somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জ্ঞানীর অহংকার আর বিনয়ীর ভণ্ডামি

১৩ ই আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নিজেরে তুচ্ছ, নাখান্দা, ধইঞ্চা, ক্ষুদ্র আর অতি নগণ্য ভাবার জন্যে আমাদের সমাজ, অথোরিটি, শিক্ষাব্যবস্থা, আর প্রথা আমাদেরকে প্রতিনিয়ত পুশ করতে থাকে। সমাজের এই চাপ আর মহাবিশ্বের বিশালতা দেইখা একসময় আমরা মানতে বাধ্য হই যে আমরা প্রত্যেকেই আসলে অনেক ক্ষুদ্র। তাঁর উপরে ছোট বেলা থাইকা আমরা হরিশ্চন্দ্র মিত্রের একটা লাইন পড়তে পড়তে বাইড়া উঠি, “লোকে যাকে বড় বলে বড় সেই হয়”। এইটা একটা সাংঘাতিক লাইন। এই লাইনের যে অর্থ (পুরা ছড়াটার অর্থ অন্য রকম হইতেও পারে) আমাদের কাছে দাঁড়ায় তা হইলো, লোকে যা বলবে আমরা তাই। যতক্ষণ লোকে আপনারে বড় না বলবে ততক্ষণ আপনে ছোটই। অর্থাৎ লোকে ডিফাইন করবে আপনে কে। খুবই সাংঘাতিক ব্যাপার! আর সমাজের লোকেরা বড়ই দুষ্ট। সহজে কাউরে বড় বলে না, বরং আগ বাড়াইয়া গিয়া অন্যরে আরও ছোট কইরা আসে। এই লোকেরা শুধু তাঁরেই বড় বলে যে ইতিমধ্যে নিজের জোরে বড় হইয়াই আছে। এই অবস্থা যখন চলতে থাকে, আপনে যখন দেখেন যে আপনারে কেউই বড় বলতেছে না, তখন আপনে হতাশ হইয়া পড়েন। আপনার হতাশা দেইখা আরেকদল শিক্ষাবিদ আইসা আপনারে বলে যে, লোকের কথায় কান দিতে নাই। লোকে কি ভাবলো সেইটা ভাইবা সময় নষ্ট করা ঠিক না। এই কথা শোনার পর আপনার ভিতরে এক ধরণের আত্মবিশ্বাস জন্মাইতে পারে। যদি জন্মায়ও, তখন আপনার আবার হরিশ্চন্দ্রের সেই লাইনের কথাও মনে পইড়া যায়। সৃষ্টি হয় একটা জটিলতা। আপনে নিজেরে ছোটও ভাবতে চান না, আবার অহংকারীও হইতে চান না। তখন আপনে যেই জিনিসের আশ্রয় নেন, সেইটা হইল বিনয়। আপনে বিনয়ী হইয়া মুখে বলেন যে আপনে ক্ষুদ্র, কিন্তু মনে মনে মোটেও নিজেরে ক্ষুদ্র ভাবেন না। এই বিনয় হইল ভণ্ডামি, হিপক্রেসি। নিজের সাথে নিজের ভণ্ডামি, মনের কথা উল্টা কইরা প্রকাশ করার ভণ্ডামি।

বিনয় যদি ভণ্ডামি হয়, অহংকার কি তাইলে সততা? উত্তর হইল, হ্যাঁ, ‘বিশুদ্ধ অহংকার’ অবশ্যই সততা। বিশুদ্ধ অহংকার জিনিসটা আবার কি? সেইটা হইলো নিজেরে পরিপূর্ণভাবে জানার অহংকার এবং সেই উপলব্ধিরে আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রকাশ করার অহংকার। এই অহংকার নজরুল প্রকাশ কইরা গেছে তাঁর বিদ্রোহী কবিতায়, “আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!” নজরুলের এই সহসা নিজেরে চেনার ফলে তাঁর যেই সাহস আর অহংকারের সঞ্চয় হইছে সেইটা তাঁরে খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদন কইরা উপরে উঠতে উৎসাহিত করছে। এই অহংকার প্রকাশ কইরা গেছেন জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিটশে। উনি জানতেন যে উনি জ্ঞানী। এবং এইটা উনি ফলাও কইরা প্রকাশ কইরা গেছেন। এমনকি উনি একটা বইও লেইখা গেছেন যার নাম, “আমি কেন এত জ্ঞানী”। এই অহংকার দেখাইয়া গেছেন দার্শনিক সক্রেটিস। তিনি বলছিলেন, “আমি জানি যে আমি কিছুই জানি না।” উনার এই কথাটারে আমাদের কাছে বিনয় বইলা ভ্রম হয়। কিন্তু এইটা আসলে কোন বিনয় না। এইটা হইলো প্যারাডক্স। এইখানে সক্রেটিস বলে নাই যে সে কিছুই জানে না, বরং বলছে যে সে জানে যে সে কি জানে না। আর এইটারেই বলে জ্ঞান। একজন জ্ঞানী আর মূর্খের মধ্যে পার্থক্য হইল, মূর্খ জানে না যে সে জানে না, আর জ্ঞানী জানে সে কি জানে আর কি জানে না। এখন কথা হইল, আপনে তো নজরুল, সক্রেটিস এর মত দার্শনিক অথবা কবি না, তাইলে আপনে কি নিয়া অহংকার দেখাইবেন। আপনে অহংকার দেখাইবেন আপনার অস্তিত্ব নিয়া। আপনার নিজের জ্ঞান নিয়া। আপনে মোটেও ক্ষুদ্র না। আপনে এই মহাবিশ্বের মালিক। আপনে সংবিধানের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কেবল বাংলাদেশেরই মালিক না। আপনে প্রকৃতিগত ভাবেই পুরা মহাবিশ্বের মালিক। আপনার এই মালিকানা কেউ আপনারে দিতেও পারবো না, আবার আপনার কাছ থাইকা কেউ কাইড়াও নিতে পারবো না।

তাইলে কিছু মানুষরে যে বিচ্ছিরি অহংকার দেখাইতে দেখা যায়? অহংকারে যাদের পাও মাটিতে পড়ে না, আশেপাশের মানুষরে যারা মানুষই মনে করে না, এইটারে কি বলা যায়? তাঁদের এই অহংকার আসলে বিশুদ্ধ না, ভেজাল। এরা ছ্যাবলা অহংকারী। এরা জানেই না এরা নিজেরা আসলে কি। এরা নিজের সম্পর্কে যতটুকু জানে সেইটা খুবই অল্প। তাঁদের এই নিজের সম্পর্কে জ্ঞানের স্বল্পতা তাঁদের মনে একটা সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স তৈরি করে। সেইখান থেকে তাঁরা নিজেরে ডিফেন্স করার জন্যে অন্যরে ছোট কইরা, নিজেরে বড় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার একটা হাস্যকর চেষ্টা চালায়। এরা ছ্যাবলামি করে। এই ভেজাল অহংকার খারাপ, বড়ই খারাপ।

মূল কথা হইলো, আপনার নিজেরে ছোট মনে করার কোন কারণ নাই। আবার নিজেরে অপরের চাইতে বড় মনে করারও কোন কারণ নাই। আপনে যদি এই মহাবিশ্বের মালিক হন, তাইলে বাকী সবাইও আপনার মতই মালিক। তো আপনে কারে আপনার চাইতে ছোট ভাববেন? আর কাউরে আপনার চাইতে ছোট না ভাবাটাই হইলো ‘বিশুদ্ধ বিনয়’। আপনার বিশালতা নিয়া সুফি কবি জালাল উদ্দিন রুমিও কথা বইলা গেছেন, তিনি বলছেন, “আপনে বিশাল এক মহাসমুদ্রে শুধুই এক ফোঁটা জল নন। আপনে এক ফোঁটা জলে একটা আস্ত সমুদ্র।” এখন রুমি বইলা গেছে, অথবা আমি বলতেছি আপনে বিশাল, এইজন্যে আপনে বিশাল না। কেউ কখনো কোন দিন আপনারে এই কথা না বললেও আপনি বিশালই, আর এইটা প্রকাশ করাটা যদি অহংকার হয়, তাইলে সেই অহংকারেই আপনে হাসিমুখে অহংকারী হইতে পারেন।

অগাস্ট ১২, ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৯
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×