somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙালি শিক্ষাবিদ, লেখক, ভাষাসৈনিক ও বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ'র জন্ম শতবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা

১৫ ই এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৮:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রগতিশীল চিন্তার বাহক, আপসহীন আদর্শবান ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবী, খ্যাতিমান বাগ্মী ও খ্যাতনামা লেখক ও শিক্ষাবিদ অজিতকুমার গুহ। এই প্রজন্মের অনেকেই হয়তো তাঁকে চেনেন না। কিন্তু পাকিস্তান আমলে বৈরী পরিবেশে তিনি দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিকাশে এবং মানবতার মূল্যবোধ ও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে যে অবদান রেখে গেছেন, তার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। একজন মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে এদেশের অসাম্প্রদায়িক ও র্ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ধারা নির্মাণে তাঁর অবদান ও সাফল্য অপরিসীম। রবীন্দ্রসাহিত্যের অধ্যাপক এবং সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। অজিতকুমার রাজনীতি না করেও সংস্কৃতি চর্চার কারণে পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে দুইবার কারারুদ্ধ হন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার জন্য ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এবং ১৯৫৪ সালের ৩০শে মে গ্রেফতার হন। রবীন্দ্রসাহিত্যের অধ্যাপক, লেখক, ও বুদ্ধিজীবী অজিতকুমার গুহ ১৯১৪ সালের আজকের দিনে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার ১০০তম জন্মবার্ষিকী। বাঙালি শিক্ষাবিদ, ভাষা সৈনিক ও বুদ্ধিজীবী অজিতকুমার গুহ'র জন্ম শতবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা।


অজিতকুমার গুহ ১৯১৪ সালের ১৫ই এপ্রিল কুমিল্লা শহরের সুপারিবাগানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নৃপেন্দ্রমোহন গুহ। ১৯৩০ সালে তিনি কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালা থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন।এর পর ১৯৩২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আই. এ এবং ১৯৩৬ সালে বি. এ পাস করার পর একই বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৩৯ সালে সেখান থেকে বাংলায় এম. এ পাস করেন। পরে তিনি বি.টি পরীক্ষায়ও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন। এর পর তিনি চলেযান ভারতের শান্তিনিকেতনে। অজিতকুমার ১৯৪০-৪২ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে ছিলেন। এসময় তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্পর্শে আসার বিরল সুযোগ লাভ করেন এবং রবীন্দ্রসাহিত্যে বিশেষ ব্যুৎপত্তিলাভ করেন। পরর্বর্তীকালে এ বিষয়ে তিনি প্রজ্ঞাবান ও মননশীল প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা, সোনার তরী ও গীতাঞ্জলি এবং কালিদাসের মেঘদূত-এর মত গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন ও এগুলির জন্য মূল্যবান ভূমিকা লেখেন।


(জগন্নাথ কলেজের সহকর্মীদের সাথে অজিত গুহ)
১৯৪২ সালে কলকাতার শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে এসে ঢাকার প্রিয়নাথ হাইস্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু করেন। প্রায় ছয় বছর এই স্কুলে শিক্ষকতা করার পর ১৯৪৮ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও পরে বিভাগীয় প্রধান হন। তাঁর জীবনের সুখ-দুঃখের অনেক স্মৃতির সঙ্গে জগন্নাথ কলেজের নাম জড়িয়ে আছে। ছাত্রছাত্রীদের অপরিসীম শ্রদ্ধা, সহকর্মীদের আন্তরিকতা তিনি পেয়েছিলেন। কলেজ প্রশাসনের উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অজিতকুমার গুহ শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক স্রোতধারার সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠায় নিজের শ্রম ও মেধাকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন। জগন্নাথ কলেজ ছেড়ে তিনি ঢাকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার জন্য অজিতকুমার যেমন শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন; আবার এই একই কারণে সরকারের রোষানলে পড়ে তিনি ১৯৪৮ সালে প্রথম কারাবরণ করেন। তাছাড়া ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার জন্য ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি গ্রেফতার হন। প্রায় দেড় বছর কারাভোগের পর মুক্তি পেয়ে তিনি ১৯৫৪ সালের ৩০শে মে ৯২-ক ধারায় পুনরায় গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় এক বছর কারাভোগ করেন। তাঁর কারাজীবনের সঙ্গী ছিলেন আবুল হাশিম, অলি আহাদ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী প্রমুখ। দীর্ঘ সময় কারাবাস করার কারণে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের খণ্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৬৮ সালের ৩১ জুলাই এখান থেকে অবসর নেন।


(চীনা লেখক প্রতিনিধিদলের সাথে অজিতকুমার গুহ; সৈয়দ আহমদ হোসেন ও অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী)
একজন কৃতী সাতিহ্য সমালোচক হিসেবে সর্বমহলে অজিতকুমার গুহ ছিলেন সমাদৃত। সম্পাদনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্তের অধিকারী। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থঃ মেঘদূত, কৃষ্ণকান্তের উইল, গল্পগুচ্ছ, সোনার তরী ও গীতাঞ্জলি। তাঁর প্রকাশিত গল্প, প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথার সংখ্যা অনেক। কায়কোবাদ: কাব্য সৃষ্টির পটভূমিকা, নজরুল কাব্যে পুরাণ, রবীন্দ্রকথা, রবীন্দ্র কাব্যে পরবর্তী পরিবর্তন, রবীন্দ্রনাথ ও পদ্মা শীর্ষক প্রবন্ধগুলো পাঠ করে বাংলা সাহিত্যে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীরা বিশেষ উপকৃত হচ্ছে। অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ ও আনিসুজ্জামান রচিত ও সংকলিত নতুন বাংলা রচনা আজও ছাত্রছাত্রীদের কাছে অতি মূল্যবান গ্রন্থ। এছাড়াও সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনি বহু প্রবন্ধ রচনা করেন। রবীন্দ্রসাহিত্য ও সংগীত বর্জনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অন্যতম পুরোধা অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ ছিলেন কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা এবং মাসিক কচি ও কাঁচার অন্যতম উপদেষ্টা। ছোটদের তিনি অনেকগুলো মূলবান রচনা উপহার দিয়েছেন। এগুলো মাসিক কচি ও কাঁচা, টাপুর-টুপুর, কচি-কাঁচার আসর এবং রক্তসূর্য, লাল পলাশ বিক্ষুব্ধ বাংলা ও অরনি সংকলনের প্রকাশিত হয়। তার উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ রচনাগুলো হলোঃ উত্সবের আলো, একটি ঘোড়ার অপমৃত্যু, একুশে ফেব্রুয়ারি হবে, একুশের চিন্তা, কালো ব্যাজ, ডাক, পদ্মার কবি রবীন্দ্রনাথ, বুলু, বাঘিনী, কবিয়াল রমেশ শীল, বোকার হাতী, ওরাও কাঁদে, যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই, যে ফুল শুকাবে না, রবীন্দ্রকথা, সাতাশে এপ্রিল, সেদিন আর এদিন ও হোসেনের মা।


চিরকুমার এই বুদ্ধিজীবী ১৯৬৯ সালের ১২ই নভেম্বর চট্টগ্রাম যাবার পথে জন্মস্থান কুমিল্লার সুপারিবাগানে কাকীমা শৈবালিনীর গৃহে প্রাণ ত্যাগ করেন। অজিত কুমার গুহ'র মৃত্যুর পরে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য অধ্যাপক অজিত কুমার গুহকে ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পুর্তি উপলক্ষ্যে মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ভাষা সৈনিক সম্মাননা পদক ও ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন তমুদ্দন মজলিস মাতৃভাষা পদক-২০০৪ এ ভূষিত করেছেন। মহান ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্যে বাংলাদেশ সরকার অধ্যাপক অজিত কুমার গুহকে মরণোত্তর ২১ শে পদকে ভূষিত করেন। দেশের শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, তা অতুলনীয়। মার্জিত ও পরিশীলিত রুচি, অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং আদর্শ শিক্ষক ও দেশপ্রেমে অঙ্গীকারবদ্ধ ব্যক্তি হিসেবে তিনি সমকালে অর্জন করেছিলেন অজস্র মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। অসাম্প্রদায়িক ও পরিচ্ছন্ন রুচির একজন খাঁটি বাঙালি হিসেবে দেশের মানুষ আজো তাকে গভীর শ্রদ্ধার সংগে স্মরণ করেন


সফল শিক্ষক, সার্থক বক্তা, সচেতন নাগরিক ও বাঙালি সংস্কৃতির একনিষ্ঠ ধারক ভাষা সৈনিক অজিতকুমার গুহ'রআজ ভাষাসৈনিক অজিত কুমার গুহ'র ১০০তম জন্মবার্ষিকী আজ। বাঙালি শিক্ষাবিদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবী অজিতকুমার গুহ'র জন্ম শতবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৮:৪৮
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

রোম যখন পুড়ছিল নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল; গতরাতের ঘটনায় ইউনুস কে কি বাংলার নিরো বলা যায়?



বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি সবসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং।‌ "আল্লাহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×