
পৃষ্টা ৩২-৩৪
‘চাচাজান।’ বলে রাহীম চাচাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলে চাচা বললেন, ‘কী হয়েছে কাঁদছিস কেন, মেরেছে নাকি? দাঁড়া, আজ তার পিটের চামড়া তুলব।’
‘চাচাজান, ঝাড়েবংশ উজাড় হচ্ছে কেন?’
‘যা বলার বুঝিয়ে বল।’
‘নিরিবিলি বসলে কেউ আমার সাথে কথা বলে।’
‘এসব কী বলছিস?’
‘কে বা কিছু আমাকে অনুসরণ করে।’
‘ও আচ্ছা।’ বলে চাচা হাঁপ ছেড়ে তার চুল এলোমেলো করে মৃদু হেসে বললেন, ‘মনের ভ্রম হবে হয়তো।’
‘জি চাচাজান। ভাত খেয়েছেন?’
‘আমি পরে খাব। তুমি ঘুমাও আমি যেয়ে দেখি কেউ তোমার খোঁজতল্লাশি করছে কি না?’
‘দাদিজান থাকলে আজ এত চিন্তা করতে হত না।’
‘রাহীম…।’
‘চাচাজান, আমি আর কথা বলতে চাই না।’
‘কেন?’ বলে চাচা অবাকদৃষ্টে তাকালে উনার চোখের দিকে তাকিয়ে রাহীম বলল, ‘দরদিয়ার হাত ধরে দাদা দাদি আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।’
‘রাহীম।’ চাচা গর্জে উঠলে বাড়ির সবাই দৌড়ে একত্র হন। চাচাকে জড়িয়ে ধরে রাহীম কাঁদছে দেখে মা কম্পিতকণ্ঠে বললেন, ‘ভাইজান, কী করেছে?’
‘বলেছে, দরদিয়ার হাত ধরে আব্বা আম্মা তার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।’ বলে চাচা অধরদংশে তাকে জড়িয়ে ধরে শরীর কাঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন।
‘রাহীম, কী শুরু করেছিস?’ গম্ভীরকণ্ঠে বলে বাবা কামরায় প্রবেশ করলে দাঁত খিঁচিয়ে চাচা বললেন, ‘তুই এসেছিস কেন?’
‘এত আদর করলে সবাইকে কাঁদাবে।’
‘তোমরা চলে যাও।’ বলে চাচা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে চাচাকে খুলে বল।’
‘খালিবাড়ির লোকজন কোথায়?’
‘সবার মৃত্যু হয়েছে।’
‘অনেক আগে আমাদের গ্রামের একজনকে কয়েকজন মিলে হত্যা করেছিল, উনি কে এবং কারা উনাকে হত্যা করেছিল?’
‘আমি জানি না।’
‘নদীর পানি রক্তাক্ত হয়েছিল।’
‘আমি জানি না তুমি কার কথা বলছ। আমার জানামতে আমাদের গ্রামের কাউকে কেউ হত্যা করেনি। এসব কে তোমাকে বলেছে?’
‘কেউ আমাকে কানে কানে বলে। মনের ভ্রম হবে হয়তো।’
‘রাহীম, খুলে বললে সত্যাসত্য জেনে বিহিত করতে পারব।’
‘আমি আর কিছু জানি না চাচাজান। জানলে আপনাকে বলব।’
‘ঠিকাছে এখন তুমি তোমার কামরায় যেয়ে ঘুমাও।’
‘জি আচ্ছা চাচাজান।’ বলে রাহীম নিজের কামরায় যেয়ে রেজাই দিয়ে মুখ ঢাকে। চাচা পায়চারি শুরু করেন। চিন্তিতকণ্ঠে চাচি বললেন, ‘কী হয়েছে?’
‘রাহীম বলেছে আমাদের গ্রামের কাউকে কেউ হত্যা করেছিল।’
‘মাসুমকে কেউ হত্যা করেছিল।’
‘হ্যাঁ, আমি ভুলেছিলাম।’ বলে চাচা বিছানায় বসে দু হাতে মাথা চেপে ধরে বললেন, ‘গূঢ়তত্ত্ব জানল কেমনে?’
অবাককণ্ঠে চাচি বললেন, ‘কে কী জেনেছে?’
‘জন্মের আগের খবর সে জানল কেমনে? শোনো, রাহীমকে আগলে রাখবে। তোমার কথা শুনে। তাকে বুঝিয়ে বলবে সে যেন সাবধানে থাকে।’ বলে চাচা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লে চাচি অধীর হয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে, আমাকে বুঝিয়ে বলুন। আমার ভয় হচ্ছে।’
‘অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কারো আত্মা রাহীমকে অনুসরণ করে এবং অতীত বৃত্তান্তে ফুসমন্তর দেয়। ভয়ে আমরা খালিবাড়ির আশেপাশে যাই না। ঝাড়ের বাঁশ কেটে সে বাগুরা বানায়। আম্মা তাকে অত্যাদর করতেন এবং আব্বা তার সাথে কুস্তি করতেন। তাকে অবহেলা করলে অত্যহিত হবে।’
‘ছোটবউ তাকে বাবাপির ডাকত। সে সত্যি বাবাপির। চিন্তার কারণ নেই, আমাদের রাহীমের কিছু হবে না ইন শা আল্লাহ। চলুন ভাত খাবেন।’
‘ইন শা আল্লাহ। চলো।’ বলে চাচা চাচির সাথে কথা বলে খাবারঘরে যান। পরদিন চা নাস্তা খেয়ে রাহীম দা হাতে হাঁটহাঁটি করে। তাকে ডেকে সুফিয়া বলল, ‘পলাশ, আজ কলেজে যাওনি?’
‘আর যাব না।’
‘ভেড়ি রাখাল হতে চাও নাকি?’ বলে সুফিয়া দরজা বন্ধ করতে চাইলে রাহীম বলল, ‘ও বউড়ি, আমাকে এত ভয় পাও কেন?’
‘তুমি ভয়দ।’
‘ভয় ভীতি আর ভালো লাগে না। এতদিন একা ছিলাম, ব্যস্ত থাকার জন্য মারামারি করতাম। ভুখ লাগলে মুরগি পুড়ে খেতাম। থাক ওসব, তুমি আমাকে এত ভয় পাও কেন? তুমি তো গেছো ছিলে। কানের গোড়ায় রক্তজবা গুঁজে গুনগুন করতে। পুটির মত মনানন্দে সাঁতরাতে। আমাদের বাড়ি এসে কী হয়েছে?’
‘ধাইমার সতিন আইমা গো, ভণ্ডাই এতসব জানে কেমনে গো?’ বলে ভয়ে শিউরে থু বিছমিল্লাহ বলে বুকে থুথু দিয়ে সুফিয়া বলল, ‘তোমার হাতে দা থাকে এবং আমি যা কল্পনা করতে পারি না তুমি তা বাস্তবে করো। আজ তোমার কী হয়েছে?’
‘জানতে চাইলে বেরিয়ে আসো। পুকুর ঘাটে বসে মনানন্দে গপসপ করব, কেউ মশলা লাগাতে পারবে না।’ ডালের দিকে তাকিয়ে বলে রাহীম হাতের ইশারায় ডাকে। সুফিয়া পিছু হেঁটে দেয়ালে ঠেকে মাথা নেড়ে বলল, ‘না ভণ্ডাই না। ভর দুপুরে তোমার সাথে, তাও পুকুর ঘাটে মানে কল্লা কেটে ঘাটের পইঠার নিচে ডুবিয়ে রাখতে চাও। ও মাই গো, আমার গর্দান নেওয়ার কুবুদ্ধি আজ তোমাকে দিয়েছে। তোমার সাথে গল্পগুজব করতে চাই না। যাও, তুমি তোমার কাজ করো যেয়ে। অকাল-বসন্তে বেঘোরে মরতে চাই না।’
‘দূর ভাবী, তুমি আমার একমাত্র দরদিয়া। আমার ভয়ে ভীষিতা হলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে। অকালে তোমাকে মারলে আমাদের কবরে কে চেরাগ জ্বালাবে? মাস্টর ভাই চিরকুমার হওয়ার পণ করেছেন। তুমি মরলে তোমার বিরহে ছোট চাচারপাশে বসে মান্দিরা বাজিয়ে ভাইজান হাউমাউ করে কাঁদবেন। এখন তুমি বলো তারপর কী করব?’ বলে রাহীম অপলক দৃষ্টে তাকায়। সুফিয়া ইনিয়ে বিনিয়ে বললেন, ‘পলাশ, আমার নতুন বিয়ে হয়েছে। আল্লা’র দোহাই দিচ্ছি অকালে মারিস না।’
‘ঠিকাছে। এই দেখো, আশমানের দিকে তাকিয়ে কিরা না খেয়ে তিনসত্য বলছি, তোমাকে মারব না। এই নাও।’ বলে রাহিম দা ছুড়ে মারে। সুফিয়া হাঁইহুঁই এবং লম্ফঝম্প শুরু করলে রাহীম বিরক্ত হয়ে বলল, ‘দূর ভাবী, আয় কথা আছে, না আসলে বল চলে যাই।’
সুফিয়া তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে বলল, ‘দাঁড়াও, আসছি।’
‘পুকুর ঘাটে আসো।’
‘দাঁড়াও দেবরমশাই যেয় না।’ বলে সুফিয়া শাড়ির আঁচল মাথায় দিয় বেরোয়। ততক্ষণে সে পুকুর ঘাটের হাওয়াখানায় বসে পানিতে ঢিল ছুড়ে চিন্তিত হয়। সুফিয়া যেয়ে বসলে চোখ পাকিয়ে দুহাত উঁচিয়ে রাহীম বলল, ‘বউড়ি গো, মনের আশা আর মিটবে না গো।’
সুফিয়া দু চোখ বুজে চিৎকার করতে চাইলে হাসতে হাসতে রাহীম বলল, ‘কড়কড় করে করল্লা বুড়ি এত ভয়ংকর কেচ্ছা শুনিয়েছেন নাকি?’
‘অবলা আমি অকাল-বসন্তে মরতে চাই না গো দেবরমশাই।’ ইনিয়ে বিনিয়ে বলে সুফিয়া ঘনঘন শ্বাস টানতে শুরু করে। রাহীম হেসে কুটিপাটি হয়ে পুকুরের দিকে তাকিয়ে বিশারদের মাথা দুলিয়ে বলল, ‘করল্লাবুড়িকে কিষ্কিন্ধ্যায় পাঠাতে হবে। এখন তুমি স্বস্তি ঠায়ে বসো। মারমুখো হলেও আমি তোমাকে মারধর করব না। শোনো, বুড়ির গাছে আনার পেকেছে, খাবে?’
‘না গো দেবর, মরার পণ এখনো করিনি।’
‘দূর ভাবী, তোমার কল্লার ভিতর একরতি ঘিলু নেই। অকালে তোমাকে মারলে কে আমাকে চাচা-আব্বা ডাকবে? যাক, দোধারিতে বসে দোল খেতে চাও নাকি?’
সুফিয়া চোখ বুজে মাথা নাড়লে, রাহীম অন্তহাসি হেসে বলল, ‘দাদির চিন্তায় চিন্তিত হতে হবে না। দাঁত খিঁচিয়ে ঝামটা মারলে সাত গরু মানত করলেও মুরগির গলা কেটে শিরনি করেন না।’
‘হুঁশ ষোলো আনা ঠিকাছে, তাইলে এমন করো কেন?’
‘জানি না।’ বলে রাহীম ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে মুরগি দেখে তালে বৈতালে গাওয়ার চেষ্টা করে, ‘ও মরগি তুই আর ডাকিস না, ডাকিস না মুরগি লো। ও মুরগি, গাঁও গ্রামে মড়ক এসেছে তোকে হালাল করতে হবে লো।’
‘দেবরমশাই, আমি যাই? আরেক দিন গল্পগুজব করব।’ বলে সুফিয়া কপট হাসে। বসার জন্য হাত দিয়ে ইশারা করে রাহীম বলল, ‘তোমাদের গাছের বড়ুই জবর মজা। যেয়ে এক কোল নিয়ে আসব?’
‘বারবেলায় ভাব জমাতে চাও নাকি?’ বলে সুফিয়া ঠোঁটটিপে হেসে ভ্রূ দিয়ে ইশারা করে। রাহীম বুক ভরে শ্বাস টেনে হাঁপ ছেড়ে বলল, ‘ভাবী এবং দাদি হলেন পরাণের বান্ধবী।’
‘বুঝেছি, ছোঁচা তুমি ছোঁকছোঁক করে ছোঁকা খেতে চাও।’ বলে সুফিয়া বিদ্রুপ হাসলে রাহীম মাথা নেড়ে বলল, ‘তুমি হয়তো জানো, অন্তর কলুষিত হলে জলশৌচে শুচিতা লাভ হয় না।’
‘হ্যাঁ, অগ্নির স্পর্শে শোধিত হতে চাইলে ছ্যাঁকায় ফোঁসকা ওঠে।’
‘তালুকদারের সম্পত্তির লোভে তালেগোলে কথা বললে নারকেল তো দূরের কথা ছোবড়াও পাবে না?’
‘ভাঁড়ামি করো তুমি জানো না, ভাঁড়ের চা খেয়ে আমি একভাঁড় দই খালি করে লোভকে ভাঁড়ে ভরেছি।’
এই বই দুই খন্ডে আমাজনে প্রকাশ করেছি
Poromatthio: Volume 1 (Bengali) Paperback – 21 Jun 2016
by Mohammed Abdulhaque (Author)
Product details
Paperback: 596 pages
First edition (21 Jun. 2016)
Language: Bengali
ISBN-10: 1534824596
ISBN-13: 978-1534824591
Product Dimensions: 12.7 x 3.4 x 20.3 cm
এক সাথে পড়তে চাইলে আমাজন থেকে কিনতে পারবেন
অথবা অনলাইন পড়তে চাইলে আমার সাইটে আছে
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৫:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




