মনেপড়ে, সেই দিনটা ছিল ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ!
সন্ধ্যায় নামার আগেই সম্ভবত ৬টায় বাবা-মা আর ভাই-বোনদের কাছ থেকে আমরা বিদায় নিয়েছিলাম। সেদিন সেই ট্রেনটার নাম ছিল দ্রুতযান এক্সপ্রেস। সেটা সন্ধ্যা ৭.৫০টায় ঢাকার কমলাপুর থেকে দিনাজপরের পার্বতীপুর যাবার কথা ছিল...।
আমরা একটি ট্যাক্সি-ক্যাব নিয়ে কমলাপুরে পৌছেছিলাম সন্ধ্যা ৭টায়; কিন্তু পৌঁছে দেখি সেই ট্রেনের কোন দেখা নেই। চারপাশে মানুষের কোলাহল, হকারের চিৎকার, ট্রেনের হুইসেল সবকিছু মিলিয়ে একাকার লম্বা একটা প্লাটফর্ম...।
হ্যা, অবশেষে দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটা ৮টার দিকে কমলাপুরে এসেছিলো, যাত্রীরা একে একে নেমে যাবার পর শুরু হয়েছিল ধোয়া মোছার কাজ। ক্লান্ত ট্রেনটা সেদিন ঘণ্টা খানেক চোখের সামনেই জিরিয়ে নিয়েছিল...।
তারপর সেই ট্রেনটার হুইসেল শুনে, আমরা ট্রেনে উঠেছিলাম। মুখোমুখি বসবার ভাল দুই জোড়া সীট পেয়েছিলাম। আমার পাশে দিনাজপুরের মধ্যবয়সী একলোক বসেছিলো, আর আমার সামনের সীটে মুখোমুখী বসেছিলো শিখা (স্ত্রী) আর কণিকা (একমাত্র শ্যালিকা)। আমার মেয়েটা বিস্ময় নিয়ে একবার মায়ের কোলে, একবার খালামনির কোলে আর একবার আমার কোলে উঠে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল...।
সেদিন সন্ধ্যা ৭.৫০ টার ট্রেনটি রাত ৯.০০টার দিকে পার্বতীপুরের উদ্দ্যেশে রওনা হয়েছিলো। আমরা চারনজন মিলে একটি দীর্ঘ ট্রেন ভ্রমণ শুরু করেছিলাম। বিয়ের দুই বছর পর জীবনে প্রথম বার শশুর বাড়ীতে যাবার ট্রেন ভ্রমণের গল্পটা এভাবেই শুরু হয়েছিল...।
...
আমাদের বিয়ে হয়েছিল মিরপুর-১০ এর একটি চাইনিজে রেস্তরাঁয় যার নাম ছিল চায়না টাউন; সেখানে বিয়ের দিন শিখার দিনাজপুরের আত্মীয়-স্বজনরা এসেছিল আশীর্বাদ করতে। ঢাকা থেকে দিনাজপুরের দূরত্ব বেশী; তাই আমি এবং আমাদের কোন আত্মীয়-স্বজন কখনই দিনাজপুর যাইনি।
ট্রেনটি কমলাপুর থেকে এয়ারপোর্ট হয়ে জয়দেবপুর ছাড়িয়ে আমার জেলা টাঙ্গাইল পৌছালো। আমার মেয়ের জন্য সেটাই ছিল জীবনের প্রথম ট্রেন ভ্রমণ। রাত জেগে জেগে মেয়েটাকে একবার আমার কোলে, তারপর শিখার কোলে, তারপর কনিকার কোলে রেখে রেখে আমরা গল্প করতে লাগলাম...।
রাত ১১.০০ দিকে আমার গ্রামের বাড়ীর পাশের ইব্রাহিমাবাদ রেলষ্টেশনে ট্রেনটি ৩০ মিনিটের একটা বিরতি দিলো। আমি আমার চেনা গ্রামটাকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখালাম, গ্রামটা নির্জন রাতের বুকে নির্মল একাকী ঘুমিয়ে ছিল...।
যমুনা নদীর পূর্বপাড়ে ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মে হাঁটাহাঁটি করলাম, দেখলাম আমার গ্রামের খেটে খাওয়া কিছু রাত জাগা মানুষ
মাঝরাতে গরম ডিম বেচাকেনা করছে। গ্রাম্য মানুষের আঞ্চলিক কথার টানে সে রাতে আমার মনটা ভরে গিয়েছিলো; আমরা তিনজন ধোয়া ওঠা গরম ডিম খুব আয়েশ করে ঝাল মরিচের গুরা আর লবণ মেখে খেয়ে ছিলাম...।
শিখা আর কনিকার গল্প মানেই ছিল পার্বতীপুরের পুরান বাজার, স্কুলের মাঠ, মেঠো পথ,সবুজ ধানের ক্ষেত, বাড়ীর পাশ দিয়ে বসে যাওয়া তিলাই নদী আর মাঝ রাতে বাড়ীর পেছেন দিয়ে চলে যাওয়া দ্রুতগামী ট্রেনের হুইসেল; জেনো এক একটা গল্প নয় এক একটা রূপকথা...।
ট্রেনের সীটে বসে ঘুমানো আমার স্বভাবে নেই; তাই প্রত্যেকটা ষ্টেশনে ট্রেন থামলেই সেই ষ্টেশনের নামটা খুঁজে খুঁজে দেখছিলাম, আরও দেখছিলাম রাত জাগা অপেক্ষমাণ যাত্রীদের উদ্বেগ, আর যাত্রীদের চোখে মুখে লেগে থাকা ক্লান্তি...।
এভাবেই রাত বেড়ে গেলো, এক সময় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একটা স্টেশনে ট্রেন আসলো। হ্যা, হিলি ষ্টেশনে এসে তাকিয়ে দেখলাম, হাতের একপাশে বাংলাদেশ আর অন্যপাশে ভারত। দুই দেশের সীমানা বরাবর একটা লাইন ধরে এগিয়ে গেলো আমাদের ট্রেন। আমরা রাত পারি দিয়ে দিনের আলোর খোঁজে আরও এগিয়েই গেলাম...।
তারপর সামনে এলো বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি, কয়লার বিদ্যুৎ প্রকল্পের বুকের ভেতর দিয়ে একটা ঝলমলে আলোর শহরের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলো ট্রেন পার্বতীপুরের দিকে...।
সেই লম্বা রাতটা পারি দিয়ে অবশেষে সকাল ৬.০০টায় আমাদের ট্রেন পার্বতীপুর রেলস্টেশনে পোঁছে গেলো। ট্রেন থেকে নেমেই দেখি, আমার শশুর সাহেব, মোনেম (একমাত্র শ্যালক) আরও বাড়ীর অন্য মানুষ রাত জেগে জেগে বসে আছে প্ল্যাটফর্মে আমাদের অপেক্ষায়...।
রিক্সায় অচেনা রাস্তায় শিখার পাশে বসে, মেয়েকে কোলে নিয়ে এগিয়ে গেলাম; রাতের ক্লান্তি চোখে মুখে লেগে ছিল...। আঁধার পেড়িয়ে যাচ্ছিলাম আর গাঁয়ে নরম শীতল বাতাসের দমকা এসে লাগছিল।
দেখছিলাম মাথার উপরে দাড়িয়ে থাকা বিশাল বিশাল কড়ই গাছের ছায়া এসে পড়ছে কালো রাস্তার বুকের সীমানায়। মফসলের নির্জন রাস্তায় ধোয়া ধোয়া আকাশে একটা নতুন সূর্য আস্তে আস্তে উকি দিচ্ছিল...।
কি যে একটা ঘোর লাগা অনুভূতি লেগেছিল চারপাশে, যেন রুপকথার দেশে স্বপ্নের মতো এগিয়ে আসছে নতুন ভোর...!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:০২