somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমুদ্রে একটি ঝড়ের রাত

১৭ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ১১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যখন পিচ্চি ছিলাম স্কুলে পরীক্ষায় “একটি বর্ষণমুখর রাত” শিরোনামে একটা রচনা আসতো। আপন মনের মাধুরী মিশায়া কত কিছু যে লিখছিলাম। ধুম করে দরজা জানালা বাড়ি খাইছে, মোম নিভে গেছে বাতাসে, গ্লাস ভেঙ্গে গেছে, দানব যেন ধেয়ে আসছে, আহা!!
মার্চেন্ট মেরিনার হয়ে জাহাজে যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মাথায় বুঝলাম ঝড় কি জিনিস। এখন কেউ তো আর লিখতে বলবে না। তাই নিজেই লিখতে বসলাম।
ছোট কালে দা নিউ এডভেঞ্চার সিন্দাবাদের একটা দৃশ্য মনে পড়তেছে। তুমুল ঝড়। সিন্দাবাদের কাঠের জাহাজ প্রবল ঢেউতে রোলিং করতেছে আর সিন্দাবাদ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গান গাইতেছে, “তুমি কাণ্ডারি সবচেয়ে বড় ও আমার খোদা।”
১৭ মে। আমাদের জাহাজ তখন চীনে। উত্তর চীনের একটি বন্দর কফেইডিয়ান। ওখানে কার্গো ডিসচার্জ করে পোর্টের থেকে বের হয়েছে জাহাজ। খুব সুন্দর ঝকঝকে আকাশ, টলটলে নীল পানি। কিন্তু কেন জানি চীনের পোর্ট কন্ট্রোল খারাপ আবহাওয়ার একটা মেসেজ পাঠিয়ে বসে আছে বিকেলের দিকে। কর্মব্যস্ত দিন শেষে সবাই যার যার কেবিনে রেস্টে। আমি ঘুমিয়েই গিয়েছিলাম। হঠাৎ রাত বারোটায় প্রচণ্ড শব্দে আর জাহাজের একটানা দুলুনির চোটে ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার কেবিনে থাকা পানির বোতল, সফট ড্রিংকস এর ক্যান, টুকটাক জিনিসপাতি সব এপাশ থেকে ওপাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে। খাট থেকে উঠে দাঁড়াতেই দুলুনির ধাক্কায় সোফায় গিয়ে পড়লাম। বুঝতে পারলাম ঘটনা সেইরকম। মাথার উপরের কেবিনে নিশ্চই আরও খারাপ অবস্থা। ধুমধাম একটার পর একটা জিনিস পড়ছে। একটু পর ই দরজায় ধাক্কা। CALL OF DUTY. চীফ অফিসার সব ডেকহ্যান্ড কে বের হতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের জাহাজের ফানেলের কাছে একটা লাইনার (ওজন প্রায় ৩ টন, পাইপের মত গোল শেপ) বাঁধা ছিল। কিন্তু প্রচণ্ড ধাক্কায় তা আলগা হয়ে গেছে। যার ফলে এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি খাচ্ছে আর আশেপাশে ব্যাপক ভাংচুর করছে। এটাকে বাঁধতে হবে। টলতে টলতে বাইরে বের হলাম একের পর এক হাত ধরাধরি করে। বের হতেই মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। বাইরে তুষারপাত। সারা গায়ে ভারি জ্যাকেট থাকলেও মুখ তো খোলা। পিনের মত বিঁধছিল যেন। ঘণ্টাখানেক যুদ্ধ করে কোনমতে লাইনার টাকে বাঁধা হল। দুপাশের লাইফ বোট যেকোনো সময়ে ধাক্কার চোটে পড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় ওখানেও এক্সট্রা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হল। ডেকের উপর দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে পানি যাচ্ছে। কার্গো না থাকায় জাহাজের ডেক পানির লেভেল থেকে অনেক উপরে কিন্তু তাও এই অবস্থা।
এদিকে ব্রিজে ক্যাপ্টেন আর ডিউটি অফিসার। জাহাজ তার কোর্স এ রাখাই দুষ্কর হয়ে গেছে। ১০/১২ মিটারের একেক ঢেউ এসে হিট করছে আর আমাদের প্রায় ২০০ মিটার আর প্রায় ৮০০০ টনের লোহার জাহাজ টা কাগজের নৌকার মত ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রকৃতির কাছে যে মানুষ কতটা অসহায় তা আসলে এমন পরিস্থিতিতে না পড়লে কেউ বুঝবে না।
পুরো ৬ ঘণ্টা এই তাণ্ডব চলল। সকাল নাগাদ কিছুটা ঠিক হল। দুলুনির চোটে আমার প্রচণ্ড মাথা ঘুরছিল। কয়েকজন বমি করল। জাহাজের অফিস রুমে দেখার মত দৃশ্য। ফাইল পত্র ছড়ায়া ছিটায়া পড়ে আছে। চেয়ার সব উলতে পালটে একটার উপর একটা। কম্পিউটারের মনিটর সিপিইউ সিকিউর করাই ছিল কিন্তু তাও কিভাবে যে খুলে পড়ে গেছে বুঝলাম না। ক্লাইনোমিটার রেকর্ড করলো যে গত কয় ঘণ্টায় আমরা সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি রোলিং ফেস করেছি। এক যা তা অবস্থা।
অনেকে জিজ্ঞাসা করে আমাকে, ঝড়ের কবলে পড়লে তোমাদের ভয় লাগে না?? তখন ই খালি ভাবি। আসলেই তো। ভয় করেনাই কেন তখন? আসলে প্রতি মুহূর্তে যদি ভয় নিয়ে থাকি তাইলে হয়ত সারভাইভ করতে পারবো না। তাই প্রকৃতি তখন ভয় সরিয়ে যুদ্ধ করতে বলে। সব জাহাজিরা যদি এই ভয় নিয়ে সমুদ্রে পাড়ি দিত তবে পৃথিবীর অর্থনীতি অনেক এলোমেলো হয়ে যেত ।


ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া। ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১২ রাত ৮:৩২
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেচ্ছাপ করি আপনাদের মূর্খ চেতনায়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮

আপনারা হাদি হতে চেয়েছিলেন, অথচ হয়ে গেলেন নিরীহ হিন্দু গার্মেন্টস কর্মীর হত্যাকারী।
আপনারা আবাবিল হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াতে চেয়েছিলেন, অথচ রাক্ষস হয়ে বিএনপি নেতার ফুটফুটে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারলেন!
আপনারা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×