somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লালনের ধর্ম

১৭ ই অক্টোবর, ২০০৮ ভোর ৫:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ধর্ম সমাজের একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ। ধর্মহীন সমাজের ইতিহাস আমাদের জানা নেই। সেই আদিমকালে মানুষ যখন গুহাবাসী ছিল, তখনো ধর্ম ছিল। সেই গুহা সমাজ থেকে শুরু করে আজকের অতি আধুনিক সমাজ পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই ধর্মের উজ্জ্বল অনিবার্য উপস্থিতি। ধর্মকে বাদ দিয়ে কখনোই কোনো সমাজের ইতিহাস রচিত হয়নি। তবে এই ধর্মের আকার আকৃতি সব সময় একই সমান্তরালে থাকেনি। সমাজের রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মেরও পরিবর্তন হয়েছে। আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ গোটা সমাজ যেখানে বদলেছে তখন সমাজের একটা সংঘ হিসেবে ধর্ম তার অস্তিত্ব অপরিবর্তনীয় রাখতে পারেনি। তাই সমাজ পরিবর্তনের বিভিন্ন ধাপে আমরা ধর্মেরও পরিবর্তন লক্ষ্য করি। পূর্ব পুরুষ পূজা এভাবেই ধর্ম ধাপে ধাপে পৌত্তলিকতা, একেশ্বরবাদ প্রভৃতি পর্যায় পেরিয়ে মানবতাবাদী হয়ে উঠেছে। আর ধর্মের এই বিবর্তন কালে কালে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহাপুরুষের মাধ্যমে ঘটেছে।

লালন সাঁইজি বাংলার অবিসংবাদিত কিংবদন্তি পুরুষ। তিনি বিশ্বের মানুষের কাছে রহস্যঘেরা এক জ্ঞানের ভান্ডার। তিনি নিজেকে, নিজের পরিচয়কে সব সময় রহস্যের আবর্তে আবদ্ধ করে রেখেছেন। কখনো তিনি নিজেকে কারও কাছে এমনকি তাঁর অতি প্রিয় শিষ্যদের কাছে কিংবা তাঁর পালক পিতা মওলানা মলম শাহের কাছে পর্যন্ত তাঁর সাম্প্রদায়িক পরিচয় ব্যক্ত করে যাননি। তাই তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জাত-পাত, ধর্ম নির্ণয়ে গবেষকরা অন্ধ জোনাকির মতো অন্ধকারেই আকিপাকি করে মরছে। ১৮৯০ সালে ১৭ অক্টোবর লালন সাঁইজি দেহত্যাগ করলে এর পনের দিন পর স্থানীয় একটি পাক্ষিক পত্রিকা ‘হিতকরী’ পত্রিকায় ‘মহাত্মা লালন ফকির’ নামে এক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে সাঁইজিকে হিন্দু বানানোর প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, ‘ইহার জীবনী লিখিবার কোনো উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছুই বলিতেন না । শিষ্যেরা হয়ত তাঁহার নিষেধক্রমে না হয় অজ্ঞতাবশত কিছুই বলিতে পারেন না । তবে সাধারণে প্রকাশ লালন ফকির জাতিতে কায়স্থ ছিলেন। ... ... ইঁনি ১১৬ বছর বয়সে গত ১৭ অক্টোবর শুক্রবার প্রাতে মানবলীলা স্মরণ করেছেন।’ (বিশ্বাস, লোককবি লালন-পৃঃ-১৩৭)। অবশ্য এরও আগে ১৮৭২ সালে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার তার প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্তা’ প্রকাশিকায় ‘জাতি’ নামক এক নিবন্ধে জানান, ‘লালন শাহ নামে এক কায়স্থ আর এক ধর্ম আবিষ্কার করিয়াছে। হিন্দু মুসলমান সকলেই এই সম্প্রদায়ভুক্ত। আমরা মাসিক পত্রিকায় ইহার বিবরণ প্রকাশ করিব। ৩-৪ বৎসরের মধ্যে এই সম্প্রদায় অতিশয় প্রবল হইয়াছে। ইহারা যে জাতিভেদ স্বীকার করে না সে কথা বলা বাহুল্য (আহমদ; যুক্তবঙ্গে লালন চর্চার ক্রমবিকাশ; পৃঃ- ৩৩)। লালন সাঁইজি তাঁর জীবদ্দশায় পাঁচ বিঘা জমি কিনেছিলেন। ১৮৮১ ও ১৮৮২ সনে সাঁইজির অনুকূলে দুটি দলিল সম্পাদিত হতে দেখা যায়, সেখানে সাঁইজিকে অবশ্য মুসলমান হিসেবে দেখানো হয়েছে। ‘ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা থানার অন্তর্গত আলমডাঙ্গা গ্রামে লালন শাহ জমি কিনে আখড়া বাড়ি তৈরি করেন। ওই জমির দুটি পাট্টা দলিল পাওয়া গেছে। ১৮৮১ ও ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে দলিল দুটি সম্পাদিত হয়। এখানে দলিল দুটির মূলপাঠ মুদ্রিত হলো। উল্লেখ্য, ‘উক্ত পাট্টাদুটির স্বপক্ষে লালন-প্রদত্ত কবুলিয়ত আছে। সর্বমোট দলিল সংখ্যা চার। দলিলের অনুলিপি- শ্রী শ্রী হরি, মহারানী ভিক্টোরিয়ার মূর্তিযুক্ত আট আনার স্ট্যাম্পে রেজিস্ট্রিকৃত। পাট্টা গ্রহীতা-শ্রীযুত লালন সাই, পীং-মৃত সেরাজ সাই, জাতী-মুসলমান, পেশা-ভিক্ষা, ইত্যাদি, সাকিন- ছেঁউড়ে পরগনে ইস্টাসন ভালকো, ছব রেজিস্টারি, কুমারখালী’ (সরকার; লালন শাহের মরমী দর্শন; পৃঃ- ৪৪৮)। এভাবেই বিছিন্ন কিছু তথ্য প্রবাহকে আশ্রয় করে সাঁইজির মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া শুরু হয়ে যায়। তাঁকে হিন্দু এবং মুসলমান বানানোর জোর চেষ্টায় গবেষকেরা গলদঘর্ম হতে থাকে। আর এই ডামাডোলের মধ্যে পড়ে সাঁইজির আসল পরিচয় রয়ে যায় সবার অন্তরালে। তিনি হিন্দু কি মুসলমান এটা নিয়ে আমাদের কৌতূহলের অন্ত না থাকলেও লালন সাঁইজি স্বয়ং এ ব্যাপারে ছিলেন সম্পূর্ণ নিস্পৃহ। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী লালন সাঁইজি হিন্দুর সন্তান। কোনো এক সময় তীর্থে যাওয়ার প্রাক্কালে পথিমধ্যে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গি সাথীরা তাঁকে মৃত ভেবে নদীতে ফেলে দেয় এবং সমাজে প্রচার করে লালন মারা গেছেন। বসন্ত রোগে আক্রান্ত লালন কলার ভেলায় ভাসতে ভাসতে এসে কুষ্টিয়ার কালীগঙ্গা নদীর কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার ঘাটে এসে থামেন। সেখানে নিঃসন্তান মওলানা মলম শাহ তাঁকে উদ্ধার করে পুত্রবৎ সেবা শুশ্রুষা করে সারিয়ে তোলে। তারপর লালন তাঁর নিজ সমাজে ফিরে গেলে সমাজ কর্তৃক তাঁকে অস্বীকার তাঁকে খুবই মর্মাহত করে এবং সমাজের এহেন আচরণে ব্যথিত লালন ছেঁউড়িয়ায় ফিরে এসে মওলানা মলম শাহের সঙ্গে বসবাস করতে থাকে; কিন্তু এরও কতক কিংবদন্তী। কারণ এটি সঠিক হলে লালনের জাত-পাত ধর্ম নির্ণয় নিয়ে আমাদের এত গলদঘর্ম হতে হতো না। মওলানা মলম শাহের মাধ্যমে লালন সাঁইজির জাত-পাতের বিষয়টির সম্পূর্ণ সুরাহা হয়ে যেত; কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। বরং সেটা আরো ঘনীভূত হয়েছে। রহস্যের অতল গভীরে ডুবেছে লালনের ধর্ম ও সম্প্রদায়িক পরিচয়ের বিষয়টি। মওলানা মলম শাহ যখন কালীগঙ্গা নদীর তীরে বসন্ত রোগে আক্রান্ত সাঁইজিকে উদ্ধার করেন, তখন সাঁইজির বয়স ছিল ১৬-১৭ বছর। নিঃসন্তান মওলানা দম্পতি পিতৃ ও মাতৃ স্নেহে লালন সাঁইজিকে গ্রহণ করেন। সমাজের মানুষের কৌতূহলের পরিপ্রেক্ষিতে মওলানা মলম শাহ লালন সাঁইজির জাত-পাত, ধর্ম-গোত্রের কথা জিজ্ঞেস করলে সাঁইজি উত্তরে বলেন,

‘আমি লালন এক সিঁড়ে
ভাইবন্ধু নাই আমার জোড়ে
ভুগেছিলাম পক্স জ্বরে
মলম শাহ করেন উদ্ধার।


এতেও সমাজের মানুষের কৌতূহল নিবৃত্ত না হলে তারা সরাসরি লালনের জাতধর্ম নিয়ে যখন কথা তুলেন তখন লালন বলেন,

‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।।’


লেখক: আবু ইসহাক হোসেন
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০০৮ ভোর ৫:১৫
৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×