ভাবী-এক রহস্যময় শব্দের নাম।পৃথিবীর যাবতীয় অজানাকে আবিষ্কারের পরও যে শব্দের মোহ আপনাকে তাড়িত করবে আমৃত্যু-তাঁর নাম,"ভাবী"।সাধারনত আমরা বড় ভাইয়ের বউকে ভাবী বলে থাকি।এই রমণীর হাতেই সংসার সুখের হবার সোনার কাঠি-রুপার কাঠি গচ্ছিত এবং সেটা আমাদের প্রচলিত সমাজ বাবস্থায় প্রায় প্রতিটি পরিবারেই।আর আপনার গুণধর ভাইটি যদি নম্র-ভদ্র-উচ্চশিক্ষিত হন,তবে সেটা ষোল আনাই সঠিক।এই মহিলার দয়া-দাক্ষিণ্যে একটি পরিবার যেমন সুস্থ সবল নীরোগ দেহে শান্তির স্নিগ্ধতা ছড়ায়,তেমনি তাঁর বীভৎস বাড়াবাড়িতে একটি পরিবার হাবিয়ার অনলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
আমরা ছিলাম নয় ভাই বোনের পরিবার।বোনেরা ছিলেন বয়সে ভাইদের চেয়ে বড়,তাই মায়ের মৃত্যুর আগেই পাঁচ বোনের তিন বোন বিয়ে হয়ে শশুর বাড়ির পথ ধরেছেন।আমাদের পরিবারের বড় ছেলে অর্থাৎ আমার বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া বাবলু চট্টগ্রাম ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করে আজকের কাগজ পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে সদ্য যোগদান করা সাংবাদিক।তিনিই ছিলেন বাবা-মা,ভাই বোনসহ পরিবারের আশা আকাংখার প্রতীক।আমি কেবল নটরডেম কলেজ শেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হয়েছি।একই ভার্সিটিতে আমার অপর দুবোনও পড়তেন।আমার অনার্স প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার মাসখানেক আগে,হঠাৎ মায়ের মৃত্যু আমাদের সুখের স্বর্গে কালো মেঘে ঢেকে দিল।মায়ের মৃত্যুতে বোনদের স্নেহ,প্রেম ভালোবাসা আমাদের প্রতি আরও বাড়িয়ে দিল।তাই রাবিতে পড়া বড় দুই আপুর হলে আমার যাতায়াত অন্য সময়ের চেয়ে কয়েকগুন বেড়ে গেলো।আমার বোনদের হল-রোকেয়াতেই থাকতেন আমাদেরই এলাকার এক আপু।নাম মরিয়ম আক্তার বেবী,সমাজ বিজ্ঞানে মাস্টার্স পড়তেন।আপুদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ কালে প্রায়ই বেবী আপুর সাথে দেখা হতো।মনে মনে ভাবতাম,ইস! এমন একজন মেয়েকে যদি ভাবী করে পেতাম,যে আমাদের মা হতে পারতো ... ।এর ঠিক এক বছরের মাথায় আমার বাবাও আমাদের মায়া ত্যাগ করে-না ফেরা দেশের বাসিন্দা হলেন।আমরাতো পুরো পরিবার একেবারে অকুল সাগরে পড়ার মতো অবস্থা।একদিন রোকেয়া হলের গেটে বেবী আপুকে দেখে-সরাসরি প্রস্তাবই দিয়ে বসলাম,তুমি কি আমার ভাবী হবে,আমাদের মা?বেবী আপার বড় বোন আমার ভাইয়ের সাথে একই ভার্সিটিতে পড়ার সুবাদে তিনি আমার রাজপুত্তুর ভাইকে আগেই চিনতেন এবং এককথায় রাজী হয়ে গেলেন।শর্ত একটাই,বড় ভাই যদি তাকে অপছন্দ করে তবে বয়সে ছোট হলেও আমাকে তাকে বিয়ে করতে হবে।আমিও রাজী হয়ে গেলাম।
আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার পনের দিন আগে ধুম-ধাম আয়োজনে বেবী আপার সাথে আমার ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেলো।পরীক্ষার কারনে আমার,ভাইয়ের বিয়েতে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়নি।এতো আশাকরে মা পাওয়ার লোভে পছন্দ করে যে ভাবীকে ভাইয়ের বউ করে আনলাম,ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস-সেই ভাবী আমাদের পরিবারে এসে বিয়ের দ্বিতীয় মাস থেকেই আমার পড়ালেখার খরচ বন্ধ করে দিলেন,ভাইয়াকে সাফ জানিয়ে দিলেন তিনি এই এতিমখানার দায়িত্ব নিতে পারবেন না।আমার ভদ্র শিক্ষিত ফেরেস্তাসম ভাইও,বাধ্য বালকের মত-একদিন আমাদের এতিমখানা ছেড়ে,নিজের সুখের স্বার্থে আলাদা বাসায় উঠলেন।আমি আর আমার নাবালক দুই ছোট এতিম ভাই,আমাদের পৈতৃক সম্পত্তির আমাদের পাওয়া সবটুকু বিক্রিকরে বাকী দুই বোনকে পাত্রস্থ করলাম।অথচ আরও বড় দুঃখের বিষয় হলো-আমাদের ছোট তিন ভাইয়ের সম্পত্তির ক্রেতা আমারই আদরের ফেরেস্তারুপী ভাই।সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে জমি বিক্রির দলিলে দস্তখত করতে গিয়ে যখন দেখলাম,আমাদের তিন ভাইয়ের সম্পত্তি আমার গুণধর বড়ভাই,ভাবী ও তাঁর তিন মাসের নাবালক মেয়ের নামে রেজিস্ট্রি করছে তখন আর কিছুতেই দু'চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না।অবশেষে,নাবালক ছোট জমজ দু'ভাইয়ের গড়াগড়ি কান্না দেখে নিজেকে সামলে নিলাম।আজ অনেক বছর হয়ে গেলো,আমার নাবালক ভাইয়েরা একসময় সাবালক হয়ে উঠলো-দুঃখ সংগ্রাম পাড় করে ওরাও আজ আমার মতোই সংসারী হয়েছে,ভুলে গেছে না পাওয়ার বঞ্চনা।আমার বড় ভাই-ভাবী,দুজনেই কলেজের শিক্ষক।একটি এনজিওর মালিক।বিশাল কোটিপতি-রাজ প্রাসাদের বাসিন্দা।অথচ আমাদের কপালে একমুঠো ভাতও তাঁর হাত দিয়ে জোটেনি,আজ পর্যন্ত।আমাদের আর মা পাওয়া হয়নি তাই,পেয়েছি -ভাবী। যাকে শুধু ভাবতেই থাকিব..!!!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৬