somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নরবলির ইতিহাস

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নরবলি হলো দেবতাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে বা ঐশ্বরিক অনুগ্রহ প্রাপ্তির আশায় কিংবা ক্রুদ্ধ দেবতাকে শান্ত করার লক্ষ্যে মানুষ হত্যা। এটি একটি প্রাচীন ধর্মীয় সংস্কার যা বিভিন্ন সভ্যতায় অঙ্গীভূত ছিল কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় অবসিত হয়েছে। পৃথিবীর প্রধান ধর্মসমূহে নরহত্যা তথা নরবলির বিধান নেই, বরং নরহত্যা নিষিদ্ধ। নরহত্যার সঙ্গে নরবলি'র পার্থক্য হলো নরবলি সামাজিকভাবে অনুমোদিত মানুষ হত্যা যার উদ্দেশ্য দেবতাদের সন্তুষ্টি অর্জ্জন। পাঁচ হাজার বছর আগে আদি ইয়োরোপের কৃষিভিত্তিক সমাজে নরবলির ব্যাপক প্রচলন ছিল।অপরাধের কারণে বিচারাদেশ অনুযায়ী হত্যা বা দেবতার সন্তুষ্টি অর্জ্জনের জন্য আত্মহত্যা নরবলি হিসাবে গণ্য নয়।
নরবলি চল ছিল এমন কয়েকটি সভ্যতা হলোঃ
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০-১১০০ সাল ব্যা্পী ক্যানানাইটিস, খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০-১০০ সাল ব্যাপী এত্রুস্ক্যানস্‌, খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০-১ সাল ব্যাপী কেল্টস্‌ এবং ৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ অবধি বিস্তৃত আযটেক সভ্যতা। কখনো কখনো গণ নরবলিও সংঘটিত হতো, যেমন ফেরাউনদের রাজত্ব কালে। নরবলিতে নির্গত রক্তকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো; নরবলির রক্ত দিয়ে উপাসনা স্থান পরিষ্কার করণের রীতিও প্রচলিত ছিল।মায়া সভ্যতায় শিরশ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে উৎসর্গীকৃত ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড বের করে ফেলার রীতি ছিল।
নরবলি এক সময় নানা দেশে বিভিন্ন জনসমাজের মধ্যে বহুলভাবে প্রচলিত ছিল। মানুষ নরবলি প্রদান করে বলি প্রদত্ত মানুষের রক্ত ছড়িয়ে দিত ফসলের ক্ষেতে। ভাবত ফসলের দেবী তুষ্ট হবেন। ক্ষেতে ভরে উঠবে ফসল। মানুষ নরবলি প্রদান করেছে ব্যক্তিগত জীবনের সাধারণ লাভ-ক্ষতির কথা বিবেচনা করে। হিন্দুদের মধ্যে একটি বিশেষ সাধনা পদ্ধতিকে বলা হয় তন্ত্র। তন্ত্র মতে আমাদের দেহের মধ্যে স্নায়ুমণ্ডলী আছে জালিকার মতো বিন্যস্ত হয়ে। এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় সূর্য ও চন্দ্রের স্রোত। বিশেষ প্রকার সাধনার মাধ্যমে এই দুই স্রোত ধারাকে একত্র করতে পারলে লাভ করা যায় মহা চৈতন্য। যার সাহায্যে মানুষ পারে বহু অসাধ্য সাধন করতে। মানুষ লাভ করে অতি প্রাকৃত শক্তি। তান্ত্রিকদের মধ্যে একদল ছিল, যাদের বলা হতো কাপালিক। কাপালিকরা নরবলি দিত। বলি প্রদত্ত মানুষের বুকের ওপর বসে করত ধ্যান।তারা ভাবতেন এভাবে লাভ করতে পারবে মহাশক্তি। এমনকি অমরতা। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তার সম্পাদিত বাংলা দেশের ইতিহাস গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে লিখেছেন তান্ত্রিকরা অনেক বীভত্স আচরণ করেন যেমন মানুষের মৃতদেহের ওপর বসিয়া মরার মাথার খুলিতে উলঙ্গ স্ত্রী পুরুষের সুরা পান (খ্রি : ২৬৭, ১৩৮০ সংস্করণ)। উপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র উনবিংশ শতাব্দীতে লিখেছেন তার বিখ্যাত উপন্যাস কপাল কুণ্ডলা। কপাল কুণ্ডলাতে আছে কাপালিকের বর্ণনা। এর থেকেও লাভ করা চলে কাপালিকদের সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা। এক সময় বাংলাদেশে অনেক কাপালিক ছিল। ছিল আরও বিভিন্ন প্রকারের তান্ত্রিক সাধক। এসব বলতে গেলে যেমন সতীদাহ প্রথা এর কথা বলতে হয়। সতীদাহ বা সহমরণ বলতে বুঝায় স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রীকে তার স্বামীর চিতায় স্থাপন করে পুড়িয়ে মারা। এই প্রথাকে আমাদের কাছে এখন নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত বলে মনে হলেও হিন্দু সমাজে এক সময় তা মনে হয়নি।

সতীদাহ প্রথাকে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ১৮২৯ সালে আইন প্রণয়ন করেন লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং। অনেক ভয়ংকর কুপ্রথাই প্রচলিত ছিল হিন্দু সমাজে। যেমন একদল ডাকাত ডাকাতি করত কালীপূজা করে। কালীপূজায় তারা দিত নরবলি। তারা বলত, তারা ডাকাতি করছে, লোক খুন করছে মা কালীর ইচ্ছায়, এটা তাদের ধর্ম। এই ডাকাতের দলকে বলা হতো ঠগি। কারণ এরা মানুষের সঙ্গে মিশত খুব বন্ধুভাবে। মানুষ বুঝতে পারত না এরা ডাকাত। কিন্তু একপর্যায়ে এরা মানুষকে গলায় রেশমী রুমালের ফাঁদ পড়িয়ে মেরে ফেলত। এরা এটা বিশেষভাবে করত প্রশস্ত রাজপথে, পথচারী বণিকদের ক্ষেত্রে। লর্ড বেন্টিং ঠগি দমন করেন। ঠগি দমন করতে গিয়ে তিনি অনেক ঠগিকে মেরে ফেলেন। একটানা সাত বছর চেষ্টা করে তিনি ঠগি দমন করতে সক্ষম হন। অনেক কুপ্রথা প্রচলিত ছিল হিন্দু সমাজে। এক সময় হিন্দু মন্দিরে মন্দিরে থাকত দেব দাসী। দেব দাসীদের জীবন আসলে ছিল গণিকাদের জীবন। এরা ছিল মন্দির-গণিকা। এই প্রথারও অবসানের চেষ্টা হয় ইংরেজ আমলে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে পুরোপুরি সাফল্য আসে না। কাপালিকদের সাধনায় তান্ত্রিক ভাবধারা প্রভাব ফেলছে। তান্ত্রিক ভাবধারা কিছুটা কাজ করেছে সতীদাহের মূলে। ঠগিরা ছিল কিছুটা তান্ত্রিক ভাবাপন্ন। মন্দিরে গণিকা প্রথার উত্স খুঁজে পাওয়া যায় তান্ত্রিক চেতনায়।

ধর্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এর মধ্যে ধীরে ধীরে ঘটেছে মানবিকতাবোধের বিকাশ। ইংরেজরা এদেশের সতীদাহ প্রথা রহিত করেছিল। ইংরেজদের দেশে সতীদাহ প্রথা ছিল না। কিন্তু সেই দেশে ডাইনি (ডরঃপয) বলে অনেক নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ডাইনি মেয়ে পুড়িয়ে মারার অনুমোদন আছে বাইবেলে। এক সময় সারা খ্রিস্টান দেশেই চলেছে ডাইনি বলে কথিত মেয়ে পুড়িয়ে মারা। ইংল্যান্ডে ডাইনি বলে মেয়ে পুড়িয়ে মারার বিধান তুলে দেয়া হয় ১৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে। এটা মাত্র ২৭৪ বছর আগের ঘটনা। ইসলাম পূর্ব আরবে কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবারে কন্যাসন্তান জন্মালে তাকে মাটিতে জীবন্ত পুঁতে মেরে ফেলা হতো। ভাবা হতো কন্যাসন্তান জন্মানো পরিবারের জন্য অকল্যাণকর বিষয়। সব আরবদের মধ্যে যে এই প্রথা প্রচলিত ছিল, তা নয়। কারণ তা হলে মায়ের অভাবে সমগ্র আরব জাতিই হতো বিলুপ্ত। ইসলাম ধর্মে কন্যাসন্তান মেরে ফেলা নিষিদ্ধ করা হয়। বলা হয় মেয়েরাও মানুষ। পুরুষ শিশুদের মতো নারী সন্তানদেরও আছে বেঁচে থাকার সমান অধিকার। ইতিহাসে দেখি, উন্নত ধর্ম বিশ্বাস মানুষকে প্রদান করেছে উন্নত পরিচ্ছন্ন জীবন। জীবনকে করে তুলেছে আগের তুলনায় অনেক বেশি মানবিক। কমিয়ে এনেছে নিষ্ঠুরতাকে। উন্নত ধর্ম চিন্তায় মানুষের জীবনকে দিতে বলা হয়েছে মূল্য। বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে, সব মানুষেরই আছে বাঁচার সমান অধিকার। অনেকের কাছে ধর্মের এই মানবিক প্রবণতাই হওয়া উচিত আমাদের বিবেচনা। মানুষ হিসেবে আমাদের কেবল নিজেদের কথা ভাবলেই হবে না। নিজের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনে অন্যজনের প্রতিও বাড়িয়ে দিতে হবে আমাদের সাহায্যের হাত। কারণ আমরাও প্রত্যেকে কোনো না কোনো সময় পড়তে পারি বিপদে। আমাদের প্রয়োজন হতে পারে অপরের সাহায্যের। মানুষের সহায়তায় বাঁচতে হবে মানুষকে।

এ পোস্ট কাউকে বা কোন ধর্মকে ছোট বা বড় করে দেখার জন্য নয় শুধু বোঝা ও জানার জন্য ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:২৯
১৯টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×