চারটি অনুগল্প
ঝাড়ুদার
মদের পেয়ালার পুরো মদটুকু গিলে ফেলে দুচোখ বন্ধ করে মাথাটা এক ঝাঁকি মারলো রানী।
রাজদরবারে আসা মদগুলো খুব উন্নতমানের হয়- বলল উজির।
হ্যাঁ, এটাই রাজার একমাত্র সার্থকতা। কিন্তু রাজাকে মরতে হলো শুধু আমাকে অতিমাত্রায় ভালোবাসার দরুন। অপর দিকে আপনাকে ভালোবাসলাম রাজাকে অতিমাত্রায় ঘৃণা করেন বলে- বলেই বিশাল আওয়াজ করে হেসে উঠলেন রানী সেরেনা। শব্দটা দ্রুত পাখায় উড়ে গেলো রঙ্গশালা পেরিয়ে উঠোনে, উঠোন ডিঙিয়ে বাউন্ডারি ছেড়ে সারারাজ্যময় যেন হাত ফসকে সিসার থাল মেঝেতে পড়ার আওয়াজে নড়ে উঠলো। কানে পৌঁছলো ঝাড়ুদার মিসস্যুর বাড়ির খাছায় বন্দি তোতাপাখিরও।পাখিটি এদিকসেদিক তাকিয়ে খুঁজে পেলো, রাজবাড়ি থেকেই এসেছে এই ধ্বংসনীয় ধ্বনি।
মিসস্যু সারারাজবাড়ি ঝাড়ু দেওয়া শেষে নিজ বাড়ি ফিরলো, গায়ে ঘামের গন্ধ।পাখিটি সেই গন্ধ পেয়েই ডাকাডাকি শুরু করলো। মিসস্যু পাখির পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই জিজ্ঞাস করলো পাখি, এই আকারহীন শব্দের কারণ কী হে?
মিসস্যুর নির্লিপ্ত জবাব, কোথায় শব্দ? ঝাড়ুর শব্দের কথা বলছো নাকি?
না, শব্দটি রাজবাড়ি থেকে আসা।তুমি তো সেখানেই কাজ করছিলে।- তোতাপাখি বলল।
আমি তো ঝাড়ু দিচ্ছিলাম। ঝাড়ুর শব্দে আমি আর পৃথিবীর কিছুই শুনতে পাইনা।- ঝাড়ুদার মিসস্যুর ক্লান্ত কন্ঠের জবাব।
২৭-৪-১৬
ঝাড়ুদার - ২
রাজার মৃত্যুর পর অনতিবিলম্বে প্রমাণিত হলো,এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়।কিভাবে মৃত্যু ঘটেছে, তার উপর অসংখ্য ধারনা সৃষ্টি হয়েছে। ধারনা থেকে কেচ্ছা, গল্প, আখ্যান, শোকগাথা, শোকগীতিসহ আরো কতকিছু। প্রত্যকটি ধারনাই ভিন্ন, একটার সাথে অন্যটার কোনোভাবে মিল নেই; প্রত্যেকটিই সত্য এবং যুক্তিসংগত মনে হয়।
এসব ধারনাসমস্ত পুথিবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারে স্থান পেয়েছে, রাজঅতিথিরা এসে নীরবে পড়ে।কিন্তু কেউই মূল রহস্য জানতে পারেনি।এরইমধ্যে যত আইনজ্ঞ রানীর অন্দরমহলে প্রবেশ করেছেন, সবাই প্রগাঢ়ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছেন, কারো আর ঘুম ভাঙার নজির নেই।
রানীও প্রতিপ্রভাতে বারান্দায় তার অন্তর্বাস রোদে শুকাতে দিলে সূর্য সব জল শুষে নেন; কোথায় এই জল নিয়ে ঢালে তা জানেনা কেউ।
রাজা যে ধারালো কোনো বস্তুর আঘাত পেয়ে বা নিয়ে মরেছে তা নিশ্চিত, তাই রাজবাড়িতে ধারালো বস্তু নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মিসস্যুর ঝাড়ুটাও এই আইনে কাটা পড়ল ; ঝাড়ুর অগ্রভাগ বেশ ধারালো বলে বিবেচিত হয়েছে।ঝাড়ু নিষিদ্ধ রাজবাড়িতে।
ঝাড়ু নেই,ঝাড়ু দেওয়ার কাজও নেই,তাই খাবারও নেই- থুতনির নিচে হাতের ঠেস দিয়ে বসে তোতাপাখিকে বলছে মিসস্যু।
তোতাও বেশ চিন্তিত কন্ঠে জবাব দিলো -তোমার মেয়ে রাজার মৃত্যুর কাহিনী পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে, সে আর জাগবে না।
১-৫-১৬
ঝাড়ুদার -৩
অর্ধমৃত অথবা মৃতঅবস্থায় ঝাড়ুদার মিসস্যুর দেহটি পড়েছিলো রাজবাড়ির সামনে। সাঝসকালে রানীর উষ্ণ অন্দরমহলে এই সংবাদ যেতেই উজিরের ক্ষিপ্র আদেশ, ফেলে এসো এই অযথা প্রাণীটিকে কররস্থানে। শেয়ালে খাবলে খাক।
আদেশ করে রানীকে জড়িয়ে অলস তন্দ্রায় রত হলেন উজির।
মিসস্যুর শব কবরস্থানে ফেলতেই তরতাজা সকালটা দপ করে নিভে গেলো, চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন।সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে বাঁচতে চাইলো; কিন্তু দেখলো, তাদের শরীর বোধশক্তিহীন,যেন মোটা শিকলে বাঁধা প্রতিটি অঙ্গ- নড়তে পারছিলো না কেউ। তারা দেখলো অন্ধকার সকালের করবস্থানে, একটি উজ্জ্বল আলোর বল লাফিয়ে গিয়ে মিসস্যুর শরীরে গেঁথে গেলো, শবটির সারাশরীর তখন আগুনে পোড়া লোহার মত জ্বলে উঠলো। তারপর একজন পরিপূর্ণ সুস্থ মানুষ দাঁড়িয়ে গেলো। ধীরেসুস্থে হেটে সৈণ্যদের কাছে গেলো, এবং প্রায়দৈবকন্ঠে বলে উঠলো -আমি রাজা ডিসুজা,ফিরে এলাম আপনাদের মাঝে। মিস্টার আলেক্স,আপনি তো দিগ্বিজয়ী বীর। এভাবে কাঁপছেন কেনো? কতবার অস্ত্রপরীক্ষায় আপনি আমায় হারিয়েছেন।প্রিয়ো সৈনিকগন, আপনাদের সাহসী তলোয়ারের ধারে কলাগাছের মত ফালিফালি হয়েছে আমার শত্রুসেনারা। আজ সেই আপনারাই সামান্য অতিপ্রাকৃত ঘটনায় কাঁপছেন?
সসৈন্য রাজ্যে ফিরে রাজা ডিসুজা, মৃত্যুদণ্ড দিলেন রানী সেরেনা, উজির সহ আরো বেশ কয়েকজনকে, যারা রাজার খুব নিকটজন ছিলেন; তারাই রাজাকে হত্যা করেছিলেন।
সবকিছু আবার আগের মত চলতে লাগলো। রাজ্যে আবার ঝাড়ু দেওয়ার আদেশ হলো। সকল ঝাড়ুদার নিজকাজে লেগে গেলো। কোত্থাও মিসস্যুকে দেখতে পেলো না রাজা। কিন্তু রাজার যে মিসস্যুকেই প্রয়োজন।
মিসস্যু তার ঝাড়ুর ঘ্যারঘ্যার আওয়াজের সুরেই বানিয়েছিল মৃত্যুর পরও বেঁচে উঠার মন্ত্র ;যা রাজাকে পূনঃরায় জীবিত করেছে।রাজাকে মুখস্থ করিয়েছিল, সেই মন্ত্র রাজা ভুলে গেছে।
২-৫-১৬
সাবান
গোসলে যাবো তাই সাবান খুঁজছি,আর ভাবছি- দুনিয়াতে নাস্তিকতা বেড়েই চলছে, অতি ভয়ংকর গতিতেই বাড়ছে।আমার ফ্লাটের আঠারো প্রাণীর মধ্যে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের ষোলোজনই অবিশ্বাসী। বাড়ির দারোয়ানটি মালোয়ারী ভাষা ছাড়া আর কিছুই জানেনা, তবু জানে ধর্মকর্ম করা বোকামি আর কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণ প্রাকৃতিক কারণেই জন্মেছে, শেয়াল কুকুর শেওলা পাহাড় কিংবা মানুষ। মানুষের যা জ্ঞানবুদ্ধি কিছু ভালো হাতি শিম্পাঞ্জীদের চেয়ে ।
সাবান খুঁজতে খুঁজতে ভাবছি, এতো এতো নাস্তিক , তাদের তো একটা স্ট্যান্ডার্ড পলিসি দরকার, যাতে কোনো নাস্তিক ভিন্নপথে না হেটে যায়, তাহলে কি নতুন আরেকটি ধর্ম তৈরী হবে শীঘ্রই!নাস্তিক ধর্ম!
সাবানটা খুঁজেই পাচ্ছিনা, রুম অন্ধকার, যেখানে সাবান থাকে, সেখানে ফেসওয়াস শেম্পু, টুথপেস্টসহ অনেককিছুই রাখা জড়ো করে। অন্ধের মত সাবান হাতে নিতে চাচ্ছি হাতে আসছে কখনো ফেসওয়াসের টিউব, কখনো টুথপেস্ট, সাবানটাই শুধু হাতে আসতে চাচ্ছে না। ঈশ্বরই বুঝি সাবানটা না দিয়ে অন্যকিছু দিয়ে আমার সাথে অন্যায় করছে। আমার সাথে এমনই করে ঈশ্বর।
শরীরে রাগ জমে লাল হয়ে উঠেছে। চূড়ান্ত জেদে বাঁ হাতে যা ছিলো পূর্ণ শক্তিতে ছুড়ে মেরেছি।হাত থেকে সাবানটি তীরের গতিতে ছয় তলার বারান্দা গলে রাস্তায় চিতপটাং।
আমি চেয়ে চেয়ে দেখছি, ধর্মই বারান্দা গলে পড়ে গেছে রাস্তায়।
২৮-৪-১৬
লেখকঃ পাভেল আল ইমরান
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১৬ সকাল ৯:৩৬