তো, ধন নয় মান নয় এতটুকু বাসা, ... থুককু, বাসা নয় মেস। সেই মেস খোঁজার জন্যে আমি আর আমার বন্ধু চপল পুরো ফার্মগেট এলাকা চষে বেড়াচ্ছি। ফার্মগেট কেন? কারন কোচিং সেন্টারগুলো সব ওখানে গিয়েই উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও ভ্যাকেন্সি নাই। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করি, কিন্তু কাজ হয় না, পরে ঠিকানা টুকে নিয়ে হাঁটা দিলাম। যেখানেই দেখি টু-লেট, অথবা বাসা ভাড়া দেয়া হবে, সেখানেই একবার ঢুঁ মারি। কিন্তু হায়! বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলতে গিয়ে হয় আরও আজব অভিজ্ঞতা। প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, ' আপনারা কি স্টুডেন্ট?'
ঘাড় কাত করে স্টুডেন্ট হবার অপরাধ স্বিকার করি। হ্যাঁ, তাই। মেস খুঁজে বেড়াতে হয়েছে এমন ছাত্র মাত্রই জানেন ঢাকা শহরে স্টুডেন্ট হওয়া বিরাট অপরাধ!
' না ভাই, আমরা স্টুডেন্টদের ভাড়া দিই না।'
হতাশ হই, এবং অবাক লাগে। পৃথিবীতে এমন কোন মহামানব আছে যে স্টুডেন্ট না থেকেই সরাসরি চাকরি পেয়েছে? তবু হাল ছাড়লে তো চলবে না, খুঁজে যাই। বিচিত্র সব বাড়ি, বিচিত্র সব ব্যাপার স্যাপার।
একটা বাসায় গেলাম, টিনের ঘর ভাড়া দিবে। বাড়িওয়ালার অসীম দয়া- আমরা স্টুডেন্ট জেনেও তিনি রাজি হয়েছেন। বেশ ভালো, সবই ঠিক আছে। কিন্তু লাগোয়া কোন টয়লেট নেই। সেটা হলো ভেতর বাড়িতে। মানে বাড়িওয়ালার টয়লেট। তাতে কি? ঘর পেয়েছি এই ঢের! কিন্তু না, শর্ত আছে। তা হলো, রাত দশটার পরে সামনের গ্রিলে তালা দেয়া হবে তাই ভেতরের টয়লেটে যাওয়া যাবে না।
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল! কি আচানক কথা! মানুষের টয়লেটের কি কোন ঠিকঠিকানা আছে নাকি? প্রকৃতির খেয়াল..., কখন যে সে ডাক দিবে আর কখন যে আমাদের বদনা হাতে দৌড় দিতে হবে সেটা আগে থেকে কেমন করে জানব? পেট তো আর জানে না যে রাত দশটার পরে টয়লেট বন্ধ!
তাই, ইচ্ছা নাহি হয় হায়.., তবু.....।
অন্য বাসা খুঁজতে বের হলাম।
স্টুডেন্টদের ব্যাপারে এত আপত্তি কেন? এক ঠোঁটকাটা বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিলেন, ' ওদের কোন গ্যারান্টি থাকে না। কখন যে টাকা না দিয়েই চলে যায় তার কোন ঠিক নেই।'
আমরা তখন তাকে তেল দেয়া শুরু করলাম। আমাদের পূর্ব ইতিহাস জানালাম, কলেজ থেকে দেয়া চারিত্রিক সনদপত্র দেখালাম, পৃথিবীর কোন প্রান্তেই যে বহু খুঁজেও আমাদের মত ভদ্্র, শান্ত ও ভালো ছেলে পাওয়া যাবে না তা-ও বোঝালাম।
এক পর্যায়ে থাকতে না পেরে চপল বলল, ' দরকার হলে আপনি আমাদের মেইন মার্কশীট জমা রাখেন!'
কিন্তু শিকে ছিড়লো না। মেইন মার্কশীটের মর্ম ঐ পাষান কি করে বুঝবে?
খুঁজতে খুঁজতে একদিন এক হতাশ দুপুরে এসে পৌঁছলাম একটা একতলা বাড়ির সামনে। টু-লেট লেখা দেখে গেট ধাককাতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল সুবহানাল্লাহ সাক্ষাৎ এক ডানাকাটা পরী! আমাদের বুকের ভেতরের ছোট্ট হার্টদুটো ততক্ষনে টগবগে দুখানা অ্যারাবিয়ান ঘোড়া হয়ে ছুটতে শুরু করেছে!
'কাকে চাই?'
জানালাম, বাড়িওয়ালাকে চাই।
' দাঁড়ান, আব্বাকে ডেকে দিচ্ছি। '
খানিকপর আব্বাজান এলেন। এসেই উনি প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ' আপনারা কি ব্যাচেলর?'
ঘোড়া নয়, হার্ট ততক্ষনে জেট ইনজিন হয়ে উড়ছে আকাশে। কি শুভক্ষনেই না এসেছি এখানে। ঘরে এত সুন্দর মেয়ে, আর উনি খুঁজছেন কি ব্যাচেলর- আমরা দুজনে সবেগে উপরে নীচে মাথা দোলাতে লাগলাম। এক মূহুর্তের জন্যে মনে হলো, ছিড়ে না যায় আবার!
বাড়িওয়ালা বললেন, স্যরি, আমি ব্যাচেলরদের ভাড়া দেই না। '
জেট ইনজিন ক্র্যাশ করলো, দুজনেই আবার মাটিতে ফিরে এলাম।
আর কি! আবার খোঁজা শুরু হলো। এরকম কয়েকটা জায়গায় ব্যাচেলর হবার দায়ে ভাড়া না পেয়ে ঠিক করলাম আজই বাবা-মা কে পত্র লিখব, 'তোমাদের ছেলের জন্যে একজন পুত্রবধূ এই মূহুর্তে অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত শীঘ্রই পারো .....'
অবশেষে পেলাম! না, বাবা-মা র জন্যে পুত্রবধূ না, আমাদের দুই বন্ধুর জন্যে একটা মেস। রাজাবাজারে সেটা ভূপেন আংকেলের মেস। ছয়তলা বাড়ির পাঁচতলা মেস ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। বসে বসে ইনকামের এমন সুন্দর প্রসেস আর নাই। মনে মনে নিজের এইম ইন লাইফ ঠিক করে ফেললাম। ঢাকা শহরে একটা মেস বাড়ির মালিক হতেই হবে যে করেই হোক।
মেস পেতেই আরেক বন্ধু এসে হাজির হলো, তৌহিদ। তিনবন্ধু মিলে একগাদা জিনিসপত্র কিনে রুম ঠিক করলাম। সাজিয়ে- গুছিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখি, এক বউ ছাড়া যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসই সেখানে উপস্থিত।
রুম ছিল বটে একখান। ঘুঁপচি অন্ধকার। এটা কি রোদভরা দিন নাকি অমাবস্যার রাত রুমে বসে সেটা বোঝার কোন উপায়ই নেই।
মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে ঘড়িতে ছয়টা বাজে দেখে দ্্বিধায় পড়ে যেতাম। কোন ছয়? - ভোর না সন্ধ্যা?
বারান্দা আছে অবশ্য একটা, তবে সেখানে দাঁড়ালে আকাশ নয়, পাশের বাড়ির দেয়াল দেখা যেত। আর সেটা এতই কাছে, রোদ দূরে থাক, বৃষ্টি হলেও টের পেতাম না।
তেলাপোকার ছড়াছড়ি, মেসের অখাদ্য কুখাদ্য, এসব নিয়ে তবু ভালই ছিলাম। কোচিং শেষ করে অন্ধকার হাতড়ে হাতরে রুমে এসে শুয়ে পড়তাম।
মেঝের ওপর বিছানো তোষক, তার উপর চিটচিটে চাদর, সেখানেই শুয়ে হাতটাকে বালিশ বানিয়ে, সদ্য কেনা সিলিং ফ্যানটার ঘুরতে থাকা পাখাগুলোর দিকে তাকিয়ে, তিনজনেই, কি জানি কার কথা ভেবে হেঁড়ে গলায় একসঙ্গে গেয়ে উঠতাম, ' চন্দন পালংকে শুয়ে , একা একা কি হবে, জীবনে তোমায় যদি পেলাম না। '
------------------------
দৈনিক যুগান্তরের ফান ম্যাগাজিন বিচ্ছুতে প্রকাশিত।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০০৬ দুপুর ১২:১৬