somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুক রিভিউঃ দূরবীন (লেখকঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়)

৩০ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৯:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলা সাহিত্যে বর্তমান সময়ের একজন অত্যন্ত শক্তিমান লেখক হচ্ছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। "দূরবীন" তার অনন্যোসাধারণ একটি উপন্যাস।

শীর্ষেন্দুর অন্যান্য বই যারা পড়েছেন তারা জানেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখার বিশেষত্বই হচ্ছে উপন্যাসে অনেক চরিত্রের সমাগম ঘটানো। এত চরিত্রের সমাগম ঘটানো সত্ত্বেও কাহিনীতে কোথাও কোন অসামঞ্জস্যতা নেই। সবগুলো চরিত্রকে তিনি এক সুঁতোই সুন্দর করে বাঁধতে পারেন, এমন গুণ খুব কম লেখকেরই রয়েছে।

শীর্ষেন্দুর লেখা পড়লেই বোঝা যায় তিনি বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জীবনযাপন, পেশা, আচার-ব্যবহার, শ্রেণীভেদে মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসিখেলার একেক রুপ, সংগ্রাম, পদস্খলন; প্রভৃতি বিষয় সম্বন্ধে খুব উঁচু দরের ধারণ রাখেন যা তার লেখায় তিনি খুব সুন্দরভাবে বিধৃত করেন।

এখন আসা যাক "দূরবীন" উপন্যাসের চরিত্রগুলির স্বরুপ বিচারে।

দূরবীন উপন্যাসে তিনটি প্রজন্মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমজন পুর্ববঙ্গের জমিদার হেমকান্ত চৌধুরী, দ্বিতীয়জন ব্রিটিশ ভারতের বিপ্লবী এবং স্বাধীন ভারতের ডাকসাঁইটে রাজনীতিবিদ ও হেমকান্তর নয়নের মণি কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী ও কৃষ্ণকান্তের বখে যাওয়া ছেলে ধ্রুব চৌধুরী; লোফার, হৃদয়হীন থেকে শুরু করে অনেক বিশেষনই তার সাথে যুক্ত করা যায়।

শীর্ষেন্দুর লেখার আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী নারী চরিত্র। দূরবীনেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এই উপন্যাসে সেই শক্তিশালী নারী চরিত্রটি হচ্ছে রঙ্গময়ী।

প্রথমে আশা যাক হেমকান্তর ব্যাপারে। শান্ত, আত্মনির্ভরশীল, হিসেবী মানুষ। অন্যান্য জমিদারদের মত তার তেমন দাপট বা কতৃত্ব নেই। পৈতৃক সূত্রে অনেক সম্পত্তি পেয়েছেন। বড়ো ভাই বরদাকান্ত সন্ন্যাস নেন আর ছোট ভাই নলিনীকান্ত নৌকাডুবি হয়ে মারা যান। তাই বাবা শ্যামাকান্তর সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী তিনিই হন। কিন্তু এই বিশাল সম্পত্তি আগলে রাখা বা জমিদারী বাড়ানোর কোন ইচ্ছা তার মধ্যে নেই। সমস্ত বিষয়ে তাকে অত্যধিক নিস্পৃহ দেখা যায়। ভাবখানা এমন, “এর আর দরকার কে? যেমন চলছে তেমনি চলবে...আমার আর এতে জড়ানোর দরকার কি?” অত্যধিক ভাবপ্রবণ একজন মানুষ। জগতের কতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিস নিয়েও তার চিন্তার শেষ নেই। সহজভাবে বললে অলসভাবে বসে থাকলে নানারকম চিন্তা মানুষের মনে ঘুরপাক খায়, হেমকান্ত চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক সেই বিষয়টিই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।

হেমকান্তর জীবনটা একদমই নিরামিষ। তার কোন বিষয়াসক্তি নেই। জীবনে কোন গতি নেই, কোন রোমাঞ্চ নেই। সোজা কথা বললে তার ব্যক্তিত্বটি একজন জমিদারের সাথে অত্যন্ত বেমানান।

হেমকান্তর অল্প বয়সেই স্ত্রীবিয়োগ ঘটে। স্ত্রীর নাম ছিল সুনয়নী। হেমকান্তর তিন পুত্র, তিন কন্যা। কারো প্রতিই হেমকান্ত তেমন আকর্ষণ অনুভব করেন না শুধুমাত্র একজন ছাড়া। আর তা হচ্ছে তার নয়নের মণি কনিষ্ঠপুত্র কৃষ্ণকান্ত।

হেমকান্তর আরেকটা দুর্বলতার জায়গা ছিল...রঙ্গময়ী। তাদের ঠাকুরমশায়ের কন্যা। বলিষ্ঠ ব্যাক্তিত্বের অধিকারী এই নারী চরিত্রটি দেখিয়েছে কিভাবে শত প্রতিকূলতার মাঝেও নিজের ভালবাসাকে জয় করা যায়, নিজের অধিকারকে নিজে বুঝে নিতে হয়। সমাজের চোখ রাঙ্গানি, কথা চালাচালি, কুৎসাকে সে তুচ্ছজ্ঞান করেছে তার ভালবাসার কাছে। কিশোরী বয়স থেকেই সে ছিল হেমকান্তর উপর আসক্ত। তার এই প্রগলভ আচরণে হেমকান্ত আশ্চর্যান্বিত হলেও কোন এক অদৃশ্য কারণে কখনোই তাকে কিছু বলতে পারতেন না। তার বাড়ির একজন কর্মচারীর মেয়ে হয়েও এমন বলিষ্ঠভাবে রঙ্গময়ী হেমকান্তকে তার হৃদয়ের কথাগুলো বলত যার প্রত্যুত্তরে সে নিজেকে বড় অসহায় মনে করত। রঙ্গময়ীর কাছে তার এই অসহায়ত্ত্ব মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিল। হেমকান্ত পয়তাল্লিশোর্ধ্ব বয়সে রঙ্গময়ীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে। হয়তো একে সমাজের অনেকে তার মত মানুষের পদস্খলন হিসেবেই ধরে নিয়েছিল কিন্তু বইয়ের কাহিনী থেকে বোঝা যায় এটি তার জন্য কতটা দরকার ছিল।

রঙ্গময়ী সম্বন্ধে আগেই কিছু কথা বলা হয়েছে। নিঃস্বার্থভাবে একজন মানুষকে কিভাবে ভালবাসা যায়, ভালবাসার মায়াজালে কিভাবে একজনকে আবদ্ধ করা যায় তা সুন্দরভাবে লেখক দেখিয়েছেন। কিন্তু এজন্য তাকে কম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। সে সবসময়ই নিজের লক্ষ্যে ছিল অবিচল। কোন কিছুই যেন তার অসাধ্য নেই। মাতৃবিয়োগের পর হেমকান্তর কনিষ্ঠ দুই সন্তান বিশাখা আর কৃষ্ণকান্তকে সেই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। কৃষ্ণকান্তর মধ্যে বিপ্লবের বীজটিও সেই বপন করেছিল। সবকিছুর বিচারে রঙ্গময়ীকে বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী নারী চরিত্রগুলির কাতারে অনায়াসে স্থান দেয়া যায়।

এরপরে আসা যাক কৃষ্ণকান্তর বিষয়ে। অল্প বয়সেই তার মধ্যে মহান মানুষের বিভিন্ন গুণ দেখা যায়। অমিত সাহস তার। প্রচণ্ড তেজী ব্যাক্তিত্বের স্ফূরণ বাল্যকালেই তার মধ্যে প্রকাশ পায়। তার ছোট কাকা নলিনীকান্ত ছিলেন একজন বিপ্লবী। তার ধারায় পেয়েছিল। বাড়িতে আশ্রিত বিপ্লবী শশীচরণকে দেখে তার ইংরেজদের প্রতি বিতৃষ্ণা এসেছিল। অতঃপর রঙ্গময়ীর ছত্রছায়ায় তার মধ্যে বিপ্লবী হবার ইচ্ছা প্রবল হয়। এভাবেই পরবর্তীতে সে ব্রিটিশ ভারতের একজন নামকরা বিপ্লবীতে পরিণত হয়। এর জন্য তাকে যন্ত্রণাও কম পেতে হয়নি। এসব সহ্য করতে করতে একদম ইস্পাত কঠিন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন কৃষ্ণকান্ত।

স্বাধীন ভারতে একজন ডাকসাঁইটে নেতা হিসেবে কৃষ্ণকান্তের আবির্ভাব ঘটে। নিজের ব্যাক্তিত্ত্ব ও বুদ্ধির জোরে সব জায়গাতেই তার ছিল এক অসাধারণ প্রভাব।

কিন্তু তার দুর্বলতার একটি জায়গায় ছিল...তার মেজো পুত্র ধ্রুব। প্রচণ্ডভাবে ভালবাসতো সে ছেলেকে...কিন্তু অকাল্কুষ্মাণ্ড ছেলেটি কখনোই তার এই ভালবাসা বুঝতে চাইনি নানাভাবে তাকে কষ্ট দিয়েছে। এসবকিছুই তার মত এই পাহাড়সম ব্যাক্তিত্ত্বের মানুষটিকে চরম পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়।

এরপর আসা যাক ধ্রুবর প্রসঙ্গে। ধ্রুব চরিত্রটির উপর আমার ব্যাক্তিগতভাবে খুব রাগ আছে। মদ্যপ, চরিত্রহীন একটি চরিত্র। যার কাছে ভালবাসার কোন দাম নেই। প্রচণ্ড বেপরোয়া। একজন উজ্জ্বল ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হবার সব গুণই তার মধ্যে ছিল। কিন্তু তার এই বেপরোয়া নিষ্ঠুর স্বভাবের কারণেই সে তা হতে পারেনি। সবসময় সে তার পিতাকে তার প্রতিদ্বন্দী ভেবেছে। তার স্ত্রী রেমিও তাকে অন্ধভাবে ভালবাসত। সে যতবার ভালবেসে তাকে কাছে টেনে নিতে চেষ্টা করেছে সে ততবারই তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। রেমিকে কখনোই তার ভালবাসার যোগ্য প্রাপ্যটুকু সে দেয়নি। মাঝে মাঝে শুধু ভালবাসার অভিনয়টুকু করেছে। তার এই আচরণ রেমিকে যেন তার তৃষ্ণার্ত করে ধ্রুবর ভালবাসা পাবার জন্য। কিন্তু ধ্রুব যে বড্ড নিষ্ঠুর!

উপরিউক্ত চরিত্রগুলিই আলোচ্য উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র। এছাড়াও কাহিনীর প্রয়োজনে লেখক আরো অনেক চরিত্রের সমাগম ঘটিয়েছেন আলোচ্য উপন্যাসে। সবকিছু জানতে আপনাকে পড়তে হবে উপন্যাসটি।

পরিশেষে বলি, ‘দূরবীন’ উপন্যাসের ব্যাপ্তি অনেক বিশাল। তিনটি প্রজন্মের তিন ধরণের মানুষের কাহিনী বা জীবনাচরণ এখানে বিধৃত করা হয়েছে। এটি শুধু সাড়ে পাঁচশো পৃষ্ঠার একটি উপন্যাস নয়; মানুষের ভাব, প্রেম, পদস্খলন, সংগ্রাম, বিরহ, জীবন-জীবিকা, আনন্দ-বেদনার- সব কিছুর এক প্রতিচ্ছবি।
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×