কিছু মানুষের সাথে আপনার কখনো দেখা হবেনা, কথা হবেনা, কখনো পরিচয়ও হবেনা। কিন্তু যোজন যোজন দূর থেকে এই মানুষ গুলাকে মনে হবে কত যুগের আপনজন, আত্মার কত কাছাকাছি মানুষ!! ইংরেজি ভাষায় এদের বলা হয় : "The man next door '. যে সাদামাটা সহজ সাধারণ বিস্ময় জাগানিয়া মানুষটির কথা বলছি,, তিনি এক কিংবদন্তীর নাম : হুমায়ূন ফরিদী।
মঞ, টিভি, ছোট -বড়, সাদাকালো -রঙিন পর্দার প্রবাদপুরুষ প্রতিম দাপুটে অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদী ঢাকার নারিন্দায় 1952 সালে জন্ম গ্রহণ করেন, চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা ছিলেন জুরীবোর্ডের কর্মকর্তা। বাবার বদলির চাকরীর সূত্রধরে সারা বাংলা ঘুরে বেড়িয়েছেন। 1964 সালে মাত্র #বারো বছর বয়সে কিশোরগঞ্জের মহল্লার নাটক 'এক কন্যার জনক ' প্রথম অভিনয়ে করেন। রক্তে ছিলো অভিনয়, সূর্যের মতো আলো তো তিনি একদিন ছড়াবেনই। সত্তর 70' সালে HSC পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে " অর্গানিক কেমিস্ট্রি ' তে। পড়তে পারেননি, সময়টা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, উত্তাল পুরো বাংলা। চলে গেলেন যুদ্ধে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু ঘরে ফেরেননি হুমায়ূন, এরপর থেকে শুরু হলো পাঁচ বছরের যাযাবর জীবন, বোহেমিয়ান এর মতো এখান থেকে সেখানে ঘুরেছেন। ঘরে ফিরেছেন, তবে ফিরেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ, ভর্তি হয়েছিলেন, #জাহাঙ্গীরনগর_বিশ্ববিদ্যালয়এ #অর্থনীতি বিভাগে। প্রচন্ড মেধাবী হুমায়ূন, অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন। থাকতেন তৎকালীন আল -বেরুনী হলের এক্সটেনশন এ, যা আজ 'ফজিলাতুন্নেসা হল, কয়েকবছর আগে এই হলের অনেক বয়োবৃদ্ধ এক দারোয়ানের একটা ইনটারভিউ দেখেছিলাম, তিনি বলছিলেন,, তরুণ হুমায়ূন মধ্যরাতে হলের লম্বা করিডোর ধরে দরাজ কন্ঠে গলা উচু করে কবিতা আবৃত্তি করতেন। সুনীলের একটা কবিতার কয়েকটি লাইন আমি মানুষটার মুখে কয়েকবার শুনেছি,, লাইনগুলো এমন ......
নবীন কিশোর,
তোমাকে দিলাম ভুবনডাঙ্গার মেঘলা আকাশ,
তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেড়া শার্ট
আর ফুসফুস ভরা হাসি!!!
জন্ম প্রতিভাধর এই মানুষটি কী অসাধারণ আবৃত্তিই না করতেন।
1976 সালে নাট্যজন "সেলিম আল দীন "এর উদ্যোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় নাট্যোৎসব। ফরিদী ছিলেন এর অন্যতম প্রধান সংগঠক। এই উৎসবে ফরিদীর নিজের রচনায় এবং নির্দেশনায় মঞস্থ হয় ' আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত ' নামে একটি নাটক,, নাটকটি সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়, বিচারক ছিলেন আরেক কিংবদন্তী " নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু।" জুহুরী চিনতে ভুল করেননি তিনি। ছাত্র হুমায়ূন কে তিনি অভিনয়ের তীর্থস্থান ' ঢাকা থিয়েটার ' এ যোগ দেওয়ান। ঢাকা থিয়েটার এ প্রথমে চা আর কস্টিওম আনা নেওয়ার কাজ করলেও 'সংবাদ কার্টুন ' নামে একটা নাটকের ছোট্ট একটা চরিত্রে অভিনয় শুরু করলেও #শকুন্তলা, ফণীমনসা, কীত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, মুনতাসীর ফ্যান্টাসি, ভূতের মতো তুমুল জনপ্রিয় মঞ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে হয়ে উঠেন ঢাকা থিয়েটারের প্রাণ ভোমরা। বনে যান সেসময়ের মঞ নাটকের অদ্বিতীয় ব্যক্তি। নাট্যপাড়ায় হুমায়ূন তখন শক্তিমানদের একজন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন সময়ে সেলিম আল দীনের অত্যন্ত কাছের একজন এ পরিনত হন। মানিকে মানিক চিনে বলে কথা।।
সত্তর দশকের শেষের দিকে রমনার বটমূলে বেলী ফুলের মালা বরন করে প্রথম স্ত্রী 'মিনু'কে বিয়ে করে সারা ঢাকা শহরে আলোড়ন তুলে দেন। অবশ্য সেই বেলী ফুলের মালা খুব বেশি দিন টিকেনি, আশির দশকের শেষের দিকে বিয়ে করেন সুবর্না মুস্তফাকে। প্রথম ঘরে একমাত্র সন্তান 'সারারাত ইসলাম দেবযানী। ' নিঃসঙ্গ, অভিমানী, ক্ষণজন্মা এই অসাধারণ মানুষটির জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই মেয়েটিই শুধুমাত্র পাশে ছিলো!!
যে হুমায়ূন বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে আপন হয়ে উঠবেন, তাকে কি শুধু মঞের চার দেয়ালে আবদ্ধ রাখা সম্ভব?? আতিকুল ইসলাম চৌধুরীর 'নিখোঁজ সংবাদ ' দিয়ে টিভি পর্দায় আগমন। তবে 1983 সালে সেলিম আল দীনের রচনা এবং নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর পরিচালনায় সেই সময়কার তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয় প্যাকেজ নাটক " ভাঙনের শব্দ শুনি " তে টুপি দাড়িওয়ালা গ্রামের মিচকা শয়তান " সেরাজ তালুকদারের যে চারিত্রিক রুপ তিনি দিয়েছিলেন আর সেই নাটকে তাঁর সেই অমোঘ ডায়লগ " আরে আমি তো পানি কিনি, পানি, দুধ দিয়া খাইবা না খালি খাইবা বাজান", মানুষের মুখে মুখে রটে বেরাতো। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি, জাত অভিনেতা ছিলেন, রক্তে মিশে ছিলো অভিনয়, নাট্য জগতের সবাই বুঝে ফেলেছিল,, ধূমকেতুর জন্ম হয়েছে,, একদিন শাসন করবে এই যুবক,, সেদিনের হিসেব এক চিলতেও ভুল হয়নি,, এরপর টানা তিন দশক তাঁর ক্যারিশম্যাটিক, তাঁর ম্যাজিকাল অভিনয়ে বুঁদ করে রেখেছিলেন পুরো বাঙালি অভিনয় প্রিয় জাতিকে। অভিনয় দিয়ে কি না করেছেন এই ভদ্রলোক,, তাঁর অভিনয়ে মানুষ হেসেছে, কেঁদেছে, বিস্মিত হয়েছে, হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখেছে একজন হুমায়ূনের অভিনয় ক্ষমতা কতটা প্রবল, কতটা বিস্ময়কর!! এরপর একে একে করেছেন,, হঠাৎ একদিন, দূরবীন দিয়ে দেখুন, কোথায় কেউ নেই, বকুলপুর কত দূর, ভবের হাট, এরকম আরো অসংখ্য অগনিত তুমুল দর্শকপ্রিয় টিভি নাটক। বাঙালির মধ্যবিত্ত সামাজিক জীবনধারা কে তিনি আনন্দিত করে তুলেছিলেন, ফরিদীর নাটক মানেই বিটিভির সাদাকালো পর্দায় পুরো বাঙালির চোখ আটকে যাওয়া। হতাশ করতেন না তিনি,, এতো প্রানবন্ত, এতো জীবন্ত, যেন আমাদের চারপাশের মানুষগুলোই জীবন্ত হয়ে যেতো ফরিদীর অভিনয়ে!! আর "সংশপ্তক ' নাটকে হুমায়ূনের 'কান কাটা রমজান ' চরিত্রের অভিনয় যারা দেখেছেন তারা ফরিদীকে স্থান দিয়েছেন হৃদয়ের একেবারে মাঝখানে। আব্বা -মার কাছে এই নাটকে ওনার অভিনয়ের কথা শোনতাম, পরে বিটিভির আর্কাইভ হতে প্রচারিত এই নাটকটি আমি পুরো দেখেছি,, ফরিদী কেন কিংবদন্তী, বুঝতে সমস্যা হয়নি। মিয়া বাড়ির বড় মিয়া 'খলিলের চ্যালা গ্রামের গলায় গামছা পেচানো হুলমতির ওপর ললুপ দৃষ্টি দেয়া বখাটে ফরিদী কী অনন্য, অসাধারণ অদ্ভুত সুন্দর অভিনয় যে করেছিলেন এই নাটকে!! তা ব্যাখ্যার অতীত!! সেই সময়ের এক অখ্যাত ব্যান্ডদল 'ড্রিমল্যান্ড ' হুমায়ূন ফরিদীর কান কাটা রমজান চরিত্র নিয়ে গান তৈরি করেছিলেন। আর সেই গান দিয়েই ঝড় তুলে ফেলছিলো চারপাশে!!ভাবা যায় একটা টিভি চরিত্র একটা জনপ্রিয় গান হয়ে ওঠে কিভাবে?? কতটা ইম্প্রোভাইজিং ছিলো তিনি!!
নিজের সম্পর্কে তিনি একটি কথা সবসময় বলতেন। অভিনয় ছাড়া আর কিছু পারি না আমি। এটা করেই বাঁচতে হবে আমায়। তাই নব্বই দশকে এসে নাম লিখিয়েছিলেন 'ব্যাণিজ্যীক ধারার বাংলা ছবিতে। 'হুলিয়া ' দিয়ে প্রথম সিনেমাতে অভিনয়,, তবে মজার ঘটনা ঘটে তখন, যখন বন্ধু শহীদুল ইসলাম খোকনের 'সন্ত্রাস ' ছবিতে নায়ক রুেবলের বিপরীতে ভিলেনের অভিনয়। ভিলেনের সেই যুগটা ছিলো রাজীব, এটিএম, ড্যানি সিডাক, শরীফ আহমেদের। তবে হঠাৎ করেই বাংলা চলচ্চিত্রের ধরন পরিবর্তন হতে শুরু করেন। অভিনয়ে ফরিদী এতোটাই অনবদ্য ছিলেন যে একসময় নায়কের চেয়ে বাংলা সিনেমা প্রেমী জাতির কাছে ভিলেন হুমায়ূন ফরিদী বেশি প্রিয় হয়ে ওঠেন। হলে ওনার সিনেমা মুক্তি মানেই ওপচে পরা ভীড়!! সেলুলয়েড়ের বিশাল পর্দায় ফরিদীর উপস্থিতি মানে দর্শকদের মুহুর্মুহু তালি। একটু একটু করে বাংলা সিনেমায় ভিলেনের সংজ্ঞাটাও যেন পরিবর্তন হতে থাকে। দহন, আনন্দ অশ্রু, বিচার হবে, মায়ের অধিকার, একাত্তরের যীশু, ভন্ড, পালাবি কোথায়, জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া, হিংসা, বিশ্ব প্রেমিক, অপহরণের মতো জনপ্রিয় এবং একই সাথে ব্যাণীজ্যীকভাবে সফল 250 টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন। নিজের চোখটা বন্ধ করে একটু মনে করার চেষ্টা করুন তো,, আমাদের শৈশব -কৈশোরে বিটিভির পর্দায় চোখ আটকে যেতো ওনার প্রতিটি সিনেমায় অদ্ভুত সব অঙ্গভঙ্গি আর মজার সব ডায়লগ গুলাতে। একেক সিনেমায় একেকভাবে উপস্থাপিত ফরিদী চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতেন আমাদের!! কেমন করে ভুলি আমার শৈশবের এই হিরোকে?? কেমন করে?
2003 সালে চলচ্চিত্রে অভিনয় ছেড়ে দেন, 2008 সালে বিচ্ছেদ ঘটে দ্বিতীয় স্ত্রী সুবর্নার সাথেও। জীবনের বাকিটা সময় খুব নিঃসঙ্গে কাটে অভিমানী এই মানুষটির। নাট্য জগতে একটা কথা আছে, যদি টাকা লাগে ফরিদীর কাছে চাও, কারণ ওনাকে টাকা ফেরত দিতে হয়না। ব্যক্তি ফরিদীর হৃদয়ের বিশালতা নিয়ে অসংখ্য গল্প আছে,, হুমায়ূন আহমেদের একটা বইয়ের উৎসর্গ পত্রে একটা লেখা পড়েছিলাম এরকম ............
" মহিলা সমিতির সামনে দেখলাম একটা যুবককে ঘিরে অনেকগুলো যুবকের জটলা, যুবকটি চা খাচ্ছে আর বাকি যুবকগুলোও তাকে ঘিরে চা খাচ্ছে, কাছে গিয়ে দেখলাম তিনি 'হুমায়ূন ফরিদী। '
হ্যাঁ নক্ষত্রের মতো হয়েও ফরিদী ছিলেন জমিনের এতো কাছাকাছি। এজন্যই তিনি মানুষের এতো বেশি প্রিয়!!
জীবনে কোনদিন শার্টের ইন না করা, ফুল হাতা শার্টের আস্তিন গুটানো চুম্বকের মতো আকর্ষণ করা ব্যক্তিত্বের অধিকারী ভার্সেটাইল এই অভিনেতার জীবনের সবচেয়ে বড় শখ ছিলো,, 60 তম জীবনে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের "কিং লিয়ার" নাটকে অভিনয় করা। জীবন তাঁর করুনার বাহু সবটুকু দিয়ে ফরিদীর দিকে প্রসারিত করেননি,, 2012 সালের 13ই ফেব্রুয়ারি 59 বছরে বসন্তের প্রথম সকালে এই মর্তর পৃথিবী ত্যাগ করেন তিনি।মাঝেমধ্যেই নাকি ফরিদী একটা ফিলোসফিক্যাল বাক্য বলতেন ...."বাঁচো এবং বাঁচতে দাও। "
হ্যাঁ বেঁচে ছিলেন তিনি, মহারাজার মতোই বেঁচে ছিলেন!! এখনো চোখ বুঁজলে যেন,, তাঁর অট্টহাসিতে কাচ ভাঙার শব্দ শুনি!! এখনো জাহাঙ্গীরনগরের মুক্তমঞ, বেইলিরোডের নাট্যপাড়া, এফডিসির রঙমহল খা খা করে একজন ফরিদীর ভীষণ অভাবে!! অভিনেতা যায়, অভিনেতা আসে,কিন্তু হুমায়ূন ফরিদীরা, কিংবদন্তীরা যুগে যুগে, শতাব্দীতে, শতাব্দীতে একজন -দুজন আসে!
বুকের পাজর দিয়ে আপনাকে ভীষণ মিস করি,, ভালো থাকবেন প্রিয় :-):-)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:৫৪