরা একটি জায়গায় জমায়েত হয়ে নিজেদের মধ্যে আলাচনা করেন বা কোন দাবী উত্থাপন করেন তবে তা 'সাংবাদিক সম্মেলন'।
আমেরিকার হোয়াইট হাউসের প্রেস ব্রিফিং সম্বন্ধে আমরা সবাই কমিবেশি জানি। প্রেসিডেন্টের যেকোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, আন্তর্জাতিক যে কোন ইস্যু এবং দেশের অভ্যন্তরীন অনেক বিষয় নিয়ে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি প্রতিনিয়ত সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন এবং তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। ১৯২৯ সালের ৪ মার্চ হোয়াইট হাউসে এটি চালু করা হয়। প্রথম প্রেস সেক্রেটারি ছিলেন জর্জ একার্সন।
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির এসব ব্রিফিং কভার করতে সারা বিশ্বের নামকরা প্রেস ও ইলেক্ট্রোনিক্স মিডিয়ার সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের মনোভাব ও সিদ্বান্ত জানতে। অনেক সময় তা বিশ্ব মিডিয়ায় লাইভ হয়। এ প্রেস ব্রিফিং আবার 'সংবাদ সম্মেলন' ও 'সাংবাদিক সম্মেলন' এর একটু ব্যতিক্রম। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের মতবাদ ও সিদ্ধান্ত জানাতে হোয়াইট হাউজ অফিসিয়ালি এটি আয়োজন করে। এমন প্রথা বিশ্বের আরো অনেক দেশে আছে। কোন কোন দেশে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মূখপাত্র এটি করে থাকেন।
বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীল হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি রবার্ট গিবসকে নিয়ে একটি মজার তথ্য আছে। একবার বাস্টনে আমেরিকার ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দিতে বারাক ওবামা গিয়েছিলেন। সাথে ছিলেন রবার্ট গিবসও। কংগ্রেস শুরু হওয়ার আগে ওবামা যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন টাই নিয়ে সমস্যায় পড়েন। সাথে থাকা চার পাঁচটি টাইয়ের কোনটিই পোষাকের সাথে মানানসই হচ্ছিল না। তার স্ত্রী মিশেলেরও টাই গুলো পছন্দ হচ্ছিল না। এদিকে সময় মাত্র দশ মিনিট বাকি, তখন কেউ একজন প্রেস সেক্রেটারি রবার্ট গিবসের পরা টাইয়ের দিকে ইঙ্গিত করলে ওবামার এটি পছন্দ হয়ে যায়। অনেকটা বাধ্য হয়ে বেচারা গিবস টাইটি খুলে দিয়ে ওবামার একটি টাই পরলেন।
কিন্তু অনুষ্ঠান শেষে ওবামা টাই-টি ফেরত দিতে বেমালুম ভুলে গেলেন। দিন যায় মাস যায় গিবসের টাই তো ফেরত আসে না, তিনিও চক্ষু লজ্জার ভয়ে প্রেসিডেন্টকেও কিছু বলেননি। বছরখানেক পরে একদিন হোয়াইট হাউসে গিবসের প্রেস ব্রিফিং চলাকালে প্রেসিডেন্ট ওবামা সবাইকে অবাক করে দিয়ে টাই-টি তাকে ফেরত দেন এবং সাংবাদিকদের সাথে বিষয়টি শেয়ার করেন। এ সময় মজা করে গিবসকে বলেন আমি তোমার টাই-টি অন রেকর্ড সাংবাদিকদের সামনে ফেরত দিলাম, আশা করি এটি ফেরত পাওনি বলে ভবিষ্যতে কোনদিন অভিযোগ করবে না।
রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে কয়েক মাস আগে টিভিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একটি সংবাদ সম্মেলন দেখলাম। এ প্রকল্পের বিষয়ে অনেক বিরোধীতা হওয়ায় এবং মানুষের মধ্যে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা থাকায় সংবাদ সম্মেলনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার মত অনেকেই টিভিতে প্রকল্পটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনতে এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর কিভাবে প্রধানমন্ত্রী দেন তা জানতে উদগ্রীব ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের শেষে যখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পালা আসল তখন অবাক হয়ে দেখলাম কোথায় তারা প্রশ্ন করবেন, তা না করে শুরু করলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা ও চাটুকারিতা।
কিভাবে উনাকে খুশি করা যায়, কে কার চেয়ে বেশি গুছিয়ে তেল মারতে পারেন তার প্রতিযোগিতা। সংবাদ সম্মেলন নয়, যেন দলীয় কর্মী সভা। একজন সাংবাদিক একটু সাহস করে কিছু একটা জানতে চেয়েছিলেন, উনার এই উদ্যোত আচরণের জন্য জুটল সহকর্মী সাংবাদিকদের কাছ থেকে তিরস্কার। এ ধরণের সংবাদ সম্মেলনকে কি বলা যায় শুধু সাংবাদিকরা ভাল বলতে পারবেন।
আমাদের দেশে কথায় কথায় শুধু সংবাদ সম্মেলন হয়। শুধু যে ভাল উদ্দেশ্যে এর আয়োজন তা কিন্তু নয়। কেউ জমি দখল করে সংবাদ সম্মেলন করে নিজের মালিকানা দাবী করে। কেই খুন করেও বাঁচার জন্য সংবাদ সম্মেলন করে। কেউ নিজের ঢোল নিজে পেটানোর জন্য সংবাদ সম্মেলন করে। কেউ হাজবেন্ড/ওয়াইফ ফিরে পাওয়ার জন্য সংবাদ সম্মেলন করে। কেউ অন্য ব্যক্তি বা দলের বদনাম করতে সংবাদ সম্মেলন করে ইত্যাদি।
স্পোর্টস কনফারেন্সগুলো সবচেয়ে জমজমাট হয়। গুরুত্বপূর্ণ কোন ম্যাচের আগে ও পরে সংবাদ সম্মেলন অনেকটা বাধ্যতামূলক। এ সময় দলের ম্যানেজার ও অধিনায়ক ম্যাচ নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। কোন কোন সময় সাংবাদিকদের বুদ্ধিদীপ্ত ও তীর্যক প্রশ্ন তাদের বেকায়দায় ফেলে দেয়। এজন্য সতর্কতার সাথে প্রশ্নগুলো সামাল দিতে হয় তাদের। কয়েকমাস আগে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক খেলার ফলাফলে শিশিরের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, আপনি যদি পরিকল্পনা মাফিক খেলতে পারেন তাহলে ম্যাচ জিততে শিশির কোন প্রভাব ফেলবে না! উল্লেখ্য সাকিবের বউয়ের নাম শিশির।
বিখ্যাত পর্তুগীজ ফুটবল ম্যানেজার জোসে মরিনহো সংবাদ সম্মেলনে হাস্য কৌতুক করতে খুব পছন্দ করেন। একদিন দলের রক্ষণাত্মক টেকটিস নিয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ফুটবল হল গোলের খেলা। দিনের শেষে সবাই জিততে চায়। নিজের চাকরি বাঁচাতে, দলকে চ্যম্পিয়ন করতে এর কোন বিকল্প নেই। সুন্দর ফুটবল খেলে হেরে যাওয়া আর সুন্দরী প্রেমিকার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে না পাওয়ার বেদনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
নিজেদের পণ্য ও সেবার প্রচার, এমনকি নিজের পরিচিতির জন্য অনেকে প্রেস রিলিজ বা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে থাকেন। এটা অনেকটা বিজ্ঞাপনের কাজ করে। এজন্য বর্তমানে এটি খুব জনপ্রিয় ও কার্যকরী। তবে জনপ্রিয় পত্রিকাগুলো বেশিরভাগ সময় প্রেস রিলিজ থেকে নিউজ করেনা। তবে জনসার্থে ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু হলে অনেক সময় পত্রিকায় ছাপায়। সেক্ষেত্রে সূত্র হিসাবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি উল্লেখ করতে হয়।
ইতিহাস ঘেটে যতটুকু জানা যায়, আমরা বাঙালিরা কখনো নিজ ভূমিতে স্বাধীন ছিলাম না। খৃষ্টপূর্বে আমরা দ্রাবিড় ও তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী দ্বারা শাসিত-শোষিত হয়েছি। তারপর বারশো শতাব্দী পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে চলে আর্য, গুপ্ত, শশাঙ্ক, পাল ও সেন বংশের রাজত্ব। বারশো শতাব্দী থেকে আঠারো'শো শতাব্দী পর্যন্ত চলে সুলতানি ও মোঘল শাসন। তারপর শোষিত হই যথাক্রমে ব্রিটিশ, ভারতীয় ও পাকিস্তানীদের দ্বারা। স্বাধীন ছিলাম না বলে বাঙালিরা কখনো নিজ ভূমিতে শাসক হতে পারেনি। এজন্য ঐতিহাসিক ভাবে আমরা চাটুকার ও ক্ষমতাবানদের গোলাম হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছি। ফলশ্রুতিতে এ শতাব্দীতে এসেও আমাদের আত্মমর্যাদা ও ব্যক্তিত্বে মারাত্মক ঘাটতি আছে। যার ফলে এখনো ক্ষমতাবানদের রাজা/রাণীর চেয়েও বেশি পূজা করে বঙ্গ সন্তানরা।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ ভোর ৬:০৩