লালন শাহ মৃত্যুবরণ করেন ১ কার্তিক ১২৯৭। কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকার ১৫ কার্তিক সংখ্যায় লালন শাহ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। তাতে নিবন্ধ-লেখকের নাম মুদ্রিত হয়নি। পত্রিকার সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী শ্রী দেবনাথ বিশ্বাস। রচনাটিতে লালন ও বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে সমকালীন ধারণা উপস্থাপিত হয়েছে।
লালন ফকিরের নাম এ অঞ্চলে কাহারও শুনিতে বাকি নাই। শুধু এ অঞ্চলে কেন, পূর্বে চট্টগ্রাম, উত্তরে রঙ্গপুর, দক্ষিণে যশোহর, পশ্চিমে অনেক দুর পর্যন্ত বঙ্গদেশের ভিন্ন দুই স্থানে বহুসংখ্যক লোক এই লালন ফকিরের শিষ্য শুনিতে পাই। ইঁহার শিষ্য ১০ হাজারের উপর। ইঁহাকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি, আলাপ করিয়া বড়ই প্রীত হইয়াছি। কুষ্টিয়ার অনতিদুরে কালীগঙ্গার ধারে সেওরিয়া গ্রামে ইঁহার একটি সুন্দর আখড়া আছে। আখড়ায় ১৫-১৬ জনের অধিক শিষ্য নাই। শিষ্যদিগের মধ্যে শীতল ও ভোলাই নামক দুইজনকে ইনি ঔরসজাত পুত্রের ন্যায় স্েমহ করিতেন; অন্যান্য শিষ্যকে তিনি কম ভালোবাসিতেন না। শিষ্যদিগের মধ্যে তাঁহার ভালোবাসার কোনো বিশেষ তারতম্য থাকা সহজে প্রতীয়মান হইত না। আখড়ায় ইনি সস্ত্রীক বাস করিতেন; সম্প্রদায়ের ধর্মমতানুসারে ইঁহার কোনো সন্তানসন্ততি হয় নাই। শিষ্যগণের মধ্যেও অনেকের স্ত্রী আছে, কিন্তু সন্তান হয় নাই। এই আশ্চর্য ব্যাপার শুধু এই মহাত্মার শিষ্যগণের মধ্যে নহে, বাউল সম্প্রদায়ের অধিকাংশ স্থানে এই ব্যাপার লক্ষিত হয়। সম্প্রতি সাধুসেবা বলিয়া এই মতের এক নতুন সম্প্রদায় সৃষ্ট হইয়াছে। সাধুসেবা হইতে লালনের শিষ্যগণের না হউক, নিজের মতবিশ্বাস অনেকাংশে ভিন্ন ছিল। সাধুসেবা ও বাউলের দলে যে কলঙ্ক দেখিতে পাই, লালনের সম্প্রদায়ের সে প্রকার কিছু নাই। আমরা বিশ্বস্ত সুত্রে জানিয়াছি, ‘সাধুসেবায়’ অনেক দুষ্ট লোক যোগ দিয়া কেবল স্ত্রীলোকদিগের সহিত কুৎসিত কার্যে লিপ্ত হয় এবং তাহাই তাহাদের উদ্দেশ্য বলিয়া বোধ হয়। মতে মূলে তাহার সহিত ঐক্য থাকিলেও এ সম্প্রদায়ের তাদৃশ ব্যভিচার নাই। পরদার ইহাদের পক্ষে মহাপাপ। তবে প্রত্যেক সৎ নিয়মের ন্যায় ইহারও অপব্যবহার থাকা অসম্ভব নহে।
বাউল, সাধুসেবা ও লালনের মতে এবং বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কোনো শ্রেণীতে যে একটি গুহ্য ব্যাপার চলিয়া আসিতেছে, লালনের দলে তাহাই প্রচলিত থাকায় ইহাদের মধ্যে সন্তান জননের পথ এককালে রুদ্ধ। ‘শান্ত-রতি’ শব্দের বৈষ্ণবশাস্ত্রে যে উৎকৃষ্ট ভাব বুঝায়, ইহারা তাহা না বুঝিয়া অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ইন্দ্রিয়সেবায় রত থাকে। এই জঘন্য ব্যাপারে এ দেশ ছারেখারে যাইতেছে, তৎসম্বন্ধে পাঠকবর্গকে বেশি কিছু জানাইতে স্পৃহা নাই।
শিষ্যদিগের ও তাহার সম্প্রদায়ের এই মত ধরিয়া লালন ফকিরের বিচার হইতে পারে না। তিনি এ সকল নীচ কার্য হইতে দুরে ছিলেন ও ধর্মজীবনে বিলক্ষণ উন্নত ছিলেন বলিয়া বোধ হয়। মিথ্যা জুয়াচুরিকে লালন ফকির বড়ই ঘৃণা করিতেন। নিজে লেখাপড়া জানিতেন না; তাঁহার রচিত অসংখ্য গান শুনিলে তাঁকে পরম পন্ডিত বলিয়া বোধ হয়। তিনি কোনো শাস্ত্রই পড়েন নাই, কিন্তু ধর্মালাপে তাঁহাকে বিলক্ষণ শাস্ত্রবিদ বলিয়া বোধ হইত। বাস্তবিক ধর্মসাধনে তাঁহার অন্তর্দৃষ্টি খুলিয়া যাওয়ায় ধর্মের সারতত্ত্ব তাঁহার জানিবার অবশিষ্ট ছিল না। লালন নিজে কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্মাবলম্বী ছিলেন না, অথচ সকল ধর্মের লোকই তাঁহাকে আপন বলিয়া জানিত। মুসলমানদিগের সহিত তাঁহার আহার ব্যবহার থাকায় অনেকে তাঁহাকে মুসলমান মনে করিত, বৈষ্ণবধর্মের মত পোষণ করিতে দেখিয়া হিন্দুরা ইঁহাকে বৈষ্ণব ঠাওরাইত। জাতিভেদ মানিতেন না, নিরাকার পরমেশ্বরে বিশ্বাস দেখিয়া ব্রাਜ਼দিগের মনে ইঁহাকে ব্রাਜ਼ধর্মাবলম্বী বলিয়া ভ্রম হওয়া আশ্চর্য নহে, কিন্তু ইঁহাকে ব্রাਜ਼ বলিবার উপায় নাই, ইনি বড় গুরুবাদ পোষণ করিতেন। অধিক কি, ইঁহার শিষ্যগণ ইঁহার উপাসনা ব্যতীত আর কাহারও উপাসনা শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানিত না। সর্বদা ‘সাঞ’ এই কথা মুখে শুনিতে পাওয়া যায়। ইনি নোমাজ করিতেন না। সুতরাং মুসলমান কী প্রকারে বলা যায়? তবে জাতিভেদবিহীন অভিনব বৈষ্ণব বলা যাইতে পারে; বৈষ্ণবধর্মের দিকে ইঁহার অধিক টান শ্রীকৃষ্ণের অবতার বিশ্বাস করিতেন। কিন্তু সময় সময় যে উচ্চ-সাধনের কথা ইঁহার মুখে শুনা যাইত, তাহাতে তাঁহার মত ও সাধন সম্বন্ধে অনেক সন্দেহ উপস্িথত হইত। যাহা হউক, তিনি একজন পরম ধার্মিক ও সাধু ছিলেন, তৎসম্বন্ধে কাহারও মতদ্বৈধ নাই। লালন ফকির নাম শুনিয়াই হয়তো অনেকে মনে করিতে পারেন, ইনি বিষয়হীন ফকির ছিলেন। সামান্য জোতজমা আছে; বাটি-ঘরও মন্দ নহে, জিনিসপত্রও মধ্যবর্তী গৃহস্েথর মতো। নগদ টাকা প্রায় দুই হাজার বলিয়া মরিয়া যান। ইঁহার সম্পত্তির কতক তাঁহার স্ত্রী, কতক ধর্মকন্যা, কতক শীতলকে ও কতক সৎকার্যে প্রয়োগের জন্য ইনি একখানি ফরমমাত্র করিয়া গিয়াছেন। ইনি নিজে শেষকালে কিছু উপায় করিতে পারিতেন না। শিষ্যরাই ইঁহাকে যথেষ্ট সাহায্য করিত। বৎসর অন্তে শীতকালে একটি ভান্ডারা (মহোৎসব) দিতেন। তাহাতে সহস্রাধিক শিষ্য ও সম্প্রদায়ের লোক একত্র হইয়া সংগীত ও আলোচনা হইত। তাহাতে তাঁহার পাঁচ-ছয় শত টাকা ব্যয় হইত।
ইঁহার জীবনী লিখিবার কোনো উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছুই বলিতেন না। শিষ্যেরা হয়তো তাঁহার নিষেধক্রমে, না হয় অজ্ঞতাবশত কিছুই বলিতে পারে না। তবে সাধারণে প্রকাশ, লালন ফকির জাতিতে কায়স্থ ছিলেন। কুষ্টিয়ার অধীন চাপড়া ভৌমিক বংশীয়েরা ইঁহার জ্ঞাতি। ইঁহার কোনো আত্মীয় জীবিত নাই। ইনি নাকি তীর্থগমনকালে পথে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হইয়া সঙ্গীগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েন। মুমূর্ষু অবস্থায় এক মুসলমানের দয়া ও আশ্রয়ে জীবন লাভ করিয়া ফকির হয়েন। ইঁহার মুখে বসন্ত রোগের দাগ বিদ্যমান ছিল। ইনি ১১৬ বৎসর বয়সে ১৭ই অক্টোবর শুক্রবার প্রাতে মানবলীলা সংবরণ করিয়াছেন। এই বয়সেও তিনি অশ্বারোহণ করিতে দক্ষ ছিলেন এবং অশ্বারোহণেও স্থানে স্থানে যাইতেন। মৃত্যুর প্রায় এক মাস পূর্ব হইতে ইঁহার পেটের ব্যারাম হয় ও হাত-পায়ের গ্রন্িথ জলস্কীত হয়। দুধ ভিন্ন পীড়িত অবস্থায় অন্য কিছু খাইতেন না। মাছ খাইতে চাহিতেন। পীড়িতকালেও পরমেশ্বরের নাম পূর্ববৎ সাধন করিতেন; মধ্যে মধ্যে গানে উন্নত্ত হইতেন। ধর্মের আলাপ পাইলে নববলে বলীয়ান হইয়া রোগের যাতনা ভুলিয়া যাইতেন। এই সময়ের রচিত কয়েকটি গান আমাদের নিকট আছে। অনেক সম্প্রদায়ের লোক ইঁহার সহিত ধর্মালাপ করিয়া তৃপ্ত হইতেন। মরণের পূর্বরাত্রিতেও প্রায় সমস্ত সময় গান করিয়া রাত্রি পাঁচটার সময় শিষ্যগণকে বলেন, ‘আমি চলিলাম।’ ইঁহার কিয়ৎকাল পরে শ্বাস রোধ হয়। মৃত্যুকালে কোনো সম্প্রদায়ী মতানুসারে তাঁহার অন্তিম কার্য সম্পন্ন হওয়া তাঁহার অভিপ্রায় ও উপদেশ ছিল না। তজ্জন্য মোল্লা বা পুরোহিত কিছুই লাগে নাই। গঙ্গাজল, হরেনাম নামও দরকার নাই। হরিনাম কীর্তন হইয়াছিল। তাঁহারই উপদেশ অনুসারে আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তাঁহার সমাধি হইয়াছে। শ্রাদ্ধাদি কিছুই হইবে না। বাউল সম্প্রদায় লইয়া মহোৎসব হইবে, তাহার জন্য শিষ্যমন্ডলী অর্থ সংগ্রহ করিতেছেন। শিষ্যদিগের মধ্যে শীতল, মহরম শা, মানিক শা, কুধু শা প্রমুখ কয়েকজন ভালো লোক আছেন। ভরসা করি, ইঁহাদের দ্বারা তাঁহার গৌরব নষ্ট হইবে না। লালন ফকিরের অসংখ্য গান সর্বত্রে সর্বদাই গীত হইয়া থাকে। তাহাতেই তাঁহার নাম, ধর্ম, মত ও বিশ্বাস সুপ্রচারিত হইবে। তাঁহার রচিত একটি গান নিম্েন উদ্ধৃত করা গেল−
গান:
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন ভাবে জাতের কী রূপ দেখলেম না এই নজরে।
১
কেউ মালা কেউ তছবি গলায়,
তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়,
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কার রে।
২
যদি সন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারীর তবে কি হয় বিধান,
বামণ চিনি পৈতা প্রমাণ
বামণি চিনি কিসে রেু
৩
জগৎ বেড়ে জেতের কতা,
লোকে গৌরব করে যথাতথা
লালন সে জেতের ফাতা
ঘচিয়াছে সাধ বাজারে
গবেষক ম. মনিরউজ্জামানের সৌজন্যে