১০
৯
৮
৭
৬
৫
৪
৩
২
১
আয়মান চোখ পাকিয়ে বলল, ‘এই বালিকা! আমার আজুরা দিচ্ছিস না কেন?’
‘সামান্য থু থুর জন্য বিশ হাজার টাকা চাইতে তোমার দ্বিধাবোধ হয়নি?’
‘আমার থু থু গলায় ঝুলাতে তোর ঘেন্না হয়নি?’
‘আয়মান ভাই গো! থু থুর জন্য তোমাকে আমি নগদ বিশ লাখ দেব, পরে।’ কাজের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে সরসী আদেশের সুরে বলল, ‘যা! প্রগুণীর জন্য অট্টগরম চা নিয়ে আয়।’
‘আমার টাকা দিচ্ছিস না কেন?’ আয়মান রেগে অধীর হয়ে বললে সরসী বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বললাম তো! পরে নগদ দেব।’
‘দাঁড়া! তোকে এখন সাবুদ করব।’ বলে আয়মান তেড়ে এগুলে সরসী চিঁক দিয়ে দৌড়ে পালায়।
‘দূর! টোটকা দেওয়ার আগে আজুরা আদায় করলাম না কেন? এখন মিনতি করলেও আর দেবে না। খামোখা টালমাটাল করবে।’ বলে আয়মান রেগে ব্যোম ব্যোম করে পাকঘরে যেয়ে চা বানিয়ে খেয়ে পড়াঘরে যায়। দুলে দুলে সরসীকে পড়া মুখস্থ করতে দেখে নাক সিঁটকিয়ে বলল, ‘দুরভিসন্ধির অর্ধী দুরভিসন্ধিনী! ঠাট ঠমক ঠসক করে হেঁটে ফাঁড়ায় পড়ে বাগে আসলে, জুতসই করে তোকে আমি নাস্তানাবুদ করব মনে রাখিস।’
তার কথা শুনে চকিতচাহনিতে তাকিয়ে ঘনঘন পলক মেরে সরসী বলল, ‘ঠারেঠোরে হাঁটি আমি ঠাহর করে মনের কথা বলি। ঠেলায় পড়েও তুমি ঠাহর করতে পার না কেন?’
‘ইঙ্গিতাভাসে কী বোঝাতে চাস? বুঝিয়ে বল।’
‘এমন করে কথা বলছ কেন, আমি তোমার কী ক্ষতি করেছি?’
‘পরে বুঝিয়ে বলব। এখন বল ওস্তাদ কোথায়?’ বলে আয়মান চেয়ার টেনে বসে।
‘নাদনবাড়ি আনার জন্য বাগানে গিয়েছেন, এখনি আসবেন।’ বলে সরসী হরিণীর মত মাথা তুলে বাহিরে তাকায়। আয়মান দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে হাত পেতে দাবড়ি দিয়ে বলল, ‘এই! আজুরার টাকা দিচ্ছিস না কেন?’
সরসী চোখ বুজে চিঁক দিয়ে চোখ মেলে বসতে বসতে বলল, ‘দিচ্ছি! দিচ্ছি! এত টাকা দিয়ে কী করবে?’
‘অর্থোপার্জনের জন্য টাকা জোগাড় করে বেসাতি করব।’
‘লেনদেন করে কারবারি হয়ে নগদানগদি কারবার চালিয়ে মুনাফা করতে পারলে, হাতখরচ; খাইখরচ; রাহাখরচ বাদ বরাদ্দ করে মাসমাইনের সাথে সম্মানমূল্য প্রদান করব, আদর সোহাগ করলে।’ বলে সরসী ভ্রূ দিয়ে ইশারা করে।
‘আদার ব্যাপারী আমি দাঁও মেরে কুঠিয়াল হতে চাই না হাটুরিয়া।’ বলে আয়মান মুখ বিকৃত করে বলল, ‘ছলাকুশল শিখে তুই এত বড় ছলি হলে কবে?’
‘মনের কথা মুখে বলেও তোমাকে বোঝাতে পারি না কেন?’
‘রঙ্গিণী তুই বেশি ভাঁড়াভাঁড়ি করিস। বুজরুকি করে আলাই ডেকে ফাঁড়ায় পড়ে আমি তোর প্রেমে মজতে চাই না। কেঁড়েলি কোথাকার!’ বলে আয়মান মুখ বিকৃত করলে সরসী চোখ পাকিয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, ‘কাটখোট্টা তুমি একটা আন্তর্দুষ্ট ভক্তবিটেল। বাস্তুঘুঘু! দমবাজ এবং ঠগ!’
‘ঢাঙ্গাতি তুই! ঠগীর নানি নাবুড়ি।’
‘বিড়ালতপস্বী তুমি বাঁকড়া! ধোঁকাবাজের নানা ধাপ্পাবাজ।’
‘এই! আমার নাতিকে তুই ধোঁকাবাজ ডাকলে কেন লো?’ বলে আয়মান চোখ পাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে ঝুঁকি দিয়ে দাঁড়ালে সরসী মাথা দিয়ে ইশার করে বলল, ‘আমার নাতনিকে ঠগী ডেকেছিলে কেন?’
‘ডেকেছি একবার, হাজার বার ডাকব বারবার ডাকব কিছু করবি?’
‘চাইলেও তোমাকে কিছু করতে পারব না।’ বলে সরসী নতুন বউর মত লজ্জায় লাল হওয়ার ভান করে আড়চোখে তাকিয়ে ঘনঘন পলক মেরে মাথা নত করে।
‘চুটকি বলে আমাকে চাটুকা বানাতে চাস। এই! আমার টাকা দিচ্ছিস না কেন লো?’ বলে আয়মান রেগে দাঁত কটমট করে লাথি দিয়ে চেয়ার সরিয়ে কোঁদা দেয়। সরসী চিঁক দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘আয়মান ভাই! আল্লা’র দোহাই দিচ্ছি আমাকে মের না। না মেরে কত টাকা চাও বলো। যা চাইবে তা দেব। তবুও দয়া করে আমাকে জানে মের না।’
‘বিশহাজার টাকা দে।’ বলে আয়মান হাত দিয়ে ইশারা করে। এমন সময় সবার সাথে মাস্টার এসে কপাল কুঁচকে আয়মানের দিকে তাকায়। মাস্টারের দিকে তাকিয়ে আয়মান কপটহেসে হাত প্রসারিত করে বলল, ‘আয়! আর তুকে মারব না।’
সরসী পড়ি কি মরি করে ঝাঁপ দিয়ে টেবিলের উপর লম্বা হয়ে হাত প্রসারিত করে। ঝাঁপটে সরসীর হাত ধরে হেঁচকা টানে কাছে নিয়ে টেবিল থেকে নামিয়ে বাজুতে টেনে শক্ত করে ধরে মাস্টারের দিকে তাকিয়ে আয়মান বিদ্রূপহেসে বলল, ‘ও মাস্টারজি! ভালানি?’
দাঁড়াশ দেখে থমকে দাঁড়িয়ে সবাইকে থরহরি করতে দেখে সরসীর দিকে তাকিয়ে আয়মান বিদ্রূপহেসে বলল, ‘মাস্টারজির গতরে উপরিভার ভর করেছে।’
‘আয়মান ভাই! আমাকে বাঁচাও।’ বলে সরসী দু হাতে তার বাজু জড়িয়ে ধরে।
‘কয়েকটা দম টেনে তুই একটু জিরা। ছুমন্তর পড়ে ফুঁ দিয়ে এখনি ভর নামাব।’ বলে আয়মান বিড়বিড় শুরু করে। মাস্টার চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আয়মান! সরসীকে ছেড়ে তুই তোর আসনে বস।’
‘ও মাস্টারজি! নাদনবাড়ি কোথায়? এই সরসী! মাস্টারজিকে মারধর করলে আমি বুদ্ধিভোঁতা অজ্ঞপণ্ডিত হব। আমি তো অভিজ্ঞ হতে চাই। মারধর না করে এক কাজ করি, বুদ্ধি ধার করার জন্য পায়ে ধরে সালাম করে মাথার উপর তুলে একটা আছাড় দিলে উপরিভার নামবে। তাই না?’
‘হ্যাঁ! আস্তে আস্তে মাথার উপর তুলে গায়ের জোরে আছাড় দাও, হাড়গোড় গুঁড়ো হবে না। মাস্টারজির কোমর শক্ত হবে।’ বলে সরসী কপটহেসে মাস্টারের দিকে তাকায়। তাদের ভাবসাব আচারব্যবহার, ধরনধারন আচার আচরণ এবং ব্যাপারস্যাপার সুবিধাজনক নয় তা মাষ্টর আঁচ করতে পারে। আয়মান বিদ্রুপ হেসে ভোজালিতে হাত দেয়।
‘বাগে পেলে তোর রোয়াবি বার করব মনে রাখিস।’ রাগান্বিত কণ্ঠে বলে মাস্টার হাবভাব বদলিয়ে ধপাস করে চেয়ারে বসে মাথা কাঁধ ঝুলালে মুখ দিয়ে ফেনা বেরোতে শুরু করে। পড়াঘরে কী হচ্ছে বুঝতে কারো বাকি থাকে না। সরসীর দাদার দিকে তাকিয়ে আয়মান বলল, ‘মাস্টারজিকে ভূতে জেঁতছে। বাইলের ঝাড়ু দিয়ে ঝাড়লে নামবে। নইলে সবার গতরে ভর করবে। কী করবেন?’
‘পারলে তুই ঝাড়। আমি যেয়ে দেখি তোর দাদা কোথায়?’ শিউরে বলে উনি দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। সরসী এবং আয়মানের বাবা মাস্টারের মুখে পানি ছিটা দিতে লাগলেন। মাস্টার চোখ মেলে নিজেকে বিছানায় শুয়া দেখে অবাককণ্ঠে জানতে চাইল, ‘আমার কী হয়েছে?’
‘আপনাকে ভূতে ধরেছিল।’ বলে সরসীর বাবা শিউরে উঠলেন।
‘বলেন কী? ও মা গো। আজ আমি আর ওদেরকে পড়াতে পারব না। আমার সর্বাঙ্গে বিষম বিষব্যথা হচ্ছে।’
‘ও মাস্টারমশাই! কোথায় গিয়েছিলেন?’ বলে আয়মান উনার পাশে যায়। মাস্টার শিউরে বলল, ‘সন্ধ্যামণির সুবাসে মন সতেজ করার জন্য বাগিছায় গিয়েছিলাম। মারধর করলেও আর আমি যাব না।’
‘চামেলির গায়ে হেলান দিয়ে ভূতকেশীর ছায়াতলে বসেছিলেন নাকি?’
‘তোর কথা শুনে এখন আমার বোধোদয় হচ্ছে ধারণা মিথ্যা নয়।’ সরসীর দিকে তাকিয়ে মাস্টার কপটহেসে বলল, ‘চাইলেও আজ আর বাংলা পড়াতে পারব না। এখন তোমাদের ছুটি।’
‘জি আচ্ছা মাস্টারজি।’ বলে দুজন অন্তঃপুর যেয়ে কথা না বলে খেয়ে শুয়ে পড়ে। পরের দিন কলেজ ছুটি হলে অভয়ারণ্যে প্রবেশ করে আয়মান এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিল। দোয়েল জাতীয় পাখি কসাইপাখিকে কাঁটায় গেঁথে মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে।
‘এখন জানলাম পাখির নাম কেন কসাইপাখি।’ বলে আয়মান শিউরে উঠে এবং সর্তকতার সাথে হেঁটে যেয়ে ফাঁদ খালি দেখে সেগুন গাছে হেলান দিয়ে বসে ভাবছে তারপর কী করবে।
‘আয়মান ভাই! আমি আসতে পারব?’
‘দৌড়ে আয়।’ নিম্নকণ্ঠে বলে আঙুল দিয়ে গাছের দিকে ইশারা করে আয়মান বলল, ‘পাখির নাম জানিস?’
সরসী সর্তকতার সাথে ধীরে ধীরে হেঁটে তার পাশে যেয়ে পাখির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পাখিটা খুব সুন্দর।’
‘শুধু সুন্দর নয়। ভয়ঙ্কর সুন্দর। এই পাখি বাংলাদেশে আসল কেমনে?’
‘নিশ্চয় উড়ে এসেছে।’
‘ভালো করে তাকিয়ে দেখ। কাঁটায় গেঁথে যে পাখিকে ছিঁড়ে খাচ্ছে ওটা দেশি কসাইপাখি।’ বলে আয়মান চিন্তিত হলে সরসী তার পাশ ঘেঁষে এক গাল হেসে বলল, ‘আয়মান ভাই, তুমি কোনোদিন মনমুনিয়া দেখেছ?’
‘দূর! দূরে সরে কথা বল।’
‘জানো মিঞাভাই? কাব্যরসিকরা বলেন, যৌবনোদয়ে মনের বনে বিয়ের ফুল ফুটে, সেই ফুলে বসে রসিক অলি যৌবনমধু পান করে। ষোড়শী হলে সুন্দরীকে ঘোড়ারোগে ধরে। এই সব কথা তথ্য কী সত্য?’
‘সরসী! টাকার চিন্তায় মাথা গরম হলে আজ তোকে মাটিতে গাঁথব।’ বলে আয়মান চোখা পাকালে সরসী মুচকি হেসে বলল, ‘আমার মনে যথেষ্ট হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড়। অল্পিষ্ঠ আদর করলে প্রাণবন্ত হব। দয়া করে একটু আদর করবে?’
আয়মান হতাশ হয়ে মাটিতে পদাঘাত করে বলল, ‘এই! তোর কী হয়েছে?’
অশ্রুসজল দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কাঁপিয়ে সরসী বলল, ‘প্রাণবন্ত হওয়ার জন্য একটিবার জড়িয়ে ধরতে পারব? জানো, তোমার বিরহে রাত উজাগরী করে কেঁদে কেঁদে মরব আমি অবলা। বন্ধু রে আমি মরলে নিরালায় বসে তুমি কাঁদবে একেলা।’
আয়মান মৃদু হেসে সরসীর কপালে হাত বুলিয়ে বলল, ‘তুই মরলে চুটকি বলে কে আমাকে ঢং নাচবে, বেশি ব্যথা হয়েছিল?’
‘তোমাকে কাঁদতে দেখতে চেয়েছিলাম।’
‘কেন?’
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:২৫