somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাংবাদিকতার প্রবাদপুরুষ, সাহিত্যসেবী, 'সওগাত' সম্পাদক ও ‘বেগমের’ প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

২১ শে মে, ২০১৩ সকাল ৯:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সাংবাদিকতার প্রবাদপুরুষ, সাহিত্যসেবী, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ছিলেন শতাব্দীর সূর্য। দীর্ঘদিন ধরে যিনি প্রতিনিয়ত বাঙালি মুসলমান সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার দূর করতে আলো ছড়িয়েছেন। আর সেই আলোয় আলোকিত হয়েছেন আজকের প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য শিক্ষিত, রুচিবান ও সংস্কৃতিমান বাঙালি মুসলমান। উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরনো মহিলাদের পত্রিকা ‘বেগমের’ প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৯৪ সালের ২১ মে আজকের এইদিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুদিনে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।


উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে ১৮৮৮ সালের ২০ নভেম্বর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন চাঁদপুরের পাইকারদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নাসিরউদ্দীন আবদুর রহমান ও আমেনা বিবির জ্যেষ্ঠ সন্তান। বাবা তাঁর সন্তানকে শিক্ষিত করার জন্য নিজ গ্রাম থেকে অনতিদূরে হরিণা গ্রামে ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়তে পাঠান। নাসিরউদ্দীনের বয়স যখন মাত্র আঠারো বছর, তখন তাঁর বাবা মারা যান। বাবার অবর্তমানে সংসারের গুরুদায়িত্ব বহন করতে হয় নাসিরউদ্দীনকে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে তখন তিনি স্বল্প বেতনে স্টিমার কোম্পানিতে স্টেশন মাস্টারের সহকারী হিসেবে চাকরি শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই ওরিয়েন্টাল লাইফ ইনস্যুরেন্সের এজেন্টের কাজ নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। এখানে কাজ করে অর্থ সঞ্চয় করেন। কিছুটা পুঁজি হলে চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর তিনি তাঁর লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নের প্রয়াস নেন। প্রকাশ করেন মাসিক সওগাত। ১৯১৮ সালের ২রা ডিসেম্বর তিনি প্রথম মুসলিম সম্পাদক হিসেবে সওগাত পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকা প্রকাশের পর চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে স্বাভাবিক প্রকাশনা ব্যাহত হলে কিছুদিন পত্রিকা বন্ধ রাখেন। ১৯২৬ সালে পুনরায় প্রকাশনা শুরু করে ১৯৪৭ সাল পযর্ন্ত একটানা প্রকাশনা অব্যাহত রাখেন।


সওগাত প্রকাশনা ছিল বাঙালি মুসলমানের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের উৎস। মুসলিম বাংলার সাহিত্য, সমাজ সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য সওগাত প্রকাশনার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষার্ধ থেকেই নাসিরউদ্দীন সওগাত-এর মাধ্যমে সমাজ চেতনা, মুক্তবুদ্ধির চেতনা, প্রগতিশীল চেতনা এবং বাঙালি মুসলমানের মননচিন্তা, মেধা জাগ্রত ও বিকাশ করতে এবং প্রসার ঘটাতে নিরন্তর কাজ করে গেছেন। তাঁরই প্রেরণায় ও উৎসাহে মুসলিম সমাজের অগণিত লেখক ও সংস্কৃতিসেবী নিজ প্রতিভা বিকাশের পথ খুঁজে পেয়েছেন। সওগাত পত্রিকার প্রথম সংখ্যাই সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই সংখ্যায় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, মানকুমারী বসু, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, রমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কায়কোবাদ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখের লেখা ছাপা হয়। নজরুলের সৃষ্টিকর্মের পৃষ্ঠপোষকতায় সওগাত-এর ভূমিকা ছিল অনন্য। সওগাত পত্রিকা প্রকাশ করে নাসিরউদ্দীন মুসলিম সমাজের মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার দ্বার খুলে দেন। ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক ও রক্ষণশীলদের আক্রমণ সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করেন এবং সওগাতকে জাতীয় দর্পণরূপে তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠা করেন। সওগাতকে ঘিরে তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, শামসুন্নাহার মাহমুদ, বেগম সুফিয়া কামাল সহ অসংখ্য কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে ‘সওগাত সাহিত্য মজলিস’ গড়ে তোলেন। একই সঙ্গে নারীদের প্রত্যক্ষভাবে সাহিত্য অঙ্গনে আনার জন্য তিনি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। ১৩৬৬ (বাংলা) সনে ভাদ্র মাস সংখ্যাটি শুধু মহিলাদের লেখা ও তাঁদের চিত্রসহ সচিত্র মহিলা সওগাত প্রকাশ করেন। এই সংখ্যাটি নারী জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে অনন্য ভূমিকা পালন করে। সেই সময় অবরোধবাসিনী মুসলিম নারীদের পত্রিকায় লেখা ছাপানো ছিল অপরাধ। নাসিরউদ্দীন সেই অর্গল ভেঙে মহিলাদের ছবিসহ লেখা ছাপিয়ে বাঙালি মুসলিম সমাজের নারীদের উন্নততর স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন।


নাসিরউদ্দীনের উল্লেখযোগ্য অবদান হলো সাপ্তাহিক পত্রিকা "বেগম"। তিনি মুসলিম নারীদের মধ্যযুগীয় পর্দার বাইরে মুক্ত আলোয় আনার সংগ্রামকে ব্রত হিসেবে নেন এবং নারীদের জন্য প্রথম মহিলা পত্রিকা বেগম প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের নারীদের সৃজনশীলতা বিকাশের ক্ষেত্রে বেগমের নাম শ্রদ্ধায় উচ্চারিত হয়। বেগম পত্রিকার সূচনা হয় ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই। কলকাতায় এর প্রথম প্রকাশ। নাসিরউদ্দীন প্রতিষ্ঠিত বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন নারী জাগরণের আরেক পথিকৃৎ কবি সুফিয়া কামাল। সবার প্রিয় খালাম্মা। তাঁর নেতৃত্বে ওই সময় বেগম নারী জাগরণের প্রধান মুখপাত্রে পরিণত হয়। বেগমের শুরু থেকে নূরজাহান বেগম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। পরবর্তীতে তাঁর বিয়ে হয় রোকনুজ্জামান খানের (দাদা ভাই) সঙ্গে। দাদা ভাই এদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিশু-কিশোর সংগঠক ও লেখক। তাঁর উদ্যোগে কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে ঢাকায় চলে আসে নাসিরউদ্দীন পরিবার। সওগাত ও বেগম পত্রিকাও তখন কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। বেগম-এর বয়স তখন মোটে সাড়ে তিন বছর। বুড়িগঙ্গার কাছে লয়াল স্ট্রিটের প্রেসটি ছিল চারদিকে খোলামেলা। ঢাকায় এসে নুরজাহান বেগম ৩৮নং শরৎগুপ্ত রোডের বাড়িতেই বেগমের কাজকর্ম শুরু করেন। এখানেই হয় পত্রিকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় 'বেগম ক্লাব'। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ, সেক্রেটারি হন নুরজাহান বেগম। বেগম সুফিয়া কামাল অন্যতম উপদেষ্টা।


মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন বিশ্বাস করতেন, নারীকে শতবর্ষের কূপমণ্ডূকতা থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে। এই সচেতনতা নারীদের মাঝে সঞ্চারিত করার জন্য এবং সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নারীদের উৎসাহিত করার জন্য তিনি ১৯৫৪ সালে ‘বেগম ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ক্লাবে দেশের বরেণ্য নারীদের সংবর্ধনা দেওয়া হতো। পর্দার অচলায়তন ভেঙে মুসলিম নারীরা বেগম পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। আজকের লব্ধপ্রতিষ্ঠ বেশির ভাগ মুসলিম নারী বেগম পত্রিকায় আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যাঙ্গনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। নাসিরউদ্দীনের সুযোগ্য কন্যা নূরজাহান বেগম আজও পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশ করে চলেছেন।


বেগম প্রায় ৬৭ বছর ধরে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। প্রগতিশীল নাসিরউদ্দীন আজীবন মুসলিম নারীর স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও নারীমুক্তির জন্য একজন প্রত্যয়ী সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখ অগণিত নারীর সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে নাসিরউদ্দীনের অবদান চিরস্মরণীয়।


সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, বাংলা একাডেমী পুরস্কার সহ অসংখ্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৯৪ সালের ২১ মে আজকের এইদিনে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুদিনে শতাব্দীর সূর্য এই মৃত্যুঞ্জয়ীকে অভিবাদন।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৩ দুপুর ১:৫৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×