ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। একজন মানুষের মানবিক মূল্যবোধ, পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা, জ্ঞান অর্জন, আচার-আচরণ, সামাজিক দায়বদ্ধতা ইত্যাদি গুণাবলীর সমন্বয়ে ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ব্যক্তিত্বের নিরিখেই নির্ধারিত তার পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা। ছোট বেলা থেকে প্রতিটি মানুষ কোন না কোন ব্যক্তিকে নিজের অজান্তে অনুসরণ-অনুকরণ করে। বড় হয়ে তার মত হতে চায়। এসব ব্যক্তিদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও ব্যক্তিত্ব আমাদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। তবে এই অনুসরণটি নির্ভর করে মানুষের জানার ও বোঝার পরিধির উপর। যে মানুষটি মাদার তেরেসার নাম কোনদিন শুনেনি, মানবতার কল্যাণে তাঁর ত্যাগের কথা জানেনি সে কখনো মাদার তেরেসা হতে চাইবে না।
ছোট বেলায় জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান ছিলেন আমার প্রিয় ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। আমরা কি কখনো ভেবে দেখছি তারা কিভাবে বিশ্বব্যপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন? আমরা কি জানি তাদের সফলতার পেছনে কত ত্যাগ ছিল, বেদনা ছিল, পরিশ্রম ছিল?
আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি কথা বলেন। দেখা যায় বেশি কথা বলার অভ্যাসের ফলে হঠাৎ এমন কোন কথা মুখ ফস্কে বেরিয়ে আসে যা আমরা বলতে চাইনি। এছাড়া বেশি কথা বল্লে প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় আলাপ বেশি হয়। এতে অনেক সময় নিজের বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন সম্বন্ধে এমন কোন গোপন কথা বলে ফেলি যা বলা হয়ত ঠিক হয়নি। যার জন্য আমাদের বিব্রতকর পরিস্থিতর সম্মুখিন হতে হয়। এছাড়া কথা বলতে হবে ধীরে সুস্থে, ভদ্রভাবে।
আমরা অনেক সময় বুঝে অথবা না বুঝে তর্ক জুড়ে দেই, মেজাজ গরম করি, বাজে কথা বলি। অনেক সময় দেখা যায় আমরা যা জানি না তা নিয়ে অযথা বিতর্ক করি। নিজের পরাজয়ের ভয়ে সত্যটা মেনে নেই না। আবার এর বিপরীত ঘটনাও ঘটে। অনেক সময় আমরা নিজের জানা সত্যটি প্রতিষ্ঠা করতে পারি না অন্যের অসহনীয় মনোভাবের কারণে। আমরা সবাই সব বিষয়ে জানি না, জানা সম্ভবও নয়। এজন্য যা জানি না তা নিয়ে বিতর্কে জড়ানো বোকামি ছাড়া কিছুই না। অন্যের বলা সত্যটা মেনে নেওয়ায় নিজের সম্মানহানি হয় না। এতে সমাজে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। যা ব্যক্তিত্বের বিকাশে সহায়ক হয়।
ডাক্তারদের মতে মন খুলে হাসাহাসি করলে নাকি অনেক রোগ থেকে মুক্তি মিলে। হার্ট সুস্থ থাকে। তবে পরিবেশ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে হাসির ধরণ কেমন হবে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্টানগুলোতে অট্টহাসি পরিহার করা বাঞ্চনীয়। এছাড়া কথা বলার সময় বক্তার সাথে আই কন্ট্রাক্ট করতে হবে। কথা শুনার সময় অবশ্যই মনোযোগী হতে হবে, খামখেয়ালি হলে চলবে না। বলার সময় গুছিয়ে অল্প কথায় বিষয়টি শেষ করতে হবে। এছাড়া সমাজ ও পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে আলাপের বিষয় ও ধরণ। নিজের কোন ভুল হলে তর্কে না জড়িয়ে সরাসরি স্যরি বলাটা ভাল এতে উপস্থিত মানুষের মধ্যে নিজের ভদ্রতা পকাশ পায়।
আমাদের মধ্যে অনেকে আছি যারা অনর্গল কথা বলি, অন্য কাউকে বলার কোন সুযোগ দিতে চাই না। এটা খুবই বাজে একটা স্বভাব। এধরণের মানুষকে কেউ পছন্দ করে না। আগে অন্যকে কথা বলতে দিতে হবে, তাদের কথা ও যুক্তি গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। অন্যকে সম্মান দিয়ে কথা বলাটাও জরুরী। কাউকে বোঝাতে যাবেন না আপনিই শ্রেয়।
বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অনেক পরিচিত মানুষের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়। এসময় ধনী-গরীব নির্বিশেষে পরিচিত সবার সাথে মন খুলে কথা বলা উচিৎ। টেবিলে খাবার আসলে অন্যকে আগে দিয়ে পরে নিজের পাতে খবার নিতে হবে। খাবার ভালমন্দ যাই হোক এ নিয়ে কোন বদনাম করা যাবে না। এতে আমন্ত্রণকারী ব্যক্তি শুনলে কষ্ট পাবে। আপনার ব্যাপরে তার বাজে ধারণা জন্ম নেবে। ফলে ভবিষ্যতে এমন অনুষ্ঠানে আপনাকে আর দাওয়াত নাও দিতে পারে, কোন দরকারী পরমর্শ ও বৈঠকে না ডাকতে পারে। এতে পারিবারিক ভাবে আপনার গুরুত্ব কমবে।
অনেক সময় উপযুক্ত দাওয়াত পেয়েও আমরা নিকটাত্মীয়দের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হই না। এটা ঠিক না। সময় সুযোগ থাকলে তাদের দাওয়াতে উপস্থিত হতে হবে, সামর্থ্য অনুযায়ী গিফট দিতে হবে। বিয়ে-সাদির অনুষ্ঠান হলে আগে থেকে খোঁজ খবর নিতে হবে।
অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে চর্চা না করে নিজেকে নিয়ে ভাবাটা জরুরী। আপনি যেমন চান না অন্য কেউ আপনার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে হস্তক্ষেপ করুক, ঠিক অন্যরাও চায় না আপনি তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করুন। এছাড়া সৃজনশীল ভাবে কথা বলাটা জরুরী। বাঁকা ও ইঙ্গিতপূর্ণ কথা পরিহার করা উচিৎ। অন্যের ভাল কাজে উৎসাহ দিতে হবে। খারাপ কিছু চোখে পড়লে তিরস্কার না করে বুঝিয়ে বলতে হবে। পারলে পরামর্শ দিতে হবে যাতে সে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। কাউকে অযথা ক্রিটিসাইজ করা যাবে না।
অনেক সময় আমরা নিজের সামর্থ্য থাকার পরও বারবার অন্যের কাছ থেকে চেয়ে খাওয়ার চেষ্টা করি। অথচ নিজে কখনো তাকে দাওয়াত করে খাওয়াই না। রেস্টুরেন্টে খেতে বসলে অন্যের পকেটের অবস্থা না বুঝে দামী খাবারের অর্ডার দেই। অথচ বিল পরিশোধের সময় অন্যের ঘাড়ে তা চাপিয়ে দেই। এ ধরণের স্বভাব থাকলে যত দ্রুত সম্ভব তা পরিহার করা উচিত। এ ধরণের মানুষদের সবাই পাশ কাটিয়ে চলে। বিশ্বাস করে না, স্বার্থপর ও লোভী ভাবে।
অনেক সময় আমরা বিপদে পড়লে অনেক মিথ্যা কথা বলে টাকা পয়সা ধার করি। অথচ পরিশোধের সময় কোন খেয়াল থাকে না। দিনের পর দিন পার হলেও ঋণের টাকা ফেরৎ দেই না। প্রয়োজনে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেই। বারবার মিথ্যা আশ্বাস দেই। অথচ নিজের সমস্যার কথা মন খুলে তার সাথে শেয়ার করলে, কেন তার ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না তা জানালে লোকটি খুশিই হবে। আপনার প্রতি আস্তা রাখবে। হয়তো লোকটি আপনার সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য কোন পরামর্শও দিতে পারে।
মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশে পোষাক-পরিচ্ছদও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবেশ পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে ড্রেসআপ করাটা জরুরী। এছাড়া পরিচ্ছন্ন ও পরিপটি পোষাক হওয়াটা বাঞ্চনীয়। অনেক সময় পোষাক-আশাক মাননসই হলেও কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় জুতাটি পরিচ্ছন্ন ও মাননসই নয়। চশমার বেলায়ও একই নিয়ম প্রযোজ্য। সম্ভব হলে বডি স্প্রে ও পারফিউম ব্যবহার করা উত্তম।
আমাদের সমাজে অধঃস্থন কর্মচারীদের সাথে আমরা অনেকে বাজে আচরণ করি। এটা পরিহার করতে হবে। নিজের অধঃস্থন কর্মচারিদের সাথে তুই তুকারি করা যাবে না। চিল্লাচিল্লি করা যাবে না। ভদ্রভাবে নিচু গলায় বুঝিয়ে কথা বলতে হবে। মনে রাখবেন আপনি তার চেয়ে বেশি জানেন ও বুঝেন বলেই আপনি তার বস। বস হিসাবে ভুলগুলো শুধরে দেওয়াই আপনার কর্তব্য, বসগিরি করা নয়।
আপনি সামাজিক মাধ্যমে কি করছেন, কি লেখছেন তার উপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। আজ আমার পরিচিত একজনের ফেইসবুকে এগারটি শব্দের একটি স্টেটাস দেখলাম। অবাকের বিষয় বাক্যটিতে তেরটি জায়গায় ভুল। তেরটি জায়গায় ভুলের কারণ হলো বাক্যের মধ্যে দুই জায়গায় অযথা দাড়ি/কমার ব্যবহার। বাকি এগারটি শব্দের সবকয়টি বানান ভুল।
আমরা ফেইসবুকে কি স্টেটাস দেই, কি বিষয়ে লাইক/কমেন্ট করি তা আমাদের ফ্রেন্ড লিস্টের সবাই দেখে। যদিও অনেক সময় তারা আমাদের তা বলে না। আমাদের লেখার ভুল হলে শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে মানুষ প্রশ্ন তুলবে। কাউকে পরোক্ষভাবে থ্রেট করলেও মানুষ বিরক্ত হবে। অন্যকে ছোট করলে, অপমান করলেও ঠিক তাই। অনেকেই আছেন যারা সব সময় ফেইসবুকে ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট করেন, মনে রাখবেন মানুষ এগুলো পছন্দ করে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমন করা যাবে না, সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করা যাবে না। এটা অপরাধ। এজন্য ফেইসবুক সহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলো ব্যবহারে আমাদের আরো সতর্ক হওয়া জরুরী।
নিজেক বুঝতে, পৃথিবীটা জানতে শিক্ষা অর্জনের কোন বিকল্প নেই। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রচুর আউট নলেজ থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার কোন বয়স নেই, মানুষের জীবটাই একটা পাঠশালা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের শিক্ষা নিতে হয়, অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। আপনি পারিবারিক, সামাজিক অথবা রাষ্ট্রীয় যে কোন পর্যায়ে, যে কোন বিষয়ে কথা বলুন না কেন বিষয়টি ভালভাবে জানাটা খুব জরুরী। আর জ্ঞান অর্জন না করলে ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে না। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির জানা, বোঝা ও বোঝানোর ক্ষমতার উপর।
মানবিক মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে মানুষের নিরন্তর প্রচেষ্টা ও বিবেকের পরিস্ফুটনের মাধ্যমে। নীতিবাক্য মুখস্ত করে, বিখ্যাত দার্শনিকদের জীবন দর্শন চোখ কান বন্ধ করে পড়লে কাজের কাজ কিছুই হবে না। এজন্য প্রয়োজন জানার ও শেখার পাশাপাশি নিয়মিত চর্চা করা। আর এগুলো বুঝে নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে। হঠাৎ করে এ গুণাবলী অর্জন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য অল্প বয়স থেকেই শুরু করা আবশ্যক।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৮ ভোর ৪:৪৫