বই নিয়া পর্যালোচনা করা নিঃসন্দেহে কঠিন জিনিস। প্রিয় বই নিয়ে লেখা আরও কঠিন। অনেকটা প্রিয় খাবার নিয়ে লেখার মতো- হ্যাঁ, দেখলেই জিভে জল আসে, লাফায়া গিয়ে গলধঃকরণের ইচ্ছা জাগে- কিন্তু কেন জাগে তা তো জানি না!
তবুও, চেষ্টা করে দেখি।
'ক্রাচের কর্নেল' বিখ্যাত লেখক শাহাদুজ্জামানের লেখা বহুল জনপ্রিয় এবং সমালোচিত বই, কর্নেল তাহেরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে যার ঘটনাবলি। জনপ্রিয়- কারণ তৎকালীন সময় আর তাহেরকে নিয়ে শাহাদুজ্জামানের পরিষ্কার লেখনি। সমালোচিত- কারণ ওই একই; তৎকালীন সময় আর তাহেরকে নিয়ে শাহাদুজ্জামানের পরিষ্কার লেখনি। এই ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ 'ক্রাচের কর্নেল' তাহেরকে ফলো করার পাশাপাশি ফলো করেছে সেই অস্থির সময় এবং সেই সময়ের প্রধান চরিত্রদের। তাহের লেখকের জন্যে সেই স্থির খুঁটিস্বরূপ- যাকে কেন্দ্র করে তিনি সেই সময়কে ফিরিয়ে এনেছেন বইয়ের পাতায়। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে বইটি দুই বিপরীত ট্রিটমেন্ট- জনপ্রিয়তা এবং বয়কটীয় মনোভাব- পেয়ে আসছে প্রকাশের পর থেকেই।
আসলে বইটির প্রাণ কোথায়? কেন পাঠক বইটি পড়বেন?
বইটি পাঠক পড়বেন কারণ শাহাদুজ্জামান নিরপেক্ষ চোখে ইতিহাসের পাঠ নিয়েছেন। আর তুলে এনেছেন বহু ব্যতিক্রমি আর দুর্লভ উপাদান। আমাদের নতুন প্রজন্মের অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধকে একরকম রোমান্টিক চোখে দেখে। ''হানাদার বাহিনি হামলে পড়ল আর আমরা সবাই বিভেদ ভুলে গিয়ে একত্রে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলাম'' --এরকম ভাবে। কিন্তু আসলে যুদ্ধের সময় কতটা প্রতিকূলতা এড়িয়ে একজন তাজউদ্দীন এগিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশকে, কতটা ত্যাগ স্বীকার করে একেক জন মুক্তিযোদ্ধা লড়েছেন, এবং কতশত সুবিধাবাদি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে যুদ্ধ থেকে- তা এসেছে শাহাদুজ্জামানের উপন্যাসে। এসেছে অভ্যন্তরীণ ভাঙনের গল্প। আমাদের দেশের দুই প্রধান ফিগার- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং, বিশেষতঃ জিয়াউর রহমান- এদেরকেও হাঁটু গেড়ে বসে পূজা করা হয় নি। দুজনের পারসোনালিটির পার্থক্য এবং ভাল-খারাপ উভয় দিকগুলো এসেছে।
বঙ্গবন্ধুর সমুদ্রসম ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধিমান নেতৃত্বের কথা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে স্বাধীনতার পর তার দূরদর্শীতার অভাব এবং চাটুপ্রেমি হয়ে পথভ্রষ্ট হবার কথা।
নিরাবেগ, বাই দা বুক জীবনযাপনে বিশ্বাসী অতি ভাগ্যবান একজন মানুষ- জিয়ার - মাথা ঠাণ্ডা রেখে স্ট্রাটেজি মেনে চলার কথা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে তার সুবিধাবাদি মনোভাবের কথা, প্রাণরক্ষাকারী তাহেরের সাথে তার শীতল বিশ্বাসঘাতকতার কথাও। এবং আমার মনে হয় এটাই একজন লেখকের কাজ। যিনি স্রেফ বিশ্লেষণ করবেন- গালি বা অন্ধভক্তির অর্ঘ্য না দিয়ে। খোলা চোখে।
প্রায় সাড়ে তিনশ পৃষ্ঠার এই বইয়ের পাতায় পাতায় আছে বাংলাদেশের রাজনীতির কুখ্যাত-বিখ্যাত সব রথি-মহারথির নাম। পরিচিতির কয়েক লাইন পরেই লেখক তাদের ভাগ্য জানিয়ে দিচ্ছেন। ইনি কয়েক বছর পড়ে এই পরিস্থিতিতে পড়বেন, ইনি এভাবে বদলে যাবেন। এই অংশগুলো পড়ার সময় চুরি করে বিধাতার ডায়েরি পড়ার অনুভূতি জাগে।
তারপর, আগে যেমনটা বলেছি, শাহাদুজ্জামান খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে উপন্যাসের এই ফরম্যাটটি ব্যবহার করেছেন মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের, চলাকালীন, এবং পরের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটাকে সংক্ষেপে তুলে ধরতে। কি আসেনি গল্পে? আইয়ুব পতনের পর ইয়াহিয়ার উত্থান, শেখ মুজিব-ভাসানির শক্তিশালি অবস্থান, নির্বাচন, তারপর গড়িমসি, তারপর সরাসরি গণহত্যার, মুক্তিযুদ্ধের শুরু। যুদ্ধের সময়টা আমরা দেখি তাহেরের চোখে। তার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সাহসি পলায়ন, পা হারানোর কাহিনী, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হাসপাতালে রিট্রিটের গল্প। এরপরে ধীরে ধীরে ভাঙা দেশকে গড়তে গিয়ে মুজিবের ফ্রাস্ট্রেশন এবং একটার পর একটা ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া, তারপর অভাবনীয় সেই হত্যাকান্ড। এরপরে উপন্যাসটা আর ঐতিহাসিক উপন্যাস থাকে না, হয়ে ওঠে থ্রিলার।
একের পর এক ক্যু হচ্ছে, দেশের প্রধান পাল্টে যাচ্ছেন প্রায় ঘন্টায় ঘন্টায়, তার সাথে পাল্টে যাচ্ছে হিসাব। ঝরছে রক্ত। আর আমাদের নায়কেরা একেক বেড়াজালে আটকে যাচ্ছেন যার আসলে কোন সমাধান নেই (এবং সবগুলোতেই খন্দকার মোশতাকের সর্পসম উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়)। দম আটকে রাখতে হয় পড়তে গেলে। পৃষ্ঠা না উলটে থাকা যায় না। সব শেষে তাহের এলেন মঞ্চে, এবং ভুল মানুষটির ওপরে বাজি ধরে হারালেন নিজের পরিবার, নিজের জীবন।
তাই সব শেষে, 'ক্রাচের কর্নেল' একটা ট্রাজেডি। তাহেরের ট্রাজেডি। যে মানুষটি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন বাল্যকাল থেকেই, যিনি সমাজতত্ত্বের পাঠ নিয়েছেন ধর্মগ্রন্থের আদেশের মতো করে, ভবিষ্যতে গেরিলা হবেন বলেই শত্রু আর্মিতে জয়েন করেছিলেন, যাকে কেন্দ্র করে তার সাহসি ভাই-বোন-মা-বাবা-স্ত্রী সবাই লড়েছেন, স্বপ্ন দেখেছেন, দেশকে যিনি ভালবাসতেন সর্বস্ব দিয়ে- সেই বীরের মৃত্যুর ব্যবস্থা করা হল রাষ্ট্রীয়ভাবে ষড়যন্ত্র করে! এর চেয়ে বড় লজ্জা কি হতে পারে আর!
এই বইয়ের রঁন্ধ্রে রঁন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশ, আর ছড়িয়ে আছে তার হতভাগা এক সন্তানের কথা। যিনি দেশকে দিয়েছেন অনেক, সুযোগ পেলে যিনি দিতে পারতেন আরও। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে ফাঁসির মঞ্চে নিবিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশের মানুষ তাকে উপযুক্ত সম্মান বা পরিচিতি দেয় নি। তাঁকে আজো বহু মহলে ব্যঙ্গ করা হয় ল্যাংড়া তাহের বলে, এখনো গালাগাল দেয় অনেকে। মৃত্যুর পরেও তাদের অকারণ নিস্ফল ক্রোধ থেকে মুক্তি মেলে নি মানুষটির।
কিন্তু ইতিহাস বলে, তিনি এদেশের কতিপয় ক্ষণজন্মা নক্ষত্রের একটি। তিনি একজন জন্মযোদ্ধা, যিনি দেশের ডাক শুনে কখনো মুখ ফিরিয়ে নেন নি। তিনি একজন সহজাত নেতা, যাকে অনুসরণ করে মৃত্যুকেও তুচ্ছ জ্ঞান করেছে অন্যরা। তিনি আমাদের তাহের।
আমাদের ক্রাচের কর্নেল।