হঠাত টুং করে একটা শব্দ হল মোবাইলে। আকাশ মোবাইলটা তুলে নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে তাকালো। ফেইসবুক মেসেঞ্জারে মেসেজ এসেছে। পাশে ছোট্ট করে যে ছবিটা ভেসে উঠলো সেটা দেখেই সে ধড়পড় করে উঠে পড়লো। ঘুম নিমিষের মধ্যেই উধাও। উধাও তো হবেই দীর্ঘ এক বছর ৩মাস ১২ দিন পর এই আই ডি থেকে মেসেজ এসেছে। মাঝখানে অবশ্য ১মাস আগেও এসেছিল। সেদিনও অবশ্য এভাবেই চমকে উঠে হিসেব করেছিল…১বছর ২মাস ১০দিন। যাই হোক। খুব উত্তেজিত হয়ে সে মেসেজ খুলে আবারো চমকে উঠলো। বিয়ের সাজে নীলা। একটা লাল শাড়ী আর প্রচুর গয়না গায়ে… হাত ভর্তি লাল চুড়ি। মাথায় ঘোমটা দেয়া। ১ মাস আগে পাঠানো মেসেজের দ্বিতীয় অংশ আজ এসেছে। এক মাস আগে ছিল বিয়ের কার্ডের ছবি। আর আজ বিয়ের সাজে।
আজ নীলার বিয়ে। ঠিক এভাবেই একদিন দেখতে চাইছিল আকাশ নীলাকে। মনে পড়ে গেল আকাশের। একদিন নীলা লাল রঙের একটা জামদানি শাড়ি পড়ে দেখা করতে এসেছিল। আকাশ তখন বলেছিল “এরপর যেদিন লাল রঙের শাড়ি পড়বে সেদিন লাল বেনারসির সাথে ঘোমটা দেয়া থাকে থাকবে। তুমি আমার লাল টুকটুকে বউ সেজে থাকবে। আর আমি মেরুন কালারের একটা পাঞ্জাবি পড়বো।“ যাক… নীলা মনে রেখেছে। লাল বেনারসি পড়েছে। তবে আজ সেটা আকাশের জন্য না। পড়েছে অন্য একটা মানুষের জন্য। আকাশ নীলা সেই ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এক সাথে। একই ক্লাশে,একই গ্রুপে। একসাথে পড়াশুনা…গল্প…আড্ডা…সেই থেকে প্রেম। আকাশ ছাত্র হিসেবে অনেক ভালো। নীলা মোটামুটি। বড়লোক বাপের একমাত্র অপরুপা সুন্দরী মেয়ে। অনেক আদুরী। আকাশ কোন ভাবেই ওর সাথে ঠিক খাপ খায়না। সে গ্রাম থেকে আসা…ভার্সিটির হলে থাকা সাদাসিধে একটা ছেলে। বাবার কাছ থেকে টাকা নেবার মত সাহস নেই তার। বাসায় আরো দুজন বোন আর এক ছোট ভাই আছে। নিজের খরচ তাই সে নিজেই চালায় টিউশনি করে। নীলাকে আকাশের প্রথম দিন থেকেই ভালো লাগতো। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেনি। তাই নীলা যখন তাকে প্রপোজ করলো তখন খুব অবাক হয়ে বলেছিল… “ ভেবে বলছিস তো?? আমার সম্পর্কে সব জেনে নিয়ে বলছিস তো?? আমার কিন্তু তোর মত বাড়ি গাড়ি…” পুরোটা বলতে পারেনি…তার আগেই নীলা তাকে জড়িয়ে ধরে বললো.. “জানি, সব জানি। ভালোবাসি তোকে ব্যাস” এভাবেই শুরু হল। দীর্ঘ ৫ বছর ৭ মাস প্রেমের পর নীলা একদিন হঠাত আকাশকে বাসায় নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল নীলার বাবা মার সাথে। এরপরের দিন নীলা এসে জানালো বাবা তাদের এই সম্পর্ক মেনে নিচ্ছেন না। আকাশ নাকি কোন ভাবেই তাদের স্ট্যাটাস এর সাথে মেলে না। এরপর থেকে আকাশ অনেকদিন নীলাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে… ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। নীলা নাম্বার চেঞ্জ করে ফেলেছে। ফেইসবুক থেকে আকাশকে সরিয়ে ফেলেছে। ভাইবার থেকে ব্লক করে দিয়েছে। আকাশ মাঝে মাঝে নীলার ফেইসবুক সার্চ করে দেখে নীলা সেই আগের মতই আছে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা…বড় বড় রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া…হাসাহাসি…সেল্ফি…সব চলছে। মাঝখান থেকে আকাশ থেমে গেছে। ওর জীবনের সব কিছু থেমে গেছে। এক মাস আগে এরকমই এক বিকেলে নীলা তার বিয়ের কার্ডের ছবি তুলে পাঠিয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল আকাশের সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। উদ্ভ্রান্তের মত ছোটাছুটি করেছে সে। আজ আবার আরেকটা ছবি। বিয়ের সাজে কনের সেল্ফি। আকাশের যেন আজকে বুকটা ভেংগে চুরমার হয়ে গেল। কিভাবে পারলো নীলা? কেন এত কষ্ট দিচ্ছে? বিয়ে করবি কর। প্রেম করার সময় তো কত মিষ্টি মিষ্টি প্রতিজ্ঞা। আর আজ নীলা আরেকজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। মেয়েরা পারে এভাবে মানুষকে কষ্ট দিতে। কি সুন্দর হাসি মুখ করে সেল্ফি তুলে আবার মেসেজও করেছে। একেবারে মরার ওপর খাড়ার ঘা। হায়রে মানুষ। পাগল পাগল লাগছে আকাশের। বের হয়ে গেল বাসা থেকে। হাঁটছে তো হাঁটছেই। থামাথামি নেই। পাগলের মত হা্ঁটতে হাঁটতে একটা ওষুধের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। এক পাতা ঘুমের ওষুধ কিনতে চাইলো। দোকানদার কোনভাবেই এক পাতা দিতে রাজি না। শেষে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে ৫টা ঘুমের ট্যাবলেট কিনে বাসায় ফিরলো। কিছুক্ষন ফেইসবুকে নীলার প্রোফাইল ঘাটাঘাটি করে নীলার পাঠানো সেল্ফিটা দেখে ৫টা ঘুমের ওষুধ একবারে খেয়ে ফেললো। সে জানে এই ৫টায় কিচ্ছু হবে না। খুব বেশি হলে টানা দু'দিন ঘুমাবে। এরপর শুয়ে শুয়ে নীলাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে জানেনা। ঘুম ভাংলো ফোনের রিংটোন শুনে।
অনেকক্ষণ থেকে ফোন বাজছে। আকাশ ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো অপরিচিত নাম্বার। সে ফোনটা কেটে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। আবার ফোন বাজা শুরু হল। আকাশ এবার খুব বিরক্ত হয়ে ফোনটা কানে লাগালো। “হ্যালো”।
“হ্যালো…আকাশ?”
“হ্যা, বলছি। কে বলছেন?”
“আমি পুলিশ স্টেশন থেকে বলছি। আপনাকে একবার এখানে আসতে হবে।“
“কি? কেন? কি হয়েছে?”
“কাল সন্ধায় নীলা নামের একটি মেয়ে সুইসাইড করেছে। ওর ডেডবডির পাশে ফোনটা পড়ে ছিল। তাতে দেখলাম সুইসাইড করার ঠিক কিছুক্ষন আগে নীলা ফেইসবুক থেকে আপনার ফেইসবুকে একটা ছবি পাঠিয়েছে। আমরা আপনার কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই। পালানোর চেষ্টা….”
আরো কি কি যেন বলছিল লোকটা। কিন্তু কিছুই কানে ঢুকলো না আকাশের। হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। আকাশ মাটিতে বসে পড়লো। কিছুই বুঝতে পারছেনা।চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল আকাশের। শুধু চোখে ভাসছে নীলার কনের সাজে তোলা সেল্ফি।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৫:৪৩