somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোলরিজের কবিতা: বুড়ো নাবিকের গান (পঞ্চমাংশ)

২২ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৮:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আহ ঘুম! একটা প্রশান্তির জিনিস,
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু, সবাই তাঁকে ভালোবাসে!
সকল প্রশংসা ঐ মেরি কুইনের জন্যে!
সেই তো স্বর্গ থেকে পাঠিয়েছে এমন প্রশান্তির ঘুম,
যে ঘুম পিছলে ঢুকে পড়েছে আমার আত্মার অভ্যন্তরে।

ডেকের উপর খালি পাত্র গুলো,
অনেকক্ষণ ধরে এমনিই পড়ে ছিলো,
স্বপ্নে দেখলাম, পাত্র গুলো শিশির জলে ভরে গিয়েছিলো;
যখন জেগে উঠলাম, দেখলাম বৃষ্টি হচ্ছিলো।

সিক্ত হয়ে উঠেছিলো আমার দুটো ঠোঁট, শীতল হয়ে উঠেছিলো আমার গণ্ডদেশ,
ভিজে ছুপছুপে হয়ে গিয়েছিলো আমার শরীরের পোশাক,
নিশ্চয়ই আমি স্বপ্নে জল গিলছিলাম,
এখনো আমার শরীর গিলে যাচ্ছিলো জল।

আমি নড়ে উঠলাম, কিন্তু শরীরের কোন অঙ্গই অনুভব করলাম নাঃ
শরীরটা অনেক হালকা লাগছিলো— এতই হালকা লাগছিলো যে
মনে করলাম হয়তো আমি ঘুমের মধ্যেই মরে গিয়েছিলাম,
আর এই আমিটা ছিলাম আশীর্বাদ পুষ্ট কোন ভুত।

এবং কিছুক্ষণ পরেই একটা প্রবল বাতাসের আওয়াজ কানে আসলোঃ
বাতাসটা কাছে আসছিলো না;
কিন্তু তাঁর আওয়াজ কাঁপিয়ে তুলেছিলো জাহাজ গুলোকে,
আওয়াজটা ছিলো খুব তীক্ষ্ণ আর শুষ্ক।

উপরের বাতাসটা যেন প্রাণের জোয়ারে ফেটে পড়ছিলো!
আর দেখা যাচ্ছিলো শত শত অগ্নি-পতাকা,
তাঁরা ছুটাছুটি করছিলো এদিক-ওদিক!
এদিকে আর ওদিকে, ভিতরে আর বাহিরে,
মাঝখানে নেচে বেড়াচ্ছিলো ক্লান্ত তারা গুলো।

আর আগত বাতাসটা গর্জে উঠছিলো আরও জোরে,
জাহাজ গুলো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো হোগলার মত,
একটা কালো মেঘের খণ্ড থেকে ঝরে পড়লো বৃষ্টি;
চাঁদটা দাঁড়িয়ে ছিলো তাঁর কিনারায়।


ঘন কালো মেঘটা ছিলো ফাটা আর স্থির,
চাঁদটা ছিলো তাঁর পাশেইঃ
বৃষ্টির ফোটা গুলো যেন উঁচু পাহাড় থেকে ছুড়া একেকটা তীর,
খাঁজ বিহীন বজ্রপাত ধেয়ে আসছিলো নিচে,
একটা ঢালু আর প্রশস্ত নদীতে।

প্রবল বাতাসটা কখনই পৌছুলো না জাহাজটার কাছে,
তবুও জাহাজটা এগিয়ে যাচ্ছিলো!
বজ্রপাত আর চাঁদটার নিচে,
মরা মানুষ গুলো গোঙ্গিয়ে উঠলো।

তাঁরা গোঙালো, আড়মোড়া ভাঙ্গলো, সবাই দাঁড়িয়ে পড়লো,
তাঁদের মুখে কোন কথা ছিলো না, তাঁদের চক্ষু গুলোও ছিলো স্থির;
কি অদ্ভুত ছিলো ব্যাপারটা, এমনকি স্বপ্নেও এমন ব্যাপার বিশ্বাস যোগ্য নয়,
মরা মানুষ গুলোকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখাটা।

চালক নাবিকটা হাত দিল জাহাজের হালে, চলতে থাকলো জাহাজ;
তখনো কোন বাতাস বইছিলো না,
সব গুলো নাবিক মিলে আবার দড়ি টানতে শুরু করল,
তাঁরা যেন অভ্যাসের বসে কাজ করে যাচ্ছিলো,
তাঁরা শরীরের অঙ্গ গুলো নাড়াচাড়া করছিল প্রাণহীন যন্ত্রের মত—
আমরা ছিলাম এক মৃত্যুবৎ নাবিক দল।

আমার ভাইয়ের ছেলের দেহটা
দাঁড়ালো এসে আমার পাশে, হাঁটুর সাথে হাঁটু মিলিয়েঃ
দেহটা আর আমি মিলে একটা দড়ি টেনে তুললাম,
কিন্তু সে আমাকে বললো না কিছুই।

‘তোমাকে আমার ভয় করে, বুড়ো নাবিক!’
শান্ত হও! হে বিয়ের অথিতি!
‘তাঁরা সেই সব আত্মা নয়, যারা পালিয়েছিলো যন্ত্রণায়,
যারা ফিরে এসেছিলো, তাঁরা ছিলো একটা আশীর্বাদ পুষ্ট আত্মার দলঃ

যখন ভোর আসলো — তাঁদের বাহু গুলো ঝুলে পড়লো,
তাঁরা গুচ্ছ বদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো মাস্তুলটা ঘিরেঃ
তাঁদের মুখ থেকে ধীরে একটা মিষ্টি শব্দ বেড়িয়ে আসলো,
এবং ছাড়িয়ে গেল তাঁদের শরীর থেকে।

প্রতিটা মিষ্টি শব্দ ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়াচ্ছিলো,
তারপর তীব্র বেগে ছোট দিল সূর্যের পানে;
শব্দটা ধীরে আবার ফিরে আসলো,
এখন একটা আরেকটার সাথে মিশে হয়ে গেলো একাকার।

মাঝে মাঝে আসমান থেকে একটা পতনের আওয়াজ,
শুনলাম ভরত পাখিটা গেয়ে উঠলো;
মাঝে মাঝে সবগুলো ছোট পাখি গুলো
কিভাবে ভরিয়ে তুলেছিলো সাগর আর বাতাসটা,
তাঁদের মিষ্টি কিচিরমিচিরে!

আর এখন মনে হচ্ছিলো এটা যেন বাদ্যযন্ত্র,
এখন যেন একটা একাকী বাঁশী;
আর এখন এটা যেন একটা পরীর কণ্ঠের গান,
যা স্বর্গ গুলোকেও নিস্তব্দ করে দেয়।

এটা থেমে গেলো; তবুও জাহাজ গুলো চলতে থাকলো,
একটা সুখকর আওয়াজ বেজেই যাচ্ছিলো বিকেল পর্যন্ত,
যেন একটা লুকানো ছোট নদী বয়ে চলছিলো কল কল ধ্বনিতে,
পত্র পল্লব জুন মাসে,
যেন ঘুমন্ত অরণ্যকে শোনাচ্ছিলো
একটা মিষ্টি নরম সুর।

বিকেল পর্যন্ত আমরা নীরবে জাহাজ চালিয়ে গেলাম,
তখনো পর্যন্ত কোন বাতাস একটা নিঃশ্বাসও ফেলেনি,
ধীরে আর স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যাচ্ছিলো জাহাজটা,
এগিয়ে যাচ্ছিলো নিম্নদেশ থেকে।

জাহাজের তলির নিচে নয় ফেদম গভীরে,
কুয়াশা আর তুষারের দেশ থেকে,
ঢুকেছিল আত্মাটাঃ এটা ছিলো সেই আত্মা
যে এগিয়ে নিচ্ছিলো জাহাজটা,
সবকটি পালের আওয়াজ থেমে গেল বিকেলে,
আর জাহাজটাও স্থির দাঁড়িয়ে রইলো।

মাস্তুলের উপরে ডানদিকটায় উঠা সূর্যটা,
ঠায় তাকিয়ে রইলো সাগরের পানেঃ
কিন্তু মিনিট খানেকের মধ্যে সে আবার নড়ে উঠলো
একটা ছোট্ট অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে—
সামনের দিকে আর পেছনের দিকে
একটা ছোট্ট অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে।

তারপর একটা অগ্রপদি ঘোড়ার মত,
সে হঠাৎ একটা লম্ফ দিয়ে উঠলোঃ
সে রক্ত নিক্ষেপ করলো আমার মাথায়,
এবং আমি নিচে পড়ে গেলাম অজ্ঞানের মত।

কত সময় ধরে আমি এভাবে পড়েছিলাম,
আমি বলতে পারবোনা,
কিন্তু তার আগেই আমার জীবন ফিরে আসলো,
আমি শুনলাম আর আত্মায় অনুভব করলাম,
বাতাসে দুইটা কণ্ঠের আওয়াজ।

‘এই কি সে?’ একটা কণ্ঠ বলে উঠলো, ‘এটাই কি সেই লোক?’
যার তীরের আঘাতে পাখিটা মরেছিলো,
তাঁর নিষ্ঠুর ধনুক সে তাক করেছিলো,
নিরীহ অ্যালবাট্রসের উপর।

যে আত্মা নিজেকে ধরে রেখেছিলো
কুয়াশা আর তুষারের দেশে,
সে পাখিটাকে ভালোবেসেছিলো যে পাখি ভালোবেসেছিলো তাঁকে
যে বিদ্ধ করেছিলো তাঁকে তাঁর ধনুকের তীরে।‘

অন্য কণ্ঠটা একটু নরম প্রকৃতির ছিলো,
ঠিক মধুর ফোটার মতই নরমঃ
সে বললো, “লোকটা অনেক শাস্তি পেয়েছে
এবং সে আরও শাস্তি পাবে।“

পঞ্চমাংশের সমাপ্তি (চলবে...)

তর্জমা
এপ্রিল, ২২, ২০১৬

প্রথমাংশ পড়ুন এখানে
দ্বিতীয়াংশ পড়ুন এখানে
তৃতীয় ও চতুর্থাংশ
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৮:৪০
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×