সাগর: আবার? তোমাকে না বলেছি আর বেশি ওর কাছে যেতে পারব না।….
রুনি: কেন সাগর? আমি আমার ছেলের কাছে যাব না?.....
সাগর: কিভাবে যাব? জীবিত মানুষ থেকে যে আমরা অনেক দূরে……….
রুনি: আমরা কেন মৃত সাগর? আমাদের বেঁচে থাকবার কথা ছিল……..
সাগর: কথা তো কত কিছুই ছিল….. কই থাকেনি তো!!.....কথা বলে কিছু নেই …রুনি…
রুনি: আমার ভাল লাগছে না…. সেদিন ছেলেটার অন্নেক জ্বর ছিল….মা! মা! করে কত্ত ডাকছিল….চলো না সাগর! দেখে আসি…………..
সাগর: হুম! …. আমি জানি তুমি খুবই কষ্টে আছ…. জ্বর মনে হয় ঠিক হয়ে গেছে……আর তুমি কি করে জানলে ওর অন্নেক জ্বর?
রুনি: তুমি কষ্টে নাই? লুকিয়ে কি হবে সাগর? আমি ওর মা… আমি সব জানি….জানতে পারি….
সাগর: তুমি তো ওকে ছুঁয়ে দেখতে পারনি…. কি করে জান অন্নেক জ্বর….. ভেবনা ঠিক হয়ে যাবে….
রুনি: ভুলে যাও তুমি? আমি ওর মা। আমি ওকে দেখলেই বুঝতে পারি সব…..
সাগর: আচ্ছা চলো যাই। তবে….. মনে হয় বেশিক্ষণ থাকতে পাবরনা…. এখন ওদের অনেক রাত…… ভোর হওয়ার আগেই চলে আসতে হবে….
রুনি: ইস! তুমি কত্ত ভাল …! আমি আজকে আর একটুও বেশি দেরী করতে চাইবনা……ভেবনা তো! চলো যাই…..
মেঘের ঘরে ওর বিছানার পাশে…………
রুনি: মেঘ! মেঘ! এখন কেমন আছিস…..বাবাই..?
সাগর: রুনি! ও ঘুমাচ্ছে…দেখ কি শান্ত আর স্নিগ্ধ……!
রুনি: আমি তো ওকে জাগাবনা….. একটা চুমু দিতে পারব?
সাগর: রুনি! … তুমি কেন ভুলে যাও যে তোমার স্পর্শ ….ও কখনই অনুভব করতে পারবেনা…….আমরা এখন মৃত….
রুনি: না বুঝতে পারুক! আমি ওকে একটু আদর দিবই….. প্লিজ! তুমি না করোনা…….আমার মনটা ওকে স্পর্শ করতে কতটা অস্থির…. তুমি বুঝতে চেষ্টা কর…সাগর!
সাগর: কি লাভ এত কষ্ট পেয়ে? সবই তো শেষ হয়ে গেছে….ওহ!
রুনি: আমি অনেক দুঃখিত সাগর!.....আমি তোমার কষ্টটাও বুঝতে পারছি…..কেন এমন হল বলনা? কি অপরাধ করেছিলাম আমরা? …এই অন্যায়ের কি কোন বিচার নেই?
সাগর: আছে…শেষ বিচারে আছে...আল্লাহ করবেন বিচার….. তবে দুনিয়াতে নেই….ওরা বিচার করার মিথ্যা পতিশ্রুতি দেয়…… কিন্তু বিচার করে না। …..আমাদের বিচার ঢাকতে ওরা নানা রকম মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে…ওদের অবস্থা হল এমন……কান টানলেই মাথা আসবে…. মাথা আসলেই লোকে জেনে যাবে… জনগনকে ওরা কি বলবে…. ..তাই কানই টানবেনা……
রুনি: ওরা কি মানুষ ,..সাগর? ওরা আমাদের ছেলেটার মুখের দিকে কি তাকায়না?
সাগর: ওরা তাকায়…. ব্যবসার দৃষ্টিতে তাকায়….যত তাকাবে ততই লাভ হবে…. ওকে নিয়েও কয়েকদিন করেছে… আবোল তাবোল মন গড়া কাহিনী রটিয়েছে ওর মুখের কথা থেকে….
রুনি: ওরা আমাদের থেকে আমাদের ছেলেকে আলাদা করেও কি তৃপ্ত না? ছেলেকে নিয়েও রাজনীতি করছে…আমরা কি কিছুই করতে পারিনা?,,সাগর!
সাগর: পারি…ঘৃণা করতে...আরও পারি আল্লাহর কাছে বিচার চাইতে….ওদের কোন ক্ষমা নেই….ওরা তোমার চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে…..
রুনি: উফ! আমি কিছুই আর ভাবতে পারিনা….. ওরা কি মানুষ খেকো?আর কত রক্ত ওদের তৃপ্ত করবে….?
সাগর: অবাক কি জানো… রুনি…?
রুনি: কি বল?
সাগর: আমাদের সহকর্মীরা…ওদের মধ্যেও ভাগ হয়েছে…যারা আমাদের সত্যি ভালবাসত…..ওরা এখনো লড়ছে….. সরকারকে নানা ভাবে চাপ দিচ্ছে.,…আমাদের খুনিদের খুঁজে বের করে… তাদের বিচার করতে…..
রুনি: আর অন্যরা? আচ্ছা? সরকারকে্ এই বিচারটা করার জন্য এত চাপ দিতে হচ্ছে কেন?....আমাদের প্রধান মন্ত্রী তো জানেন …প্রিয়জন হারানোর ব্যাথা কি? উনি কি আমার নিষ্পাপ ছেলেকে দেখেন না?
সাগর: দেখেন মানে কি? উনি তো মেঘকে কাছে নিয়েই রেখেছিলেন….তবুও তো কিছু করলেন না… এখন আর মানুষের হারানোর ব্যাথা বলে কিছু নেই..রুনি….. সব এখন টাকার কাছে বিলিন হয়ে গেছে…..
রুনি: তুমি বললে…যে ওদের মধ্যে ভাগ হয়েছে….?
সাগর: আমাদের সহকর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ শুরুতে আমাদের হত্যার বিচার চাইতো….কিছুদিন পরেই তারা কিভাবে বদলে গেল!… এখন উল্টা কথা বলছে….,.তারা এখন আর বিচার চায়না…..ওদের তো হত্যাকারীদের সাথেই দেখা যাচ্ছে আজকাল…..
রুনি: কেন সাগর? ওদের এই বদলে যাওয়ার কারন কি? ওরাও কি টাকার কাছে বদল হল?
সাগর: তাই তো মনে হয়…দুনিয়াটা চলছে টাকার কাছে…ওদরে দোষ দিয়ে লাভ কি?...রুনি!...... ছেলেকে তাড়াতাড়ি আদর কর…. মনে হয় খুব শিঘ্রই ভোর হয়ে যাবে…..
( রুনি মনে মনে আল্লাহর কাছে দু’আ করল…হে আল্লাহ! একটি বার আমাদের ছেলেকে আমাদের স্পর্শটুকু অনুভব করার শক্তি দাও।)
রুনি ছেলেকে খুব করে চেপে ধরল….আলতো করে ..অনেক গুলি চুমু দিল গালে, কপালে…..
সাগর আর রুনি অবাক হয়ে দেখল….মেঘ! তাদের বাবাই! চোখ খুলে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে…আর নিষ্পাপ ভাবে হাসছে…..
মেঘ: মামুনি! বাবাই! ..তোমরা? এতদিন পরে…..! কোথায় চলে গিয়েছিলে?..ইস! মা!... কত্তদিন পরে চুমু দিলে!..দেখ আমি তোমাদের ছাড়া কেমন একা হয়ে গিয়েছি..কিছুই ভাল লাগেনা……
রুনি: আমার মানিক! আমার সোনা! তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছ….মা আর বাবাকে মনে পড়ে খুব? কষ্ট হয় রে?..জ্বর কি সেরেছে? সবাই কি ঠিক মত খেয়াল রাখছে?
মেঘ: মামুনি!...ইস! এক সাথে এত্ত প্রশ্ন? হুম!..এই দেখ…আমি এখন আছি ভালই….সবই তো ঠিকই ছিল…শুধু তোমরা ছিলেনা…বাবাই!
সাগর: বাবাই সোনা!...তুমি নানুর আর বাসার সবার কথা শুনছো তো?... আর মন খারাপ করবেনা একটুও…. পড়া লিখা করবে সময় মত….খেলতে ইচ্ছে করলে খেলবে!..বেড়াতে ইচ্ছে করলে বেড়াবে….অনেক মজা করবে…..
মেঘ: তাতো করবই ..এখন তোমাদের পেয়েছি না!
রুনি: (কান্না চোখে) সাগর! আমার মেঘকে রেখে যেতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছেনা….আমি থাকি… না?
মেঘ: আবার কোথায় যাবে তোমরা?....না..না..না..না…. যেতে দিব না…কোনদিনই না…
(এই বলে মেঘ মাকে জড়িয়ে ধরে)
সাগর: না..রে বাবাই…আমরা আর এখানে থাকতে পারবনা…. আমরা তো বেঁচে নেই….কি করে তুমি আমাদের দেখতে পারছ আমি জানিনা…আল্লাহর ইচ্ছা বোঝাই কঠিন… সত্যিই আমাদের এখুনি যেতে হবে…..তুমি নিজের খেয়াল রেখ….বড়দের কথা শুনবে…. আমরা আবারও আসব…..ইনশাল্লাহ…
রুনি: প্লিজ! সাগর! কিছু একটা কর….. আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে…আমার ছেলেকে ছেড়ে…আমি কোথাও যাবনা….
সাগর: (কষ্টের হাসি হেসে) পাগলামী করোনা …রুনি… তুমি তো জান এটা সম্ভব না….আর তুমি তো আসার আগে বলেছিলে…. ছেলের সাথে দেখা করে ফিরে যাবে তাড়াতাড়ি….ভুলে গেছ?
রুনি: নাহ! আচ্ছা চল….আসলেই ভোর হয়ে আসছে… মেঘ! কাদিস না আমি আর তোর বাবা চলে গেলে ,,,,আমরা আবার আসব…এখন এটাই যে আমাদের নিয়তি…আমি জানি তুই বুদ্ধিমান ছেলে….তুই ঠিকই নিজেকে সামলে নিবি….তুই ঠিকই একদিন বড় হবি..অন্নেক বড়…তোকে আমাদের হত্যার শোধ নিতে হবে….প্রতিশোধ! এখন চোখের পানি মুছে ফেল! আমার দু’আ্ আছে তোর সাথে…. মানু্ষের মাঝে সেরা মানুষ হবি তুই…একদম কাঁদবিনা… কারো কাছে এই হত্যার বিচার চেয়ে মিনতি করবিনা… আল্লাহ ই বিচার করবেন…..
মেঘ: মা! তোমাদের কি আমার কাছে থাকার কোনই উপায় নেই?
রুনি: না! ভাল থাকিস বাবু সোনা ! এখন যাই? আয় যেতে যেতে একবার চুমু দেই গালে…..
সাগর: আয় সোনা! বাবাইও আদর দিবে…. খুব ভাল থাকিস…সোনা আমার….
মেঘ: তোমরাও ভেবনা….আমি তেমনই থাকব…তোমরা যেমনটি চাও…আমি ইনশাল্লাহ একদিন বড় হব….ওদের শাস্তির ব্যবস্থা কবর…. যারা আমার কাছ থেকে আমার সবকিছু- মামৃনি-বাবাই কেড়ে নিয়েছে…
(বিদায়…..!!!.....আবার দেখা হবে……. বলে উঠে একসাথে ওরা সবাই…রুনি-মেঘ-সাগর…….
দূর থেকে ভেসে আসছে…ফজরের আযানের মধুর বাণী…….)
Tania Hasan Khan
Time :6:34 pm
Date: 8/12/12
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১১:৩৬