somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লোকসঙ্গীতের সাতরঙ (পর্ব -০২)

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর ঘাটু গান গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।"

শাহ আবদুল করিমের এই গানে আমরা ঘাটু গান সম্পর্কে জানতে পাই। তবে দুঃখের বিষয় মূল গানে ঘাটু শব্দ থাকলেও এখনকার অনেক গানে ঘাটু শব্দের স্থলে পল্লী গান/মুর্শিদী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কেন ঘাটু শব্দ বাদ দেয়া হয়েছে তা এক রহস্য। আমাদের লোকসঙ্গীত অনেক বৈচিত্র্যময় ছিল তা ঘাটু গান দেখলে বোঝা যায়। আজকে চলুন ঘাটু গানের সাতকাহন জেনে নেই।


ঘাটু গান (Ghatu Gaan): ‘ঘাটু গান’-এর উচ্চারণ নিয়ে অঞ্চলভেদে ভিন্নতা রয়েছে। কোথাও কোথাও শব্দটিকে ঘাঁটু, ঘেটু, ঘেঁটু, গেন্টু, ঘাডু, গাড়ু, গাঁটু বা গাডু বলা হয়। তবে নেত্রকোনা অঞ্চলে এটি ’ঘাটু’ এবং ’গাডু’ নামেই বহুল প্রচলিত। একটু শিক্ষিত জনরা ‘ঘাটু গান’ বলেন। সুনামগঞ্জ এলাকার জলসুখা গ্রামের বাউল আখড়ায় প্রথম ঘেঁটু গান শুরু হয়। সুনামগঞ্জ ছাড়াও নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ এবং গোটা হাওড় অঞ্চল ছিল এই গানে আবাসভূমি।

‘ঘাটু গান’ এর নামকরণের ইতিহাসও একেক জনের বর্ণনায় একেক রকম। সাধারণের ধারণা, ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে গাওয়া হতো বলে এর নাম হয়েছে ঘাটু গান। নেত্রকোনার স্থানীয় লোক সাহিত্য সংগ্রাহক গোলাম এরশাদুর রহমান তার ’নেত্রকোনার লোকগীতি পরিচয়’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন: “ঘাটু নামকরণ সম্পর্কে স্থানীয়ভাবে আদিকালের সমঝদারদের বক্তব্য ছিল- কৃষ্ণের বাঁশির ঘাট শব্দ থেকে ঘাটু নামকরণ হয়। কারণ ঘাটু ছেলেটিকে মূলত নাচে ও গানে নিয়ন্ত্রণ করে বাঁশি’’।

ঘাটু গানে প্রধান আকর্ষণ ঘাটু চরিত্র। একজন সুন্দর কিশোর মেয়ের সাজে সজ্জিত হয়ে নৃত্য করত। ঘাটু ছোকড়াদের মাথায় লম্বা চুল রাখা ছিল বাধ্যতামূলক। তারা চুলে বেণী ও খোঁপা বাঁধতেন। উকিল মুনশীর নাম অনেকেই শুনেছেন। তিনি শৈশবে ঘাটু গানের ঘাটু ছিলেন। তাছাড়া আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও ঘাটু গানের (লেটো গান) দলে ছিলেন।
ঘাটু গানের মূল বিষয়বস্তু ছিল রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলা। চিরায়ত এ প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করেই রচিত হতো ঘাটু দলের গান। আসরে উঠে ঘাটু প্রথমে বন্দনা গাইতেন। এরপর প্রেম, প্রেমতত্ত্ব, মান, অভিমান, বিচ্ছেদ, মিলন, সন্ন্যাস প্রভৃতি বিষয় অবলম্বন করে প্রবাহিত হতো তার গীতধারা। শ্রী কৃষ্ণের মথুরা গমনের পর অথবা তার সান্নিধ্য না পেয়ে রাধার বিরহ উপলক্ষ করে রচিত বিচ্ছেদ গানগুলোতে পরিলক্ষিত হতো চিরন্তন বেদনার সুর। অনেকের মতে, ছম ঘাটু গানের রাধা-কৃষ্ণের বিরহ সঙ্গীত থেকেই নেত্রকোনার অন্যান্য লোক সংগীতে ‘রাই ধারা’ ও ‘শ্যাম ধারা’র উদ্ভব। ছম জাতীয় মূরলী শ্রেণীভুক্ত একটি ঘাটু গান :

আমার মনের বেদন
সে বিনে কেউ জানে না
কালা যখন বাঁজায় বাঁশি
তখন আমি রান্তে বসি
বাঁশির সুরে মন উদাসী
ঘরে থাকতে পারি না
আমার মনের ........।


হিন্দু ধর্মের রাঁধা-কৃষ্ণ কাহিনীই ঘাটু গানের মূল প্রতিপাদ্য হলেও এক পর্যায়ে ইসলাম ধর্মের নানা বিষয়সহ নর-নারীর সাধারণ প্রেম-বিরহ এবং সমসাময়িক বিষয়বস্তুও উঠে আসে ঘাটু গানে। কারণ, হিন্দু-মুসলিম উভয় সমপ্রদায়ের লোকজনই ছিল ঘাটু গানের দর্শক-স্রোতা। ইসলাম ধর্মের নানা কাহিনী নিয়ে রচিত গানগুলো কোথাও কোথাও লেটো গান নামে পরিচিত।

ঘাটু গানে ধীরে ধীরে কদর্যতা ঢুকে যায়। হাওড় অঞ্চলের সৌখিনদার লোকের ঘাটুদের ভাড়া করে বাসায় আনা শুরু করলো। তাদের সাথে রাত কাটানো শুরু করলো। প্রকাশ্য এই সমকামিতা সেই সময় স্বীকৃত ছিল। ঘেঁটুপুত্র রাত্রিযাপন করে শৌখিনদের সঙ্গে। শৌখিনদারের স্ত্রী চোখের জল ফেলেন; তিনি ঘেঁটুপুত্রকে দেখেন তার সতীন হিসেবে।এই নিয়ে গান আছে...

"আইছে সতিন ঘেঁটুপুলা
তোরা আমারে বাইন্ধা ফেল
পুব হাওরে নিয়া..."

বৃটিশ শাসন আমলে এবং বৃটিশরা চলে যাবার পরেও ঘেঁটু গান এর আসর হত। তবে এই গান আজ বিলুপ্ত। সম্প্রতি হুমায়ুন আহমেদ ঘেঁটু গানের উপর ভিত্তি করে ''ঘেঁটু পুত্র কমলা'' নামে একটি চলচিত্র বানিয়েছেন।

আমাদের ফেইসবুক পেইজে গিয়েও আরো তথ্য পাবেন
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:১২
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×