পরমাত্মীয় পৃষ্টা ২৯-৩১
‘জি আম্মা।’ বলে রাহীম দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে সুফিয়ার দিকে আড়চোখে তাকায়। সুফিয়া শিউরে দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এভাবে তাকাল কেন?’
‘যমের বান্ধবকে আমি ডরাই। ও সাথে দূরত্ব বজায় রাখিস, ঢলাঢলি করলে কল্লা কেটে ফেলবে।’ বলে দাদি জলচৌকিতে বসেন। চাচা কিছু না বলে মাথা নেড়ে বেড়িয়ে যান। সুফিয়া ব্যস্ত টুনির মত ব্যতিব্যস্ত হয়। কে কী চায়, কে কী খায় কদ্দিনে অবগত হয়। শুধু রাহীমের সাথে দূরত্ব বজায় রাখে। সপ্তাহান্তে আমড়া গাছের দিকে তাকিয়ে রাহীম চিন্তাভাবনা করছিল। তাকে দেখে আক্ষেপ করে বলল, ‘ইস, আমড়া গাছে কত আমড়া ধরেছে। জানে চাইলেও আমি আর গাছে উঠতে পারব না। আলাইকে বললে দা তেড়ে মারবে। গাছে উঠলে দাদি আমার হাত পা ভাঙবেন। ইস, আমড়া খাওয়ার জন্য জান লকলক করছে।’
রাহীম মুচকি হেসে গাছে উঠে ডাল কেটে নিচে নামবে এমন সময় বাবা হেঁকে বললেন, ‘এই, গাছে উঠেছিস কেন?’
‘ভাবীর জন্য আমড়া পেড়েছি।’ বলে রাহীম সুফিয়ার দিকে তাকায়। তার কথা শুনে সুফিয়া চোখ বুজে শিউরে উঠে এবং কিছু না বলে বাবা চলে যান। আল্লাহর নাম জপে গাছ থেকে নেমে পাকঘরের পাশে যেয়ে কপট হেসে রাহীম বলল, ‘ভাবীজান, আপনার জন্য আমড়া এনেছি।’
‘আ…আ…আমড়া দিয়ে আমি কী করব?’
‘আমড়া গাছের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করেছিলে তো, তাই আমড়ার ডাল কেটে এনেছি। চাইলে ঢেঁকি বানাতে পারবে।’ বলে রাহীম চৌকাটের পাশে ডালে রেখে দৌড়ে পড়াঘরে প্রবেশ করে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মহাপণ্ডিতের মত শব্দকোষ পড়তে শুরু করে। হঠাৎ কানে প্রতিধ্বনিত হয়, ‘অভিধান পড়লে তন্ত্র মন্ত্রের কূটার্থ বুঝতে বেশি সময় লাগবে না।’
দ্রুত অভিধান খুলে মন্ত্র শব্দ খুঁজে পেয়ে গম্ভীরকণ্ঠে মন্তা শব্দ উচ্চারণ করে মন্ত্র শব্দের অর্থ এবং কূটার্থ পড়ে চিন্তিত হয়ে অভিধান রেখে শব্দকোষ হাতে নেয়। ভাষা-সাহিত্য-সৃজনশীলতা অধ্যায় খুলে স্বগতোক্তি করে, ‘জোড়া-তাড়ায় গোঁজামিল হলে গুরুত্বপূর্ণ কাজে জোড়াতালি আবশ্যকরণীয়। আচ্ছা, তাই হবে। যাক, উদাস উদাসী এবং উদাসিনী শব্দের ভাবার্থ এক। নরবাচকে ই-কার ব্যবহৃত হলেও নারীবাচকে ঈ-কার অপরিহার্য। সুন্দর একটা নামের প্রয়োজন। নারীদের মাঝে যথেষ্ট সৌন্দর্যবোধ আছে বিধায় উদ্দেশ্যসিদ্ধির চেষ্টায় প্রয়োজনিয় ব্যবস্থা অবলম্বনে কার্যসিদ্ধি হবে। তাই তো বটে হু। পলাশীর ঈ-কার সরালে পলাশ হবে। পলাশ তো ফুলের নাম। দূর ছাই।'
বিরক্তোক্তি করে শব্দকোষের পাতা উলটাতে শুরু করে পলাশ শব্দে দৃষ্টি স্থির হলে মনোযোগ সহকারে বিবরণ পড়ে পেয়েছি, বলে হর্ষান্বিত হয়ে বগল বাজাতে শুরু করে। মাস্টার হন্যের মত দৌড়ে যেয়ে জিজ্ঞাসুদৃষ্টে তাকিয়ে ভীতুকণ্ঠে বলল, ‘কী পেয়েছিস?’
রাহীম কথা না বললে মাস্টার বিছানায় বসে চারপাশে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘ওই, অসময়ে পড়াঘরে এসেছিস কেন?’
বিশারদের মত হেসে শব্দকোষ দেখিয়ে রাহীম বলল, ‘কারো ছবি অথবা সময়সমায়িক পাইনি। ডাক নাম পেয়েছি।’
‘ডাক নাম পেয়েছিস বুঝলাম, ছবি অথবা সময়সাময়ীকের অর্থ বুঝিনি।’
‘আমিও বুঝিনি। এখন ভাবীর সাথে দেখা করার জন্য পাকঘরে যাব। অর্থান্তরে অর্থোদ্ঘাটন না করে জপতে শুরু করলে সবাইকে বলব।’ বলে রাহীম দৌড়ে পাকঘরে যায়। দাদি ফিসফিস করে সুফিয়াকে কিছু বলছিলেন। তাকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ধমকে বললেন, ‘পাকঘরে এসেছিস কেন?’
‘পাক করে কলিজা ভুনা খাওয়ার জন্য।’ বলে রাহীম কপাল কুঁচকে বলল, ‘কানমন্ত্র না ফুসমন্তর দিয়েছ?’
দাদি সভয়ে বললেন, ‘এসব তোকে বলতে পারব না। তুই বিয়ে করলে তোর বউকে কানে কানে বলব।’
দাদির হাবভাবে আশ্বস্ত হয়ে রাহীম নিম্নকণ্ঠে বলল, ‘এমন সুবর্ণ সুযোগ জীবনে আর পাব না।’
ভয়ে সুফিয়া থরহরি শুরু করলে দাদির দিকে তাকিয়ে রাহীম বলল, ‘দাদি, আমার নাম কী?’
‘তোর নাম মো…।’ বলে দাদি কপট হাসলে, দাঁত খিঁচিয়ে রাহীম বলল, ‘আমার নাম পলাশ।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তোর নাম পলাশ।’ বলে দাদি মাথা দুলালে সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে রাহীম বলল, ‘বেশি ভাঁড়াম ভাঁড়াম করলে পলাশকে ডাকবে।’
‘ঠিকাছে, পলাশকে ডেকে বলব।’ বলে সুফিয়া কাষ্টহাসি হাসে এবং কিছু না করে দাদি মহা ব্যস্ত হন।
‘বুড়ি বেগম, ভাবীর সাথে বাড়াবাড়ি করলে ভজকট করব মনে থাকে যেন। এখন সট করে মশলা পিষে দাও।’ দাদির দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে রাহীম ধীরে ধীরে হেঁটে পাকঘর থেকে বেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে মাঠে যেয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘দাদিকে ধমকিয়েছি আজ উত্তম মধ্যম হবে। মিনমিন করে বুড়ি সবসময় মশলা পিষেন। শুনেছি আমার দাদিকেও ভোগিয়েছিলেন। কমজোর বুড়িকে ভোগাব না, ভেড়ির মত ভকড়াব।’
মাঠে ছেলেরা গোল্লাছুট খেলছিল। মারামারি করার মত কিছু না পেয়ে অন্যদের সাথে খেলায় যোগ দিতে যাবে এমন সময় তাকে ডেকে ভ্রূ দিয়ে ইশারা করে মাস্টার বলল, ‘বাড়ির পরিবেশ থমথমে হয়েছে। কী করেছিস?’
‘বিড়বিড় করে বুড়ি ভাবীকে কানমন্ত্র দিয়েছিলেন। ভাবীকে মন্ত্রমুক্ত করার জন্য ছুমন্তর বলেছিলাম।’
‘চাচাজানের হাতে জালিবেত দেখে তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আম্মাজান আমাকে পাঠিয়েছেন।’
‘কোনোএক দিন ধাক্কা মেরে বুড়িকে সাঁকো থেকে ফেলে মারব।’ দাঁতে দাঁত পিষে বলে রাহীম সামনে তাকিয়ে ছোট দাদাকে দেখে দৌড়ে যেয়ে বলল, ‘ও দাদা, দাদির যন্ত্রণায় আপনার একমাত্র ছেলে দেশান্তরী হয়েছেন। এখন আমার সাথে লেগেছেন। তাড়িয়ে দিলে আপনাকে আরেক বিয়ে করাব। কুটিলবুড়ির যন্ত্রণায় আমি অস্থির। সবকিছুতে গরম মশলার ছিটা মারেন।’
তার কাঁধে হাত রেখে দাদা বললেন, ‘আজ কী করেছিস?’
‘মশলা পিষার জন্য ঝামটা দিয়েছিলাম।’
‘শাবাশ, আজ তুই ভাবীজানের নাতির কাজ করেছিস।’ দাদা হাসতে হাসতে বলে তার পিঠে মৃদু থাপ্পড় বসিয়ে বললেন, ‘চল আমার সাথে।’
রাহীম পিছু হেঁটে বলল, ‘আমি এখন বাড়ি যাব না। আপনি ত্বরে যান, নইলে বেহুদা ঝগড়া করবেন।’
মাস্টার হেঁকে বলল, ‘কোথায় যাবে?’
‘ভাবীর বাপের বাড়ি যাব। আমার নাম শুনলে ভাবীর ভাবী মুরগি ভুনেন।’
‘আমি আসতে পারব?’
‘ঠিকাছে চলো। এখন বাড়ি গেলে আব্বাজান আমার পিটের চামড়া তুলে ঢাকঢোল বানিয়ে ছোট চাচার হাতে দিয়ে বলবেন, ও বাউলা ভাই, হালতি বাদ দিয়ে আজ একটা মারিফতি গান গা। ধুৎ, দুনিয়ার অশান্তি আমার মুঠে পুরে দুজন চলে গিয়েছেন শান্তিপুরে।’
মাস্টার কপাল কুঁচকে তাকায়। আর কথা না বলে দুজন দ্রুত সুফিয়ার বাপের বাড়ি যেয়ে মুরগি একটা জবাই করে পাকঘরের পাশে যেয়ে রাহীম বলল, ‘ভাবীর ভাবী গো, আপনার মুরগিকে মড়কে জেঁতেছিল গো ভাবী গলা কেটে হালাল করেছি।’
ভাবী চমকে উঠে চিঁক দিতে চেয়ে মাস্টারকে দেখে লজ্জিত হয়ে কপট হাসেন। উনার হাতে মুরগি দিয়ে রাহীম চুলোর পাশে বসে অপেক্ষমাণ হয়। তাড়াতাড়ি মুরগি ভুনে দিলে গণ্ডেপিণ্ডে গিলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে মাস্টারের দিকে তাকিয়ে রাহীম বলল, ‘মাস্টর ভাই, বাড়ি চলে যাও। রাতে দুই রান একলা খাব।’
এমন সময় উঠানে পরিচিত পুরুষকণ্ঠ শুনে কান পেতে মাস্টারের দিকে তাকিয়ে রাহীম বলল, ‘আব্বাজানের মধুরকণ্ঠ বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়েছে।’
‘কী বললে?’
‘জী হ্যাঁ।’ বলে রাহীম পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে দৌড়ে বাড়ি পৌঁছে দাদিকে সাঁকোতে দেখে দমকা হাওয়ার মত যেয়ে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘মশলা লাগিয়ে আরেক দিন নালিশ করলে তোমার কলিজা ভুনে খাব।’
দাদি কথা বলছেন না এবং নড়ছেন না দেখে লাফ দিয়ে নেমে হাত ধরে উঠিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে রাহীম বলল, ‘হাড়গোড় ভেঙেছে না দুয়েকটা ভাঙব?’
‘আমাকে জানে মারলে তোর দাদা বিধবা হবেন।’
‘শিয়াল মরলে শিরনি করি তুমি মরলেও শিরনি করব। কবে মরবে?’
‘তুই চলে যা। তোর ছায়ায় যমদূতকে দেখতে পাচ্ছি।’
‘গর্ত থেকে উঠতে পারবে তো না ঠ্যাং ধরে তুলতে হবে?’
‘আমি উঠতে পারব তুই চলে যা।’
দাদির হাত ধরে উঠিয়ে কপট হেসে মাথা কাত করে সাধুর মত রাহীম বলল, ‘দাদি, আমি এখন যাই?’
‘হ্যাঁ তুই যা।’ বলে দাদি জানের তরাসে ল্যাংড়ার মত দৌড়াতে শুরু করেন।
‘বুড়ির বুকে পুটির প্রাণ, পলাশকে ডর দেখাতে চান।’ বলে রাহীম দৌড়ে পাকঘরে প্রবেশ করে মাটিতে বসে হেঁকে বলল, ‘ও বউড়ি, ভাত দাও।’
হঠাৎ কড়কড় কড়াৎ শব্দে বউড়ি শুনে সুফিয়া চিৎকার করে। তার মা যেয়ে ধমকে বললেন, ‘কী শুরু করেছিস?’
‘চাইলেও কেউ আমাকে ভাত মাখিয়ে দেয় না। আম্মা, ভুখ লেগেছে ভাত দাও।’ বলে রাহীম মা’র মুখের দিকে তাকায়। মা বিচলিত হয়ে থালে ভাত তরকারি দিয়ে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি খেয়ে তোর বড় চাচার কামরায় যা। চাচি আজ নালিশ করেছেন।’
‘আরেক দিন নালিশ করলে বুড়ির কলিজায় আগুন লাগাব।’ বলে রাহীম দ্রুত ভাত খেয়ে বড় চাচার কামরায় যেয়ে হাই তুলে বিছানায় বসে বলল, ‘চাচাজান, কোথায় ঘুমাব?’
তার মাথায় হাত বুলিয়ে সস্নেহে চাচা বললেন, ‘আমার বিছানায় ঘুমালে কেউ তোমাকে খুঁজে পাবে না।’
‘আপনি কোথায় ঘুমাবেন?’
‘তোমার কামরায় আমাকে দেখলে আমার কামরায় এসে কেউ তোমাকে খুঁজবে না।’
‘চাচাজান…।’
‘এভাবে ডাকলে কেন?’
এই বই দুই খন্ডে আমাজনে প্রকাশ করেছি
Poromatthio: Volume 1 (Bengali) Paperback – 21 Jun 2016
by Mohammed Abdulhaque (Author)
Product details
Paperback: 596 pages
First edition (21 Jun. 2016)
Language: Bengali
ISBN-10: 1534824596
ISBN-13: 978-1534824591
Product Dimensions: 12.7 x 3.4 x 20.3 cm
এক সাথে পড়তে চাইলে আমাজন থেকে কিনতে পারবেন
অথবা অনলাইন পড়তে চাইলে আমার সাইটে আছে
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৫:০৯