আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক-আমাকে বললেন , ঘটনাটি সবার নজরে আনার জন্য। আমি একলাইন পড়ি আর চোখের জলে মর্মরিত হই। বললাম, ভাই, আমিতো অশ্রু ধরে রাখতে পারছিনা। লিখবো কেমন করে?
উনি বললেন- বিবেক কি বলে?
বিবেকের চোখতো ভাই অন্ধ হয়ে গেছে, বিবেক আজ এই চারমাস বয়সী শিশুটির মতো বাকহীন যাকে মাতৃগর্ভেই প্রথমবার খুন করা হয়েছে।
ইয়াসীনের নিঃস্ব , অসহায়, হতদরিদ্র মা রাতের আকাশে চাঁদ দেখেন। আর পেটের ওপর হাত রেখে এক মাংস পিন্ড চাঁদের স্পর্শ অনুভব করেন। ইয়াসীন চাঁদ হয়ে মায়ের গর্ভে ধীরে ধীর বড় হয়।
ঘটনার দিন সন্ধ্যা। ইয়াসীনের মা সারাদিন মহল্লায় কাজ করে নিজ বস্তিতে ফিরেন। ঠিক এমন সময় হানা দেয় মানুষরুপী জানোয়ারের দল।
ইয়াসীনের মা সহ একই ঘরের ছয়জন মহিলাকে সম্পূর্ন বস্ত্রহীন করে হায়েনার দল প্রথমে অমানষিক নির্যাতন করে। তারপর ক্রিকেট ব্যাট আর স্ট্যাম্প দিয়ে ইয়াসীনের মা'কে পিটাতে থাকে বড় নির্মমভাবে।
অপরাধ ইয়াসীনের মা একটি ছয়তোলা স্বর্ণের চেন চুরি করছে।
ইয়াসীনের মা বলে- তোমরা আমার পিটে যতপারো মারো, কিন্তু আমার পেটে মারোনা। তোমরা আমার বাপ হও, আমার সোনা মানিকের কান্না আমি শুনতে পারছি। বাবারা, পেটের ভিতর চাঁদকণার হাড় ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। খোদার দোহাই তোমার আমার পেটে মেরোনা।
কিন্তু হিংস্র জানোয়ারের দল সেকথায় ভ্রক্ষেপ করেনি। পেটের ওপর লাত্থি মারতে থাকে,ক্রিকেট স্ট্যাম্প আর মেটাল স্ট্রিং দিয়ে পেটাতে থাকে অনবরত। একসময় হায়েনার দল ক্ষান্ত হয়।
এই ঘটনার ১ মাস পরে ভাষানটেক বস্তিতে মায়ের পেটের ভিতরেই নির্মম অত্যচারের স্বীকার চাঁদশিশু ইয়াসীনের জন্ম ।
জন্মের পর থেকেই ইয়াসীনের অসহায় চোখ। যে চোখ শুধু জল। সে ছিলো একেবারে বাকহীন। হাত-পা সব নিস্তেজ, অবশ। ইয়াসীন শুধু বোবা চোখে চেয়ে থাকতো এই বর্বর, পাষন্ড, নির্মম, নিষ্ঠুর, খুনী মানুষের পৃথিবীর দিকে।
ইয়াসীনেের দাদী বলেন- আমরা বুঝতে পেরেছি , ও মায়ের গর্ভে থাকাকালীন খুন হয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য্য এ ছেলে প্রাণ নিয়ে জন্ম নিলো কেমন করে?
ডাক্তার দেখাননি কেন- এর জবাবে দাদীমা বলেন-
আমরা বস্তির মানুষ। দিনে আনি দিনে খাই। বস্তিতে জন্ম , বস্তিতেই মৃত্যু। ডাক্তার দেখাবার অতো টাকা কই?
জন্মের ঠিক চারমাস পর। ইয়াসীন কাউকে কোনো অভিশাপ দেয়নি। কারো বিরুদ্ধে কোর্টে কোনো মামলা দায়ের করেনি। কে জয় বাংলা আর কে জয় পাকিস্তান বলেছেন এর ও কোনো খবর রাখেনি। ইয়াসীন শুধু দু চোখ চিরতের বন্ধ করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।
ইয়াসীনের চারমাস জীবনের মূল্য হলো মাত্র ছয় তোলা সোনা। বর্তমান বাজার মুল্যে দুই লক্ষ সতেরো হাজার তিনশ ছয় টাকা মুল্যের সম্পদ । চুরির কথিত অপরাধে যদি সোনার মালিক পক্ষ প্রসুতি মাতা এবং মাতৃগর্ভে অবস্থান কালীন একটা শিশুর জীবননাশের আয়োজন করতে পারে, তবে যাদের কথিত দুর্নীতির কারনে $1.2 billion (বর্তমান বিনিময় হারে নয় হাজার ছয়শত কোটি চব্বিশ লক্ষ টাকা) এর চেয়েও অনেক বেশী মুল্যের পদ্মা সেতু প্রকল্পে সবচেয়ে কম সুদের হারে অর্থ লগ্নীতে সম্মত প্রধান বিনিয়োগকারীকে হারাতে হলো, তাদের কি হবে?
সেই প্রশ্নের উত্তর জানি কোনোদিনও পাবোনা। তবে মৃত্যুর আগে ইয়াসীন শেষবার মুতেছিলো। না প্রস্রাব করেনি, হিসু করেনি। বস্তির ছেলেদের যা বের হয় তা প্রসাব না, হিসু না। এটা সরাসরি মুত।
ইয়াসীনের মা সন্তানের বুকের কাছে কান রাখলেন ।সোনা মানিক চাঁদের কণার শেষ নিঃশ্বাস কি বন্ধ হয়ে গেলো তা বুঝার জন্য।
ইয়াসীন মা' কে বললো-
জন্মের পরই পা অবশ লাথ্থি দিতে পারিনা, হাত অবশ চড় দিতে পারিনা। কিন্তু এই বিচার, এই আদালত, এই ন্যায়পরায়ণতা, এই সভ্যতা আর এই মানবতায় মুতে দিয়ে গেলাম।
ঘটনাটি ঘটেছিলো ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সালে ভাষানটেক বস্তিতে, জয়বাংলা আর জিন্দাবাদের শ্লোগানের মাঝে ইয়াসিনের মুত শুকিয়ে গেছে, ইয়াসীনের লাশ কবরে পচে গেছে। কিন্তু কোনো মানবতাবাদী, কোনো টিভি মিডিয়া, কোন টক শো সে খবর রাখেনি।
ইয়াসীন যদি কোনো নেতা হতো , অথবা কোনো নেতার পুত্র হতো, কোনো দলীয় ক্যাডার হতো, কোনো সংবাদকর্মী হতো, কোনো লেখক হতো, কোনো কবি হতো, কোনো নাস্তিক হতো, কোনো আস্তিক হতো, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়,কলেজের শিক্ষার্থী হতো, কোনো মিছিলের বজ্রাক্রোশের শ্লোগানকর্মী হতো তবে ইয়াসীনের মৃত্যু পত্রিকা, সংবাদ, টিভি মিডিয়া, ব্লগে , ফেসবুকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক চড়ামূল্যেই বিক্রি হতো। কিন্তু ইয়াসীন কোনো মানবশিশু না। সামান্য এক বস্তির পোলা। এর সামাজিক প্রচার মূল্য জিরো।
জোয়ারের জলে ভেসে এসে একবার এক সমূদ্রচরে অনেক কাঁকড়া আটকা পড়েছে। আর ঝাঁকে ঝাঁকে শকুনচিল হানা দিয়েছে । একজন লোক হেঁটে হেঁটে একটা করে কাঁকড়া ধরে আর সমূদ্রের জলে নিক্ষেপ করে। লোকটির কান্ড দেখে -পাশ থেকে একজন বললো - ভাই আপনি কয়টা কাঁকড়া বাঁচাবেন। আর এতে তো তেমন কোনো পার্থক্য দেখছিনা। সবগুলোইতো শকুনের পেটে যাবে।
লোকটি ঠিক তখন আরেকটি কাঁকড়া হাতে নিয়ে সমূদ্রের পানিতে ছেড়ে দিয়ে বললো- এই যে আরেকটাকে বাঁচালাম। আর অন্ততঃ এতটুকু পার্থক্য তৈরী করলাম।
আজ এসব অসহায় মানুষের মৃত্যু ও দেখতে দেখতে হয়তোবা আমাদের জন্য একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেছে।এর কয়টার প্রতিবাদ হবে?
একজন অসহায় নিরাপরাধ শিশু ইয়াসীনের জন্য প্রতিবাদ করে অন্ততঃ ধূলোপরিমাণ দায় শোধ করলাম। জানিনা তোমার এ চোখের অসহায় আকুলতা ক'জনের নজরে আসবে। ক্ষমা করো ইয়াসীন।
ছবিসূত্রঃ ডেইলি স্টার।ইয়াসীনের অসহায় চোখ দুটির দিকে তাকান।
আপনার বিবেক কি বলে?
(বিভিন্ন ফেসবুক পেজে, ব্লগে , গ্রুপে যে যেভাবে পারেন শেয়ার করেন। নিরাপরাধ শিশু ইয়াসীন খুনের বিচার চাই।)
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ খানকে ধন্যবাদ-খবরটি আমার সাথে শেয়ার করার জন্য।
প্রবাসী পাঠক ভাইয়ের প্রতি কৃতগ্গতা ছবিটি সংযুক্তিতে সহায়তা করার জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৯:১০