চলচ্চিত্র শিল্পের জন্ম ১৮৯৫ সালের ২৮ডিসেম্বর,লুই ও অগুস্ত লুমিয়ের ভাতৃদয়ের মাধ্যমে প্যারিসে।সে তুলনায় পারসিকরা (বর্তমান ইরান) একটু ধীর গতিতে এ শিল্পে প্রবেশ করে-১৯০০ সালে।প্রথমাবস্থায় আমদানিকৃত ছবি দেখার মাঝেই কেবল তাদের এই শিল্প সীমাবধ্য ছিল।তবে এ দেখাও শাসকদের মাঝে খানিকটা প্রভাব ফেলে।ফলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হতে থাকে প্রামাণ্য চিত্র,শুরু হয় চলচ্চিত্রের ক্ষীণ যাত্রা। কিন্তু, ১৮৯২ সালে শুরু হওয়া গণজাগরণ পুষ্টি পেতে পেতে১৯০৬ সালে এসে যখন বিপ্লবের মুখে পতিত হয়(যাকে আমরা সাংবিধানিক বিপ্লব হিসেবে চিনি )তখন শুরু হওয়া চলচ্চিত্রিক গতিতে খানিকটা শ্লথ সৃষ্টি হয়।এরপর ইতিহাসের উত্তপ্ততা,প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ(১৯১৪)এবং এর সমাপ্তি(১৯১৮)। বিশ্ব যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলেও ইরানের অস্থিতিশীলতা হ্রাস পায়নি।ব্রিটিশদের মদদে শাসনভার নেয়’রেজা শাহ্ পাহলবি‘।যা ইরানি সাধারন জনগন সহজভাবে নেয়নি। আবার চাঙ্গা হয় দ্রোহ।এর মাঝেই ১৯৩০ সালে সৃষ্টি হয় ইরানি প্রথম চলচ্চিত্র ’আবি ও রাবি’ ।তবে এটি ছিল নির্বাক। ১৯৩৩ সালে মুক্তি পায় প্রথম সবাক চলচ্চিত্র।যার নাম-‘দখতর ই লর’।এরপর শাসকবর্গ কতৃক চলচ্চিত্র শিল্পের উপর জারি হয় বহু বিধি ফরমান-‘বিপ্লবী অভিব্যক্তি,আন্দোলন,ধর্মঘট ইত্যাদি স্থান পাবেনা চলচ্চিত্রের পর্দায়’। তাই ৪০ এর দশকে এ শিল্পে ভাটা পড়ে।তবে ৬০ এর দশকে তা খানিকটা যৌবন ফিরে পায়।এর উল্লেখযোগ্য প্রমাণ- দারিউস মেহের যূঁই’র ‘গাভ’,মাসুদ কিমিয়াই’র ‘কায়সার’, আমির নাদেরি’র ‘সাঁজ ঈ দাহনে’, বাহরাম বাঈজায়ি’র ‘গারিবেহ ডা মেহ’ ইত্যাদি।১৯৭৮ সালের দিকে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হতে থাকে।রেজা শাহ পাহলবির শাসকবর্গ প্রায় ৫০ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।১৯৭৮ সালে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়ে বিপ্লব সূচিত হয়।যা ইসলামি বিপ্লব নামে পরিচিত।তবে এ বিপ্লব কে বিপ্লব হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অনিচ্ছুক ছিল পশ্চিমা গোষ্ঠী।ফরাসী সাংবাদিক ‘মিশেল ফুকো’ এ বিপ্লব সম্পর্কে বলেন-এটা কি কোন বিপ্লব হল?এতে না আছে ভিতরের সংগ্রাম না আছে বাইরের নেতৃত্ব শক্তি? বার্নাড লুইস ‘ইসলামিক কনসেপ্ট অব রেভ্যূলেশান’ প্রবন্ধে এ বিপ্লব কে ‘উটের উত্থান’র সাথে তুলনা করেছেন।অথচ সেই ইরান বিপ্লব শেষে একের পর এক ইতিহাসের জন্ম দিতে থাকে। সব কিছু ছাপিয়ে শুধু চলচ্চিত্র শিল্পের দিকেই আসা যাক।বিপ্লবের প্রাথমিক দিকে কট্টর পন্থীরা চলচ্চিত্র বিমূখ ছিল।তারা ভাবতো এ শিল্প তাদের আকীদা (আদর্শ) বিরোধী। ফলে পুড়িয়ে ফেলা হয় ১৮০ টিরও বেশি সিনেমা প্রিন্ট।আগুন লাগানো হয় ৪০০ টিরো বেশি সিনেমা হলে।সরকারেরও ছিল এ সম্প্রদায়ের প্রতি মৌন সমর্থন।তবে ৮০র দশকের মাঝামাঝিতে সরকারের ভাবনায় পরিবর্তন হয়। চলচ্চিত্র কে এগিয়ে নিতে সরকারি পদক্ষেপ গৃহীত হয়।শুরু হয় ইরানি চলচ্চিত্রের নব যাত্রা।যার প্রমাণ মেলে আমির নাদেরের দাভান্দেহ,এবং বাহারাম বাইজারির(বসু,ঘারিবেহ-ইয়েয় কুচাক) চলচ্চিত্রদয়ে। এ দুটি চলচ্চিত্রে তৎকালীন ইরানের দারিদ্রতা ও ইরাক-ইরান যুদ্ধের(১৯৮০-৮৯)ভয়াবহতার আলামত বহন করে।যা পশ্চিমাদের টনক নাড়িয়ে দেয়।এগুলো ছাড়াও সমাজে প্রভাব ফেলার মত আরো অনেক চলচ্চিত্র তৈরি হয়।যেমন,মোহসেন মাখমালবাদ’ র ‘দাস্তফ রুম-১৯৮৬’ ‘আরুসি ইয়ে খুবান-১৯৮৮’ ‘গাব্বেহ-১৯৫৫’ এবং ‘কাহান্দার-২০০১’।‘কাহান্দার’ ছবিটি ‘আফগান যুদ্ধ’ পরিস্থিতির উপর নির্মিত।এ ছবিটিও পশ্চিমাদের টনক নাড়ায়।স্বয়ং তৎকালিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এ ছবি দেখে আফগান যুদ্ধের দূরাবস্থার কথা স্বীকার করে।এরপর আসা যাক আব্বাস কিয়ারোস্তামির চলচ্চিত্রে।তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ‘মাস্ক ই সাক-১৯৮৮’ ‘নামায়ে নাজদিক-১৯৮৯’ ‘জানে-জি দোস্ত কজাস্ত-১৯৮৭’ ‘যিন্দেগি ভা দিগার হিচ-১৯৯২’ইত্যাদি।এরা ছাড়াও ইরানের অগণিত চলচ্চিত্রকার রয়েছেন যাঁদের কল্যাণে ইরানিক চলচ্চিত্র পেয়েছে বিশ্ব মর্যাদা।এদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন-আবুল ফজল জালিলি,জাফর পানাহি,মাজিদ মাজিদি,পারভেজ শাহবাজি,রাসুল সাদর আমেলি,হাসানিয়েক তা পানাহ,বাহমান ফারমান এবং বাহমান ঘবাদি প্রমুখ।ইরানি চলচ্চিত্রে নারীদেরও বেশ অবদান রয়েছে।এদের মাঝে উল্লেখ করার মত,মোহসেন মাখমালবাদের কন্যা সামিরা মাখমালবাদ,রাখসান বানি এম্মাদ,পুরান দেরাখসান্দেহ এবং তাহমিনা মিলানি প্রমুখ।পশ্চিমারা ইরানিক বিপ্লব কে বিপ্লব মনে না করলেও ইরানের বিপ্লব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বহু দূর।যার প্রভাব পরছে বিশ্ব রাজনীতিতে। রাশিয়ার সহযগিতায় গড়ে উঠা ইরানের পরমানু স্থাপনা বদ হজম করাচ্ছে পশ্চিমা গোষ্ঠীর। আর সাংস্কৃতিক অবস্থা?যেই পশ্চিমারা একদিন ইরানিক বিপ্লবকে বিপ্লব ই মনে করত না,আজ তারাই ইরানের চলচ্চিত্র দেখে তাড়ি খাওয়ার অবস্থা। ইতিহাস, ঐতিহ্য,সামাজিক প্রেক্ষাপট,মানবিক মূল্যবোধ এবং তাদের প্রতি পশ্চিমাদের লজ্জাকর নাক চুল্কানি সবই ফুটে উঠছে ইরানি চলচ্চিত্রের পর্দায়। এবারের অস্কারের আসর ছিল ৮৪তম আসর।নির্বাক চলচ্চিত্রের জয়জয়কারের এ আসরে সেরা বিদেশী ভাষায় চলচ্চিত্র হিসেবে স্থান দখল করে নেয় ইরানি চলচ্চিত্র ‘আসগার ফারাদি’ পরিচালিত ’ এ সেপারেশান’। এ ছবিতে ফুটে উঠে ইরানের আভ্যন্তরীণ সমাজ ও পারিবারিক দ্বান্দিক কলহ।শেষে একটি প্রশ্ন বোধক শর্টের মাধ্যমে চিত্রিত হয় ‘টিন-এজ’দের উপর এর প্রভাব।মোটামুটি স্বল্প বাজেটের করা এ ছবির অস্কার প্রাপ্তিই বলে দেয়- এ হচ্ছে ৮০র দশকে করা সেই বিপ্লবের ই ধারাবাহিকতা।
১৪-০৩-১২ইং
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১২ সকাল ১১:৫২