somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোলরিজের কবিতা: বুড়ো নাবিকের গান (ষষ্ঠাংশ)

২৪ শে মে, ২০১৬ রাত ৮:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাংলামেইলে প্রকাশিত প্রথমাংশ।। দ্বিতীয়াংশ।। তৃতীয়াংশ ও চতুর্থাংশ।। পঞ্চমাংশ

প্রথম কণ্ঠ
“কিন্তু বলো আমায়, বলো! কথা বলো,
আবারো আওয়াজ তোল তোমার ঐ নরম কণ্ঠে—
কিসের জোরে ছুটে চলেছে এই জাহাজ?
কি করছে এই সাগর?”

দ্বিতীয় কণ্ঠ
“এখনো সে কেবল ঈশ্বরের এক গোলাম মাত্র,
সাগরটার নিজস্ব কোন প্রবাহ নেই;
তাঁর উজ্জ্বল বড় চক্ষু, নীরবে
তাকিয়ে আছে মাথার উপরের চাঁদটার দিকে—

সে হয়তো জানতোই না কোন দিকে তাঁর গন্তব্য,
চাঁদটা তাঁকে পথ দেখাচ্ছে কোমলতায় অথবা নিষ্ঠুরতায়।
দেখো, ভাই, দেখো, কতটা উদারচিত্তে
সে চোখ ফেলেছে নিচে, তাঁর উপর।”

প্রথম কণ্ঠ
“কিন্তু জাহাজটা কিভাবে ছুটছে এমন গতিতে,
কোন বাতাস ছাড়াই, কোন ঢেউ ছাড়াই?”

দ্বিতীয় কণ্ঠ
“বাতাসটাকে কেটে আগেই ভাগ করা হয়েছে,
আর বেষ্টন করা হয়েছে পেছন থেকে।

উড়, ভাই, উড়াল দাও! উপরে, আরও উপরে!
নয়তো আমরা হয়ে পড়বো বিলম্বিতঃ
নাবিকের মোহটা কেটে গেলেই
শ্লথ হয়ে পড়বে জাহাজের গতি।”

আমি জেগে উঠলাম, দেখলাম তখনো আমরা এগুচ্ছি সামনের দিকে
যেন একটা শান্ত-সুন্দর আবহাওয়ায়ঃ
তখন ছিলো রাত, প্রশান্তির রাত, চাঁদটা দাঁড়িয়ে ছিলো উপরে;
মরা মানুষ গুলো সব দাঁড়িয়ে ছিলো একসাথে।

একসাথে সব দাঁড়িয়ে রইলো ডেকের উপর,
মরাদের অন্ধকূপের এক মিস্তিরির জন্যেঃ
আমার উপর দৃষ্টি ফেললো সবগুলো পাথুরে চক্ষু,
যে চোখে ঝিকঝিক করছিলো চাঁদের আলো।

মরণ কালের সেই তীব্র যন্ত্রণা আর অভিশাপ,
এক মুহূর্তের জন্যেও মুছে যায়নি তাঁদের চাহনি থেকেঃ
আমি চোখ সরাতে পারছিলাম না তাঁদের চক্ষু থেকে,
না পারছিলাম উপরের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করতে।

আর এখন তুলে নেয়া হলো সম্মোহনটা, আবারো একবার
আমি দেখলাম সবুজ সমুদ্রটা,
আর চোখ রাখলাম আরও দূরে, সামান্যই দেখতে পেলাম
যা কিছু দেখা হয়েছিলো আগে—

একটা নির্জন রাস্তায় একাকী একজনের মত
যে ভীত পায়ে হেঁটে বেড়ায় শঙ্কায়,
মাথাটা শুধু একবার ঘুরিয়েই সে হাঁটতে থাকে,
দ্বিতীয়বার আর সাহস করে না মাথা ঘুরাবার;
কারণ সে জানে, খুব নিকটে, পেছনেই
হেঁটে আসছে এক ভয়ঙ্কর বর্বর।

কিন্তু শিগ্রি একটা বাতাস এসে নিঃশ্বাস ফেললো আমার ঘাড়ে,
সৃষ্টি হলো না কোন শব্দ কিংবা স্পন্দনঃ
তাঁর পথ সমুদ্রে ছিলো না,
ছিলো তরঙ্গে কিংবা ছায়ায়।

বাতাসটা উস্কে দিলো আমার চুল, ছুঁয়ে গেলো আমার গণ্ডদেশ,
বসন্তের ঘাসের একটা ধমকা হাওয়ার মতন—
এটা অদ্ভুতভাবে মিশে গেলো আমার ভঁয়ে,
তবুও তাঁকে মনে হলো বরণীয়।

দ্রুত, ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে চললো জাহাজটা,
তবুও যেন সে আলতো ভাবেই ভেসে বেড়াচ্ছিলো জলের উপর,
বইছিলো সুরেলা, মিষ্টি মৃদু মন্দ বাতাস,
সে বয়ে চললো শুধুই আমার উপর।

ওহ! সত্যিই এটা আনন্দের স্বপ্ন!
উপরে কি আমি বাতিঘরটা দেখছি?
এটা কি পাহাড়টা? এটা কি গির্জাটা?
এই কি আমার নিজের দেশ?

আমরা ভাসতে ভাসতে চলে গেলাম পোতাশ্রয়ে,
আর আমি প্রার্থনা করলাম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে—
আমাকে জাগিয়ে তোল, হে ঈশ্বর!
কিংবা আমায় ঘুম পাড়িয়ে দাও চিরতরে।

পোতাশ্রয়ের পানিটা ছিলো কাঁচের মতই স্বচ্ছ,
সেটা বিছিয়ে ছিলো মসৃণতায়!
আর জলের উপর শুয়ে ছিলো জ্যোৎস্নাটা,
এবং চাঁদের ছায়াটা।

পাথর গুলো জ্বলজ্বল জ্বলছিলো, গির্জাটাও,
এটা দাঁড়িয়ে আছে পাথর গুলোর উপরেঃ
চাঁদের আলোটা ডুব দিলো নীরবতায়,
দৃঢ় দাঁড়িয়ে রইলো বায়ুনিশানটা।

নীরব আলোয় শুভ্র হয়ে উঠেছিলো সাগরটা,
একই জায়গা থেকে জেগে উঠছিলো,
অনেক গুলো পূর্ণ অবয়ব, আর ছায়া গুলোও
ভেসে উঠছিলো অগ্নিবর্ণে।

গলুই থেকে সামান্য একটু দূরেই
ছিলো সেই অগ্নিবর্ণের ছায়া গুলোঃ
আমি ঘুরে চোখ রাখলাম ডেকের উপর—
ওহ ঈশ্বর! সেখানে আমি কি দেখলাম!

প্রতিটা লাশ শুয়ে আছে চিত হয়ে, প্রাণহীন, নিথর,
আর পবিত্র ক্রুশের সাথে!
একটা নূরের অবয়ব, একটা দেবদূত!
দাঁড়িয়ে ছিলো প্রতিটা লাশের উপর।

এই যে দেবদূতের দল, প্রত্যেকেই নাড়ালো তাঁর হাতঃ
এটা ছিলো একটা স্বর্গীয় দৃশ্য!
সবাই যেন একেকটা সঙ্কেত, ভূমির দিকে,
যেন একেকটা জীবন্ত আলো;

এই যে দেবদূতের দল, প্রত্যেকেই নাড়ালো তাঁর হাতঃ
তাঁদের কণ্ঠ থেকে কোন আওয়াজ বেরুলো না,
আওয়াজহীন; কিন্তু ওহ! নীরবতাটা
সঙ্গীতের মতই ডুব দিলো আমার হৃদপিণ্ডে।

কিন্তু অচিরেই শুনতে পেলাম বৈঠার আওয়াজ,
শুনলাম পাইলটের হর্ষধ্বনি;
কেউ যেন জোরপূর্বক ঘুরিয়ে দিলো আমার মাথাটা,
এবং আমি দেখলাম একটা নৌকা।

পাইলট আর পাইলটের ছেলেরা,
শুনলাম তাঁরা দ্রুত এগিয়ে আসছেঃ
হে স্বর্গের প্রভু! কি আনন্দ
মরা গুলো ছুড়তে পারছিলো না কোন অভিশাপ।

আমি তৃতীয় আরেকজনকে দেখলাম — শুনতে পেলাম তাঁর গলার আওয়াজঃ
এটা তো সেই দরবেশ!
সে উচ্চস্বরে গেয়ে উঠলো তাঁর ঐশ্বরিক সুর
যে সুর বেঁধেছিলো সে জঙ্গলে।
আমার আত্মাকে সে পাপমুক্ত করবে, মুছে দিবে
অ্যালবাট্রসের রক্ত।

তর্জমা
মে, ২৪, ২০১৬
শরিফুল ইসলাম (শরীফ আজাদ)
মূল: দ্যা রাইম অব দ্যা অ্যানশিয়েন্ট মেরিনার— স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৬ রাত ১১:৩৫
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×