অনেকে মিটিমিটি হাসছেন- আমাকে হয়তো 'প্রথম' মুদ্রাদোষে পেয়ে বসেছে। একদম ঠিক। মাথায় কিছু আসছে না- না কবিতা, না গল্প, না অন্যকিছু। এ অবস্থায় বেশ কিছুদিন চলে যাওয়ার পর হঠাৎ হঠাৎ একেকটা জিনিসের কথা মনে পড়ে আর নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন করি- কবে যেন প্রথম এটা করেছিলাম!
এইতো সংক্ষিপ্ত পটভূমিকা।
মোটামুটি ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত আমি বইয়ের পোকা ছিলাম- সামনে যা পেতাম গোগ্রাসে কাটতাম আর চিবুতাম। তবে আপনাদের মতো অতো না আবার।
কিন্তু এতো বই কোথায় পাবো? সপ্তম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায়ই নবম-দশম শ্রেণীর বাংলা বই পড়ে ফেলেছি- বিশেষ করে গল্পগুলো। সেকালে আমাদের অজগ্রামে কেন, হাইস্কুলেও কোনো খবেরের কাগজ যেতো না। স্কুলে যে একটা লাইব্রেরী আছে তাও জানতে পেরেছিলাম অনেক পরে।
তো, এতো বই কোথায় পাবো? কিনে বই পড়ার মতো সামর্থ্য আমার ছিল না। তবে এখানে-সেখানে 'চটি' জাতীয় কিছু বই মাঝে মাঝেই ক্লাসমেটরা একত্র হয়ে রসিয়ে রসিয়ে পড়ি- এক হাত থেকে আরেক হাতে যেতে যেতে একসময় ভুলে যাই এর মালিক কে ছিল- ভুলে যাই বর্তমানে বইটা কোথায় কার কাছে আছে।
খুব পড়ুয়া পরিবারের দু-তিনজন ক্লাসমেট ছিল। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের দিন, যেমন নজরুল-রবীন্দ্র-জসীম উদ্দীন জন্মজয়ন্তীতে তাঁদের কবিতার বই ওরা নিয়ে আসতো। ওদের কাছ থেকে নিয়ে পড়তাম। বাসায় নিয়ে যেতাম। আমার এই পড়ার নেশা সম্বন্ধে ওরা যখন বুঝতে পারলো, নিজেরাই বললো- আমাদের বাসায় তো কাঁড়ি কাঁড়ি বই, পড়ার কেউ নাই। তুই পড়বি নি? পড়বার পারোস।
ওর নাম জাহিদ। বললাম, কাল আমার জন্য একটা বই নিয়া আসিস।
জাহিদ পরের দিন আমার হাতে যে বইটা এনে তুলে দিল ওটার মলাট ছিল না। মলাটের পরের সাদা পাতাটা ময়লা আর ছেঁড়াছেঁড়া মতো হয়ে গেছে। তাতে কী- বইটা হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উলটাতে থাকি।
শেষের কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি তখন সপ্তম অথবা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি, সঠিক মনে নেই। পাঠ্যপুস্তকে কবি-পরিচিতি আর শিক্ষকদের কাছ থেকে শোনা জ্ঞান থেকে অল্প অল্প চিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- কাজী নজরুল ইসলাম- আর জসীম উদ্দীন। স্কুলে খুব আড়ম্বরের সাথে এঁদের জন্ম বা মৃত্যুদিবস পালিত হয়, অন্য কবিদের না- পাঠ্য বইয়ের কবিতা বা আর কারো কাছে পাওয়া বই থেকে মাঝে মাঝে অনুষ্ঠানে তাঁদের কবিতা পড়ি। তাঁদের সম্বন্ধে আর কতোটুকুই বা জানি!
আমি শেষের কবিতা পড়তে শুরু করি। ক্লাসের পড়া, বাড়ির কাজ আর খেলাধুলার সময় সহ বইটা পড়ে শেষ করতে আমার চার-পাঁচ দিনের মতো লাগে।
বইটা পড়ার সময় বিশেষ কয়েকটা অংশে আমি খুব আপ্লুত হয়ে পড়ি।
ভীরু যতীন্দ্র লাল চুপিসারে লাবণ্য'র ড্রয়ারে চিরকুট লুকিয়ে রাখতো- যাতে লেখা থাকতো লাবণ্য'র প্রতি তার নিবেদন, কিন্তু মুখ ফুটে বলার দুঃসাহস তার কোনোদিন হয় নি।
আরেকবার লাবণ্য অমিতকে নিয়ে চলে যায় সেই পাহাড়ের ধারে কোনো এক গোধূলিবেলায়, যেখানে দাঁড়িয়ে এমনি আরেকদিন লাবণ্যকে সে একটি আংটি পরিয়ে দিয়েছিল- লাবণ্য সেদিন এটা ফিরিয়ে দেয়।
বইটার এক জায়গায় গিয়ে আমার খুব খারাপ লেগেছিল, কান্না চলে এসেছিল। অমিত যোগমায়াদের বাড়ি গেছে। কিন্তু যোগমায়ারা আর আগের বাড়িতে নেই। "ঘর বন্ধ, সবাই চলে গেছে, কোথায় গেছে তার কোন ঠিকানা রেখে যায় নি'।" অমিত লাবণ্যের বসবার ঘরে গেল। "সেই ঘরটার মধ্যে বোবা একটা শূন্যতা। তাকে প্রশ্ন করলে কোন কথাই বলতে পারে না। সে একটা মূর্ছা, যে মূর্ছা কোনোদিনই আর ভাঙবে না।" তারপর অমিত নিজের কুটিরে গেল। যোগমায়া যা যেমন রেখে গিয়েছিলেন তেমনি সব আছে। এমন কি, যোগমায়া অমিতকে দেয়া তাঁর কেদারাটিও ফিরিয়ে নিয়ে যান নি। যেন স্নেহ করেই এই কেদারাটি তিনি অমিতকে দিয়ে গেছেন। অমিত যেন শুনতে পেল শান্ত মধুর স্বরে তাঁর সেই আহ্বান - 'বাছা'!
আর সবচেয়ে খারাপ লেগেছে লাবণ্য'র লেখা কবিতাটা, যা সে অমিতকে লক্ষ্য করে লিখেছিল :
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও
তারই রথ নিত্যই উধাও
বুকের ভেতর মোচড় দিয়েছিল এ কথাটা- হে বন্ধু বিদায়। আমার সেই কচি মনে কেবলই মনে হতো- এরপরও আরেকটু থাকতে পারতো, এ কবিতার উত্তরে অমিতের কিছু একটা, তাহলে হয়তো মনটা প্রশমিত হতো। এমন ভেবেছি আরো অনেক অনেক বার।
এরপর আরো বহুবার শেষের কবিতা পড়েছি। শেষের কবিতা সম্বন্ধে অনেকেই বলে থাকেন- এ উপন্যাস পাঠের জন্য কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই, এটা সর্বকালের সব বয়সের পাঠকের জন্য উৎকৃষ্ট ও যথোপযুক্ত রচনা- আপনি যে বয়সেই পড়বেন, মনে হবে আপনার বয়সের জন্যই এটা লেখা হয়েছে- আপনি যতোবার পড়বেন, ততোবারই এটা আপনার কাছে আনকোরা নতুন মনে হবে- মনে হবে এই কথাটা, এই লাইনটা তো আগের বার পড়ি নি।
নবম শ্রেণীর মাঝামাঝি সময় থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত আমাকে এমনভাবে পেয়ে বসলো যে বলতে গেলে অন্য কোনো গানই আমার ভালো লাগতো না। এই ভালো লাগার মূলে ছিল শেষের কবিতা, আর রবীন্দ্র সঙ্গীত রক্তের ভেতর ঢুকে যাওয়ার পর একদিন অনুভব করি- আমার রক্তকণিকায় শুধু গান আর সুরের তরঙ্গই বয়ে যাচ্ছে- অবিরাম অবিরল কলকল ছন্দে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৫৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



