somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তিযুদ্ধে চুয়াডাঙ্গাঃ অষ্টম পর্ব : অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সী

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১২ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১ মুক্তিযোদ্ধারা চুয়াডাঙ্গা শহরে এক সফল গেরিলা হামলা চালান। মধ্যরাতের এই হামলায় পেট্রোল পাম্প, লাইট পোস্ট গুড়িয়ে দেয়া ও দালাল রাজাকারদের আস্তানায় হামলা চালান হয়। ফলে, পাকিস্তানপন্থীদের মধ্যে চরম আতংক সৃষ্টি হয়। এই হামলা পরিচালনা করেন হাফিজুর রহমান জোয়ার্দ্দার ও আজম আক্তার জোয়ার্দ্দার পিন্টু এবং কয়রাডাঙ্গার মতিউর রহমান মন্টু। ২৩শে সেপ্টেম্বব আলমডাঙ্গা থানার গোবিন্দপুর গ্রামের মফিজ উদ্দিন বিশ্বাস পাকিস্তানপন্থী ও তথাকথিত শান্তি কমিটির লোক। মুসলিম লীগের লোক হিসেবে ৬ দফা এবং ১১ দফা আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, ছাত্র লীগ, ছাত্র ইউনিয়নের মিটিং , মিছিল, সভাতে হামলা চালিয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করে।

গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করে পাকবাহিনীকে সরবরাহ করতো এবং ছাত্র-যুবকদের জোর পূর্বক রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করতো। এই সমস্ত কারনে মুক্তিযোদ্ধারা বিক্ষুব্ধ হয়ে মফিজ উদ্দিনের বাড়িতে হামলা করে তাকে খুন করে। কিন্তু হামলার সময় রাজাকাররা ও মফিজ উদ্দিনের পরিবারের সদস্যরা বাধা সৃষ্টি করায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিক্ষিপ্ত গুলিতে মফিজ উদ্দিন ছাড়াও তার পরিবারের আরও সাত জন সদস্য নিহত হয়। সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর কোন একদিন বাড়াদী গ্রামের কাদা-পানীর রাস্তা দিয়ে চলতে যেয়ে মুক্তিযোদ্ধা তালাত মোহাম্মদের পা ধারালো অস্ত্রে মারাত্মকভাবে কেটে যায়। এমতাবস্থায় তাকে গাংনী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পাকসেনারা গোপনে সংবাদ পেয়ে হাসপাতাল থেকে তালাত মোহাম্মদকে আটক করে এবং অকথ্য নির্যাতনের পর হত্যা করে।

এই মাসেই দামুড়হুদা থানায় ধানঘরা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকসেনাদের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে শামসুল হক মালিতা ও চাঁদ আলী নামে দুই জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং বেশ কিছু পাকসেনা নিহত হয়। এই মাসে মেহেরপুরের ইছাখালী সীমান্তে পাকসেনাদের শেলের আঘাতে চুয়াডাঙ্গার দৌলতদিয়াড় গ্রামের ফকির মোহাম্মদ আহত হন। ১০ ই অক্টোবর কয়রাডাঙ্গা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিয়ার রহমান মন্টুর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা রাতে দামুড়হুদা থানা আক্রমন করেন। মাথাভাঙ্গা নদী সংলগ্ন দামুড়হুদা থানা নদী পার হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করে পুনরায় ফিরে যাওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপুর্ণ কাজ। কমান্ডার মতিয়ার রহমান মন্টু একাই ষ্টেনগান, রাইফেল ও পিস্তল নিয়ে নদী পার হয়ে থানা এলাকায় আসেন এবং তিনটি অস্ত্র দিয়ে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। তিনি থানার পুলিশদের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বলেন-‘মুক্তিযোদ্ধারা তোমাদের চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। তোমরা সারেন্ডার করো তোমাদের কোন ক্ষতি করা হবে না।‘ পুলিশ ও রাজাকাররা এই কথায় বিশ্বাস করে অস্ত্রসহ থানা ভবনের সামনে ফাঁকা স্থানে জড়ো হয় এবং অস্ত্র সমর্পণ করে। কমান্ডার মন্টু বাইরে অস্ত্র রেখে একটি ঘরে ঢুকতে সকলকে নির্দেশ দেন।


এদিকে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা নদী পার হয়ে অনুকূল পরিবেশে থানায় আসেন এবং থানার সমস্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে যান। ১৩ই অক্টোবর পাকসেনাদের চলাচল বিঘ্নিত করার জন্য জীবননগর থানার সাবদালপুর রেলস্টেশনের সন্নিকটে বিস্ফোরক দিয়ে ব্রীজ উড়ানো হয়। এই অপারেশনের সময় উক্ত গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব আলী চোখে আঘাত পেয়ে আহত হন। পাকসেনারা রেলওয়ের মাধ্যমে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঈশ্বরদী প্রভৃতি স্থানে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহন করতো। তাদের এই যোগাযোগ বন্ধ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেন লাইন বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা মুন্সিগঞ্জ ও নীলমনিগঞ্জের মধ্যবর্তী স্থানে পাক সৈন্যের অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহনকারী ট্রেন এন্টিট্যাংক মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেন। ১৭ই অক্টোবর এই উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা যথাস্থানে অবস্থান নেন। তাঁরা পাঁচটি এন্টিট্যাংক মাইন রেল লাইনের নিচে প্রেসার চার্জার স্থাপন করেন। ট্রেন লাইনের উপর দিয়ে যাবার সময় প্রচন্ড শব্দের বিস্ফোরিত হয়। ফলে বহু পাকসেনা নিহত হয় ও ট্রেনের বগী, গোলাবারুদ নষ্ট হয়।


এছাড়াও অক্টোবর মাসের বিভিন্ন সময়ে চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে আরও খন্ড যুদ্ধ ও গেরিলা হামলা পরিচালিত হয়। এই মাসে মুক্তিযোদ্ধারা আলমডাঙ্গা-হালসা রেলস্টেশনের মাঝামাঝি জগন্নাথপুর গ্রামের সন্নিকটে রেলওয়ে ব্রীজে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমন করেন। রাজাকারদের হটিয়ে মুক্তযোদ্ধারা ব্রীজের কাঠে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগান। ফলে, ব্রীজটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এ মাসেই জগন্নাথপুর ব্রীজের কাছে অপর একটি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমন করে মুক্তিযোদ্ধারা সফলকাম হন। গোকুলখালী বাজারের কাছে ব্রীজে স্থাপিত আর একটি রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের পরাজিত করেন এবং ক্যাম্প দখল করে নেন। এই মাসের কোন এক সময়ে দামুড়হুদা থানার কার্পাসডাঙ্গা গ্রামে পাকসৈন্যদের স্থাপিত ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমন করেন এবং পাকসৈন্যদের হটিয়ে বহু অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন। সেপ্টেম্বর মাসের অজ্ঞাত দিনে মুক্তিযোদ্ধারা আলমডাঙ্গা-হালসা স্টেশনের মাঝামাঝি স্থানে পূনরায় হামলা চালিয়ে রেল লাইন উড়িয়ে দেন। আলমডাঙ্গা থানার যাদবপুর ও হারদী গ্রামের কাছে প্রধান রাস্তা রাজাকাররা পাহারা দিত। মুক্তিযোদ্ধারা রাতে এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতো বলে পাকসেনারা এই ব্যবস্থা গ্রহণ করে। প্রায় রাতে রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় কাছাকাছি হয়ে পড়তো। কিন্তু কেউ কারো বাধা সৃষ্টি করতো না।

এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর চাপে রাজাকাররা যাদবপুর প্রাইমারী স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। এমতাবস্থায়; মুক্তিযোদ্ধারা বিরক্ত হয়ে একজন রাজাকার কমান্ডারকে হত্যা করে। অক্টোবর মাসেই ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা ভারত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে জোড়পুকুর হয়ে আলমডাঙ্গা আসার পথে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং শহীদ হন। এরা হচ্ছেন বেলগাছী গ্রামের নজরুল ইসলাম, পুরাতন পাচলিয়ার আব্দুল গনি ও আবু তালেব, খাসকয়রার আক্কাচ আলী ও আকবর আলী, বৈদ্যনাথপুরের বাকের উদ্দিন। এই ছয়জন ই আলমডাঙ্গা থানার মুক্তিযোদ্ধা।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

কমান্ডার মতিউর রহমান মন্টু সম্পর্কে আলাদা একটি পর্ব লিখবো। তার মতো মহৎহৃদয়, সাহসী ও বুদ্ধিমান মুক্তিযোদ্ধা খুব কমই আছেন। এবং তারমতো ও তার ছোটভাই লাল্টুর মতো বড় সন্ত্রাসী, ডাকাত ও চরমপন্থী খুব কমই জন্ম নিয়েছে এই দেশে। সেই অজানা কাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে ও মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। দুই বছর ধরে তাঁদের সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্র থেকে নিউজ ও তথ্য জোগাড় করছি এই মিঃ জেকিল ও মিঃ হাইড এর কথা আপনাদের জানানোর জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১২:৩৬
৩১টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×