নাহ্, ভ্যালেন্টাইন দিবসের আশপাশে লিখছি বলে এমন ভাববেননা যে আজম খানের মতো আমারও প্রেয়সী টাইপের কিছু হারিয়ে গেছে। কাজেই আবার ফিরে চাইবার একটা কষ্টালজিক (কম্যুনিটি ব্লগের উৎপাদিত শব্দ) অনুভূতি প্রকাশ করা যেতেই পারে।
হঠাৎ সেদিন মনে পড়লো, হিন্দী ছবরি কুমার গৌরবের অতি পুরাতন একটা ছবি দেখে। মনে পড়ে গেল, আহা, কালের বিবর্তনে কত কিছু হারিয়ে যাবে! না, কুমার গৌরব হারিয়ে গেছেন, সেরকম কোন আক্ষেপ নিয়েও এই লেখাটি কিন্তু না।
কালের বিবর্তনে তাহলে কি হারিয়েছে, হারিয়ে যাচ্ছে, যা নিয়ে এখানে আক্ষেপ করতে বসে গেলাম! ঠিক ধরেছেন, খুব ছোটখাট কিছু জিনিস, যা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী ছিলো একসময়; বাঙালীর জীবনের সাথে যে জিনিস বা বিষয়গুলো কোন না কোনভাবে জড়িত ছিলো, কিন্তু এখন আর তেমন একটা দেখা যায়না। কেমন যেন বুকটা ভার হয়ে আসে, দীর্ঘশ্বাস নিতে পারলে ভালো লাগে। ভয় হয়, একসময় কি তাহলে সব হারিয়ে যাবে! একটা লিস্ট আপ করা যাক কি কি হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে।
১.
কুমার গৌরবের প্রসঙ্গে আবার ফিরি। আশির দশকের শুরু বা মাঝামাঝির দিকে ঢাকায় চরম জনপ্রিয় ছিলেন হিন্দী ছবির এই নায়ক। নাহ্, তখনও তরকারীর পাতিলের ঢাকনি টিভি এন্টেনার দুমাথায় লাগিয়ে ঝিরঝির করতে থাকা ভারতীয় টিভি দেখার কালচার দেশে তেমন চালুই হয়নি। এমনকি ভিসিআরও এমন জনপ্রিয় ছিলোনা যে কোন নায়কের ভিডিও কত ধার হচ্ছে তা দিয়ে জনপ্রিয়তা মাপা যেত। সেসময় যা দিয়ে জনপ্রিয়তা মাপা হতো,সেটা ছিলো "ভিউকার্ড"। কুমার গৌরবের ভিউকার্ড দোকানে দোকানে ঝুলতো।
আহারে ভিউকার্ড! এখন আর কোথাও চোখে পড়েনা। নাকি যেখানে চোখে পড়ে সেখানে যাওয়া হয়না! আমরা ছোটবেলায় ছোট ছোট হ্যান্ডি ফটো-এ্যালবামে ছবির বদলে ভিউকার্ড ঢুকিয়ে স্কুলের ব্যাগে রাখতাম, ইমরান খান, আকরাম, কপিল দেভ, শ্রীদেবী, জয়াপ্রদা, শাবানা, ববিতা -- আরো কত! বন্ধুরা আদানপ্রদানও করতাম। জানিনা -- এপ্রজন্মের বাচ্চারা কি জানে "ভিউকার্ড" কি?
২.
মায়ের একটা ছিলো, কাঠের রঙের পাটাতন, আর উপরটা লাল নেটের ছাউনীর মতো করে ঢাকা। কবে যে কোথায় হারালো, কেউ বলতে পারবেনা। খড়মের কথা বলছি। নানাকেও সম্ভবতঃ খড়ম পরতে দেখেছি। মনে আছে ছোটবেলায় মায়ের বিরাট খড়মে ছোট্ট পা গলিয়ে দিয়ে "ঠক! ঠক!" করে কত হেঁটেছি, আর কত হোঁচট খেয়েছি!!
সেই খড়ম আবার দেখলাম জাপানে এসে! বারো মাসে তেরো পার্বণ আসলে পালন করে এই জাপানীরা, যখন তখন যেখানে সেখানে এদের মেলা -- জাপানীতে বলে "মাৎসুরী"। মাঝে মাঝে মনে হয়, যেন উইকএন্ডের সাথে কোনভাবে গোঁজামিল দিয়ে লগ্ন মিলিয়ে মেলার আয়োজন করে এরা। তখন ট্রাডিশনাল "কিমোনো" পরে, কাঠের খড়ম পরে গটগট করে হাঁটতে দেখা যায় জাপানী বুড়ো-বুড়িদের।
৩.
বায়োস্কোপ নিয়ে গান গেয়েছেন বাপ্পা মজুমদার, কিন্তু তাঁর তরুণ-তরুণী ভক্তরা কি আসলেই দেখেছে কখনো "বাইস্কোপ" (আমরা বলতাম) নামের এই অদ্ভুত জিনিসটি? বিশাল ড্রামের মতো একটা ঝালরে সাজানো একটা জিনিস নিয়ে ঘুরতো বাইস্কোপওয়ালা, আর কোথাও মাঠ পেলেই তার মাঝখানে ড্রামটাকে রেখে হাঁক দিতো। ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ছুটতো। চারআনা দিলে একবার দেখা যায়, ড্রামের গায়ের ফুটোতে চোখ রাখলে দেখা যায় কত কত জায়গা! কাবা শরীফ থেকে শুরু করে হিমায় পর্বত -- কত অজানারে! লোকটা হাতল ঘুরোলেই ছবি বদলে যেতো, আর লোকটা কি কি যেন বলতো। হয়তো, কোন জায়গা সেটার বর্ণনা দিতো, হয়তো ছড়ায় ছড়ায় দুনিয়া দেখাতো -- আজ আর ভালো মনেও নেই।
৪.
এখনকার বাচ্চারা সবাই মজার মজার কার্টুন আঁকা, মাঝে মাঝে কার্টুনের ক্যারেকটার ঝুলে থাকা -- রঙবেরঙের ব্যাগ পিঠে নিয়ে স্কুলে যায়। আমাদের ছোটবেলাতেও আমরা অধিকাংশেই সেরকম ব্যাগ নিয়েই যেতাম। তবে তার মধ্যেও কেউ কেউ আসতো একেবারে অন্যরকম একটা ব্যাগ নিয়ে। সেগুলো ছিলো রূপালী রঙের ছোটছোট টিনের স্যুটকেস টাইপের। ঘন আকৃতির স্যুটকেস, টিনের তৈরী, আবার হালকাও!
স্কুলে ভর্তি হবার পর বড় আপুর পিঠের ব্যাগের মতো একটা ব্যাগ দাবী করায় যখন ব্যাগ কিনে দিলো, তার কিছুদিন পর ঐ টিনের স্যটুকেসের জন্য আমার মন পোড়া শুরু করেছিলো। অথচ মাত্র কদিন আগেই নতুন ব্যাগ কিনেছে! মনের কষ্টে আর বলাও হলোনা। কতবার ভেবেছি ব্লেড দিয়ে নতুন ব্যাগটাকে কেটে ছিঁড়ে গেছে বলে টিনের স্যুটকেস হাতিয়ে নেবো -- সাহস হয়নি। সেই না পাওয়ার বেদনাতেই মনে হয় আজ ২৭ বছর পর সেই টিনের স্যুটকেসকে মনে পড়ে গেল।
৫.
আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, অনেকদিন ধরে শিলাবৃষ্টি দেখিনা! অথচ ছোটবেলায় প্রতি বৈশাখের দুপুরে বা বিকেলে কতো শিলাবৃষ্টি দেখেছি! সে এক অন্যরকম মজা ছিলো। আমরা বলতাম, "শিল পড়ছে"। সম্ভবতঃ শুরুর দিকে পড়তো ছোট ছোট শিল, আস্তে আস্তে একটু বড়গুলো পড়া শুরু করতো।
শিল পড়া শুরু হলে বারান্দায় থাকা কড়া রকমের নিষেধ ছিলো, তাও ছোট ছোট শিল কুড়োতে কত বকা খেয়ে বারান্দায় লাফালাফি করতাম। যেদিন একটু বড় বড় শিল পড়তো, সেদিন বারান্দার পাশের জানালায় আমরা ভাইবোনেরা জড়ো হতাম জানালা বন্ধ করে, যেই একটা শিল পড়তো বারান্দায়, দরজা খুলে টুক করে শিলটা তুলেই আবার ঢুকে যেতাম ঘরে। আর রান্নাঘরের পেছন দিয়ে দেখা যেত রহিম ভাইদের আমবাগান, বৃষ্টি পড়া শেষ হলে দস্যির মতো পোলাপান সবাই ছুটে যেতাম সেই আমবাগানে। শিলের আঘাতে আমের মুকুল ঝরে পড়তো।
সেই শিলপড়া বৃষ্টিও বন্ধ হয়ে গেল!! ২০০৬ এর অগাস্টের এক বিকেলে অল্প একটু সময়ের জন্য শিল পড়তে দেখেছিলাম মনে হয়, আবার কবে আসে কে জানে!
৬.
প্রত্যেক বছর বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা দিবসের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বসে থাকতাম আমরা। আগের দিন রাতে ঘুমাতে যেতাম তাড়াতাড়ি, তারপর সকাল পাণনচটার মধ্যে উঠে পশ্চিমের জানালার ধারে গিয়ে বসে থাকতাম। একটু পরেই শুরু হতো, "গুড়ুম!", "গুড়ুম!" -- এরকম একুশবার।
তোপধ্বনি শোনায় এত আনন্দ -- এখন ভাবতেও অবাক লাগে। সেই তোপধ্বনি কোথায় হতো তাও ভালো মনে নেই, স্মৃতি প্রতারণা না করলে বলা যায় পিলখানায় সম্ভবতঃ।
হয়ত এখনও হয়, পিলখানায় তোপধ্বনি। বিশেষ দিবসগুলোতে হয়তো এখনও একুশবার শূণ্যে গোলা ছোঁড়া হয়। শুধু কোলাহল, যানজট, দূযিত বায়ুর ভীড়ে পশ্চিমের জানালা পর;যন্ত সেই ধ্বনি পৌঁছায়না। অথবা হয়তো পৌঁছায়, হয়তো অনেক শিশু এখনও জানালার ধারে বসে থেকে ততোপধ্বনি শোনে, আমারই ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে তোপধ্বনি শোনার আগ্রহটা চলে গেছে। যেটাই হোক, সেই তোপধ্বনিও হারিয়ে গেছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ ভোর ৬:৪১