সংকলিত কোরান অসম্পুর্নঃ
মুহাম্মদ ইবন জরির আল তাবেরি( 839-923) ইবন সা'দ( হিজরি 168- 230) ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দিকের সংকলক। আল তাবেরি 35 খন্ডে ইসলামের কালানুক্রমিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন, ইবন সা'দ ইতিহাস সংকলক এবং বিভিন্ন সাহাবাদের জীবনিসংকলক, তারা দুজনেই কোরান এবং কোরান সংকলনের বিষয়ে একটু সংরক্ষনশীল মনোভাব দেখিয়েছেন। মুশায়েফ(কোরানের বানীগুলোর সংকলন) এবং কোরান( যা মুহাম্মদ এর উপর অবতীর্ন হয়েছিলো, এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। মুশায়েফ আসলে সম্পুর্ন কোরান নয়, কোরানের যেটুকু অংশ বেঁচে গিয়েছে তার সংকলন।
আবদুল্লাহ বিন উমরের জবানিতে, কেউ দাবী করো না তুমি সম্পুর্ন কোরান পেয়েছো, বরং তার বলা উচিত কোরানের যেটুকু অংশ অক্ষত আমি ততটুকু পেয়েছি।
ইয়ামামার যুদ্ধে নিহত ক্বার( যারা কোরানস্মার্ত ) মৃতু্যবরন করেন, এবং আবু বকর এমন আশংকা করেন এভাবে যুদ্ধে যদি ক্বাররা শহীদ হতে থাকে তবে কোরানের কিছুই অবশিষ্ঠ থাকবে না তাই মুহাম্মদের প্রত্যক্ষ নির্দেশ না থাকার পরও তিনি কোরান সংকলনের কাজে হাত দেন, এবং ইয়ামামার যুদ্ধে এমন কিছু সাহাবা শহীদ হন যাদের কাছে কোরানের এমন কিছু অংশ ছিলো যা অন্য কারো কাছে ছিলো না।
আবদুল্লাহ বিন মাসুদ(যে মককায় অতীর্ন প্রায় সমস্ত আয়াতই মুখস্ত করেছিলো) বলেছেন, একবার মুহাম্মদ আমাকে কোরানের বিশেষ একটা আয়াত মুখস্ত করান, আমি পরে বাসায় গিয়ে সেটা আমার নিজস্ব সংগ্রহে লিখে রাখি, মাঝরাতে উঠে আমি কিছুতেই স্মরণ করতে পারলাম না , আমি আমার সংগ্রহ খুলে দেখি সেখানেও সেই আয়াত নেই, পরদিন আমি নবীর সাথে দেখা করে এ কথা জানাই, তিনি বলেন, সেই আয়াত গত রাতেই রদ হয়েছে।
কোরানের আয়াতে আছে, খোদার মর্জি তিনি যাকে যতটুকু ইচ্ছা ততটুকু কোরান তার স্মৃতিতে অক্ষুন্ন রাখেন।
কোনো এক দিন নামাজে মুহাম্মদ কোরানের একটা আয়াত বাদ দিয়েই নামাজ শেষ করেন, নামাজ শেষ হলে তিনি উবায়ে বিন ক্বা'বএর খোঁজ করেন, এবং তাকে বলেন আমি যে আয়াতটা বাদ দিয়েছি সেটা আমাকে মনে করিয়ে দিলে না কেনো? উবায়ে প্রতু্যত্তরে বলেন, আমার মনে হলো কোরানের সেই আয়াত রদ হয়ে গেছে, এর উত্তরে মুহাম্মদ বলেন নাহ আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
এই গ্রহন বর্জনের ফলে অনেক গুলো আয়াত সংশয়ের কারনে লিপিবদ্ধ করা নাও হয়ে থাকতে পারে, উবায়ে বিন ক্বা'ব এবং ইবন মাস'উদ দুজনেই দাবি করেছেন তাদের সংকলনে আছে এমন অনেক আয়াতই উসমানের সংকলনে নেই, এবং এও মেনে নিয়েছেন উসমানের সংকলনে এমন কিছু আয়াত আছে যা তাদের সংকলনে নেই।
এখন দেখা যাক কোরানের আয়াত যা রদ বা বাতিল ঘোষিত হয়েছিলো তার পরিমান কতো? কেউ কেউ অনুমান করেন এই সংখ্যাটা 200 এবং কেউ কেউ অনুমান করেন সংখ্যাটা 5 থেকে 500 র মধ্যে।
আযহাব সূরার প্রকৃত দৈর্ঘ্য ছিলো আল বাকারার সমান,
এমনও ঘটেছে কোরানের কিছু কিছু আয়াত তেলাওয়াত করা হয় নি কিন্তু কারো কারো ব্যাক্তিগত সংগ্রহে ছিলো।এবং কালক্রমে সেইগুলো প্রায় বিস্মৃত হয়ে গেছে লোক।
5ঃ 89 আয়াতটা নিয়ে একটা বিতর্ক আছে, সেখানে শপথ ভঙ্গের প্রতিবিধান হিসেবে 3 দিন রোযা রাখার কথা বলা আছে, এখানে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ এর ভাষ্য ছিলো এটা পরপর 3 দিন রাখতে হবে এবং উসমানের ওখানে শুধু 3 দিন রাখতে হবে বলা আছে,
সুরা বাকারার 106 নম্বর আয়াতে বলা আছে, আমরা যা অবতীর্ন করি তা রদকরা হয় না বা তা তোমাদের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলানো হয় না বরং আমরা অধিক যোগ্য একটা আয়াত দিয়ে তা প্রতিস্থাপন করি।
কিন্তু অনেক ক্ষত্রেই আয়াত রদ হওয়ার পর পরিবর্তত আয়াত এসেছে এমন নিদর্শন নেই এ কারনেই অনেকগুলো কোরানের আয়াত ইয়ামামার যুদ্ধে নিহতদের সাথে কবরে রয়ে গেছে।
অবশ্য মুহাম্মদের সময়ে সমার্থক শব্দ দ্্বারা আয়াতের প্রতিস্থাপন বজায় থাকার কারনে বেহস কিছু আয়াতের অনেকগুলো ধাঁচ রয়ে যায়। আরবি ব্যাকরনের দুর্বলতা হলো যখন কোরান সংকলন করা হয় তখন সেখানে স্বরবর্ন নির্দেশক কারগুলো ছিলো না, আমরা যেভাবে আ-কার ই-কার ব্যাবহার করি, আরবিতে যের যবর পেশ তাশদীদ এসবের প্রচলন শুরু হয় হিজরি প্রথম শতকের পরে। এবং আরবিতে বর্নমালা এবং স্বরের পার্থক্য ছিলো, স্বর ছইলো মোট 31টি কিন্তু বর্নমালায় বর্ন ছিলো 28টি কিংবা 26টি, সুতরাং কয়েকটা বর্নকে একাধিক স্বর ধারন করতে হতো। এ সব কারনে কোরানের অর্থ বিকৃতি ঘটেছে। এবং এই অর্থবিকৃতি আরও প্রকট হয়েছে সমার্থক শব্দ ব্যাবহারের কারনে, সুতরাং অনেকগুলো আয়াতই কালের সাথে অর্থ পরিবর্তন করেছে।
ব্যাভিচারের শাস্তি পাথর ছুড়ে মারা- এটার বিষয়ে বিস্তর বিভেদ আছে ইসলামিচিন্তাবিদদের মধ্যে।
এই আয়াতটা কোরানের অংশ নয়, মুহাম্মদ বলেছিলেন, এটা আমার কাছ থেকে গ্রহন করো( এটা হাদিসে কূদসি সেই বিচারে) এখন মেয়েদের জন্য নতুন একটা নিয়ম চালু করেছেন ইশ্বর, যদি কেউ ব্যাভিচারি প্রমানিত হয় তবে অবিবাহিতদের জন্য 100টা চাবুকের বাড়ি এবং 1 বছরের নির্বাসন। এবং বিবাহিতদের(শব্দটা যারা কৌমার্য হারিয়েছে হবে- খটকা লাগলো আবারও প্রথম বার করার পর লোক জন কৌমার্য হারিয়ে ফেলবে এর পরের বারের জন্য পাথর ছুড়ে মারার নির্দেশ?? ) জন্য পাথর ছুড়ে মারার নির্দেশ। (সূত্র শাফঈ- রিসালাহ)
আলীর সামনে একবার এক ব্যাভিচারিনিকে নিয়ে আসা হয়, আলি তাকে প্রথমে বেত্রাঘাতের নির্দেশ দেন এবং পড়ে পাথর ছুড়ে হতয়ার নির্দেশ দেন। উপস্থিত জনতা প্রশ্ন করে কেনো এক অপরাধের শাস্তি 2 বার দেওয়া হলো, আলী উত্তরে বলেন, তাকে বেত্রাঘাতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কোরান অনুযায়ি এবং পাথর ছুড়ে মারার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে হাদিস অনুসরন করে( সুন্নাহ) ।
আলীর ভাষ্য মতে পাথর ছুড়ে মারার আয়াত নাজিল হয়েছিলো কিন্তু ইয়ামামার শহীদদের সাথে সেই আয়াত বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ইবনে আব্বাস বলেন, ওমর বলেছেন পাথর ছুড়ে মারার আইনটা সুন্নাহ এবং কোরানে রয়েছে, এটা আল্লাহর আইন, আবু বরক এই শাস্তি দিয়েছেন, মহানবী দিয়েছেন, আমিও এই আইন অনুসরণ করি। বোখারীর হাদিস অনুসারে- এই আইনটা বিবাহিত ব্যাভিচারীদের জন্য প্রযোজ্য, তবে প্রাথমিক পর্যায়ে এটা কোরানে ছিলো না মানে কোরান সংকলনে এটাকে লিপিবদ্ধ করার কোনো নির্দেশ মুহাম্মদ দেন নি, ওমর এটাকে কোরানে আত্তীকরন করেন, তার ভাষ্য ছিলো কোরানের সংকলনে এটা ঢোকানোর সময় নীচে ফুটনোট রাখা হবে- উবায়ের সূত্র অনুসারে বিবাহিত ব্যাভীচারিদের তৎক্ষনাত পাথর ছুড়ে হত্যা করো, এই আয়াতটি আল আহযাব সূরার অন্তর্গত ছিলো, এবং সবাই এ কথাই বলছে যে এই সুরাটার দৈর্ঘ্য ছইলো আল বাকারা র সমান কিন্তু যখন এটা ওমর সংগ্রহ করেন তখন এটার যতটুকু পাওয়া যায় এখনও ততটুকুই আছে,
তবে মুহাম্মদের উপর যখন এ আয়াত নাজিল হয় তখন তৎকালিন সাহাবাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, ওমর প্রশ্ন করেন এটাকি সংকলনের অংশ হিসেবে টুকে রাখবো, মুহাম্মদ অসম্মতি জানান, এ আয়াতের পরোক্ষ প্রভাব কি হবে এটা ভেবে দেখো, যারা বর্ষিয়ান এবং অবিবাহিত তাদের চেয়ে যারা বিবাহিত এবং অল্প বয়স্ক তাদের শাস্তির পরিমান বেশী কঠোর হয়ে যাবে***** ( এটার চর্চা ছিলো, বিবাহিত মুসলিমরাও কম বয়েসের জোশে অন্য লোকের বৌএর সাথে শুয়ে পড়তো, এবং বয়স্ক অবিবাহিতরাও একই কাজ করতো**** ) আয়েশার ভাষ্য কেনো এই আয়াতটা হারিয়ে গেলো? এটা এবং এটার সাথে নাজিল হওয়া অন্য একটা আয়াত সংকলিত অবস্থায় ছিলো, কোনো এক সময় এক গৃহপালিত জীব এসে তা খেয় নেয়,
তবে এ আয়াতটি তৎকালিন সমাজে ভীষন প্রতিক্রিয়া তৈরী করে, সাহাবারা বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ে এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর, তাদের সম্মিলিত প্রতিরোধে এই আয়াতটির তেলাওয়াত রদ করা হয়( সূত্র- ফাতাহ আল বারি) ।
এবং আরও একটি হারানো আয়াত-
উবায়ের বক্তব্য অনুসারে- একদিন মহানিবী আমাকে ডেকে পাঠালেন, তিনি আমাকে একটি আয়াত মুখস্ত করতে বলেন, আয়াতটা এমন-
"যারা নবীকে অস্ব ীকার করে তাদের মধ্যে পুর্ববর্তি কেতাবধারী এবং তাদের অনুসারীরা কি নেই..।এখানেই আয়াতটা শেষ হয় নি, যদি আদমের সন্তানেরা সম্পদ লাভ করে এবং পরবর্তিতে আরেকটা সম্পদের লোভ করবে, যদিতারা তাও পেয়ে যায় তবে তারা আরও সম্পদের লোভ করবে, শুধুমাত্র বালুকনাই আদমের সন্তানের থাবা ভরতে পারে, ইশ্বর অনুশোচনাকারিদের উপর সদয়।
এটা সুরা ইউসুফের অংশ ছিলো,
ওমর উবায়ের মতামত জানতে চান এটা কি সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে, উবায়ে বলেন মহানবি আমাকে তাই করতে বলেছিলেন,
দুধপানের আয়াতঃ আয়েশার সূত্রে বর্নিতঃ কোনো বিবাহিত পুরুষ যদি 10 বার তার বিবির দুধ পান করে তবে তার বিবাহ রদ হয়ে যাবে, এর পর এই আয়াতটাই রদ হয়ে যায় এবং নতুন আয়াতে বলা হয় 5 বার দুধপান করলেই বিবাহ রদ হয়ে যাবে।
আবু হুদাইফার বউকে মুহাম্মদ সালিমকে 5 বার দুধ পান করানোর নির্দেশ দেন।
সলিমের ভাষ্য- এর পর তিনি আয়েশার সাথে দেখা করতে যান, কিন্তু আয়েশা তার সাথে দেখা করতে অস্ব ীকৃতি জানান, তার বোন উম্ম কুলসুম( কুলথুম!!) সালিমকে তিন বার দুধ পান করানোর পরই অসুস্থ হয়ে যান। আমি কখনই 5 বার দুধ পান করতে পারি নি এবং আয়েশা আমার সাথে কখনই দেখা করেন নি।
হাফসা এই আয়াতের সূত্র ধরে তার বোন ফাতেমার কাছে আসিম বিন আবদুল্লাহ বিন সা'দকে পাঠান যেনো 10 বার দুধ পান করিয়ে ফাতেমা তার দুধ মা হতে পারেন এবং আসিম তার সামনে যেতে পারে।
বেশ কিছু আয়াত যা ইসলামি শাস্তি হিসেবে নাজিল হয়েছিলো এইগুলোর ব্যাবহার নিয়ে বেশ মতপার্থক্য আছে কারন সমার্থক শব্দের ব্যাবহার এবং আরবি শব্দ উচ্চারনের পার্থক্যের কারনে অর্থ বদল করে এই জন্যও কিছু আয়াতের অনেকগুলো ভাষ্য পাওয়া যায়।
যদি কখনও সময় হয় এবং ইচ্ছা হয় সেই সব বিভিন্ন পরিবর্তিত পাঠ সহ আয়াত গুলো পেশ করবো জনতার সামনে, কিন্তু এই যে দাবী কোরান অবিকৃত অবস্থায় ছিলো এবং এখনও অবিকৃত অবস্থায় আছে এই দাবীটা সঠিক নয়, কোরান সম্পুর্ন নয়।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




