Edgar Allan Poe ‘ছোটগল্প’ সম্পর্কে বলেছেন 'A brief prose tale'. তাঁর মতে শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প সেটিই যা পাঠকমনে একটিমাত্র ঘটনাপ্রবাহের আবেদন সৃষ্টি করে থাকে। রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষাযাপন’ কবিতায় বর্ণিত ‘ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ-কথা’র কথা বাঙালি পাঠকমাত্রই জানেন। এক যুগ আগেও বোধ হয় বাঙালি লেখকরা ছোটগল্পের এই সংজ্ঞাকে আদর্শ সংজ্ঞা হিসেবেই বিবেচনা করতেন। কিন্তু, ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’- রবীন্দ্রনাথের এই কথাটি আজকাল নয় শুধু, রবীন্দ্রপূর্ব যুগেও কেবল ছোটগল্পের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল না- বড় গল্প, উপন্যাস, বলতে গেলে যে-কোনো লেখার ক্ষেত্রেই সমভাবে এই বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’- এর অর্থ ‘অসম্পূর্ণ’ উপাখ্যান নয়, পাঠ শেষে পাঠকের মন এক অদ্ভুত তৃপ্তিতে ভরে উঠবে, সেই তৃপ্তিবোধ থেকেই গল্পের প্রধান চরিত্রের পরিণতির জন্য মনে হতে থাকবে- এরপর আরো কিছু ঘটে থাকবে, ঘটতে পারতো, যা পাঠকের মনে যুগপৎ এক ধরনের অতৃপ্তির জ্বালাও সৃষ্টি করবে। এই বৈশিষ্ট্য উপন্যাস, বড় গল্প, নাটক, এমনকি চলচ্চিত্রের কাহিনী এবং ‘রূপকথা’র জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। একটি দীর্ঘ গল্প এক-কাহিনী নির্ভর হতে পারে, একটি অনতি দীর্ঘ গল্পে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ ও অসংখ্য চরিত্রের উপস্থিতি থাকতে পারে। মাত্র দশ সেকেন্ডের ঘটনা বর্ণনায় উপন্যাস দেখা যায় (অতি সাম্প্রতিককালে আনিসুল হকের ‘ফাঁদ’ উপন্যাসের কথা বলা যেতে পারে)। এক যুগেরও বেশি সময়ের ব্যাপ্তি দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ ছোটগল্পে। আলাউদ্দীন আল আজাদের ‘শীতের শেষ রাত, বসন্তের প্রথম দিন’ মাত্র কয়েক মাস সময়কালের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে নির্মিত উপন্যাস। সময়কালের ব্যাপ্তি, চরিত্র, ঘটনাপ্রবাহ, ইত্যাদি দিয়ে তাহলে উপন্যাস আর ছোটগল্পের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা দুরূহই বটে। কিন্তু দুটো যে এক জিনিস নয়, তা-ও স্বীকৃত। অন্যান্য সকল বৈশিষ্ট্যকে ছাপিয়ে অধুনা বেশির ভাগ গবেষক-সমালোচক বিভাজনরেখা হিসেবে যেটিকে বর্ণনা করে থাকেন তা হলো গল্পের দৈর্ঘ্য। এই দৈর্ঘ্যরে ব্যাপারেও সবাই একমত নন; কারো মতে দশ মিনিটের মধ্যে পড়ে শেষ করা গেলে সেটি ছোটগল্প হবে, এভাবে পনর-বিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিট পর্যন্ত পড়ার সময়কালকে কেউ কেউ ছোটগল্প বলে থাকেন, আর এর চেয়ে বেশি সময় লাগলে সেটি আর ছোটগল্প থাকে না, হয়ে যায় বড় গল্প বা উপন্যাস। ছোটগল্প ও উপন্যাস সম্পর্কে ইংরেজি সাহিত্যে আরেকটি ধারণা প্রচলিত আছে- উপন্যাস হলো ছোটগল্পের বর্ধিত সংস্করণ, ছোটগল্প উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত রূপ। তাহলে ‘বড় গল্প’র স্থান কোথায়? ভারতীয় পত্রপত্রিকায় উপন্যাসের পাশাপাশি ‘বড় গল্প’ শিরোনামে গল্প ছাপা হতে দেখা যায়, সেগুলোকে পরবর্তীতে একক গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হতেও দেখা যায়। এগুলোর আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, একমাত্র এর দৈর্ঘ্য ছাড়া- যা প্রচলিত ‘ছোটগল্প’র চেয়ে আকারে বড়, কিন্তু প্রায়শই প্রচলিত বহু ছোট-উপন্যাসের দৈর্ঘ্যরে সমান। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় ‘বড় গল্প’ হিসেবে প্রকাশিত গল্প কখনো দেখেছি কিনা আমার মনে পড়ে না। তবে ২০০৫ সনে বিভিন্ন ঈদ-সংখ্যায় (ঈদুল ফিত্র) ‘উপন্যাসিকা’ প্রকাশিত হতে দেখা গেলো; এর আগেও হয়তো ‘উপন্যাসিকা’ প্রকাশিত হয়ে থাকতে পারে, তবে আমার নজরে পড়ে নি। ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে’ ‘উপন্যাসিকা’ অর্থ লিখা হয়েছে ‘ক্ষুদ্র উপন্যাস’ বা ‘novelette’. সেখানে ‘উপন্যাস’ অর্থ লিখা হয়েছে ‘দীর্ঘ আখ্যায়িকা; বড়ো গল্প’। Oxford Dictionary-তে novelette-এর অর্থ লিখা রয়েছে ‘a short novel, esp one of poor literary quality’. ইংরেজি সাহিত্যে আরেকটি নাম আছে এই বড় গল্পের- novella, যার অর্থ ‘a short novel’. জার্মান, ফ্রেঞ্চ এবং ইটালীয় ভাষায় মূলত ছোটগল্পকেই ‘নভেলা’ বলা হলেও বর্তমানে আমেরিকাতে novelette আর novella নাম দুটোকে অভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলোকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এভাবে- আকারে ছোটগল্পের চেয়ে বড়, তবে উপন্যাসের মতো অতোখানি দীর্ঘ নয়। এই ‘বড়’র আবার একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, যা একেবারে অলঙ্ঘ্য নয়, তা হলো- novelette বা novella-র শব্দসংখ্যা হবে বিশ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার; পঞ্চাশ হাজার শব্দের অধিক হলে তা হবে ‘উপন্যাস’, আর বিশ হাজার শব্দের কম হলে সেটি ‘ছোটগল্প’ হিসেবেই বিবেচিত হবে। শব্দসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলা-গল্পের শ্রেণীবিন্যাস অসম্ভব। বর্তমানে প্রকাশিত উপন্যাস সমূহের খুব কমই আছে যার শব্দসংখ্যা দশ হাজারের উপরে। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র শব্দসংখ্যা তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার হবে। কিন্তু এটি ‘উপন্যাসিকা’ নয়, বাংলা সাহিত্যের একটি অতি উচ্চাঙ্গীয় উপন্যাস।
‘অণু-উপন্যাস’ নামটি সবুজ অঙ্গনের নিজস্ব। সবুজ অঙ্গনের নিয়মিত (সপ্তম) সংখ্যায় আমরা এ নামটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ নামেই আমাদের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। উপন্যাসিকা, novelette বা novella থেকে ভিন্ন অর্থে ‘অণু-উপন্যাস’ নামটি ব্যবহার করার ইচ্ছে বা যৌক্তিকতা আমাদের নেই। ‘অণুগল্প’, ‘অণুকাব্য’, ‘অণুপদ্য’, ইত্যাদি ক্ষেত্রে ‘ক্ষুদ্র’ত্ব প্রকাশার্থে শব্দের সাথে ‘অণু’ বিশেষণটি যোগ করা হয়ে থাকে, (যা বর্তমানে একটি বহুল প্রচলিত ধারায় পরিণত হয়েছে); একই ভাবে গ্রন্থের ‘ক্ষুদ্র’ত্ব বোঝাবার জন্য ‘গ্রন্থ’ শব্দের সাথে ‘অণু’ যোগ করে ‘সবুজ অঙ্গন সাহিত্য সংকলন ২০০৫, কবিতা ও ছোটগল্পের ১৭টি অণুগ্রন্থ একত্রে’ প্রকাশ করেছিলাম অমর একুশে বইমেলা ২০০৫-এ। সেই ধারাবাহিকতায় উপন্যাস নামের সাথেও আমরা ‘অণু’ শব্দটি যোগ করেছি মাত্র, যা ‘উপন্যাসিকা’র প্রতিশব্দ হিসেবেই আমরা সূচনা করতে চাই। কোন্টি গল্প এবং কোন্টি গল্প নয় (অর্থাৎ গল্প হতে পারে নি), তা বোদ্ধা পাঠক-সাহিত্যিকের বিবেচ্য বিষয়; আমরা আপাতত গল্পের দৈর্ঘ্যরে ভিত্তিতে বাংলা অণু-উপন্যাসের সীমারেখা নির্ধারণ করতে আগ্রহী। দশ মিনিটে পড়ে শেষ করা গল্পকে ছোটগল্প বললে হঠাৎ করেই বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে, ছোটগল্পের সংখ্যা যাবে একেবারে কমে; আবার পঞ্চাশ হাজার শব্দের অধিক হলে যদি তা উপন্যাস হয়, তাহলে অজস্র উপন্যাস হয়ে যাবে নিছক ‘উপন্যাসিকা’। আমরা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি তা হলো- মোটামুটি পাঁচ হাজার শব্দ হলেই একটি গল্পকে ‘অণু-উপন্যাস’ বলা যেতে পারে, প্রচলিত পদ্ধতিতে ছাপা বইয়ে যার পৃষ্ঠা সংখ্যা পনর-ষোল হয়ে থাকে; এই দৈর্ঘ্যরে গল্পকে ছোটগল্প বলতে অনেক পাঠকের অনীহা আছে বলে আমরা ঠিক এই শব্দসংখ্যা ও আকার থেকেই ‘অণু-উপন্যাস’ সংজ্ঞায়িত করবো। কারিগরি দিক থেকে চার ফর্মার নিচে কোনো বই বাঁধাই করলে তা সুদৃশ্যও হয় না। এই বিবেচনায় তিন ফর্মা বিশিষ্ট গল্পটিকেও আমরা ‘অণু-উপন্যাস’ বা ‘উপন্যাসিকা’ বলবো, যা অতিক্রান্ত হলে তা একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যসের মর্যাদা পাবে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:১০