somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অব্যাখ্যায়

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি তখন ভার্সিটির জন্য ভর্তি
কোচিং করছি। প্যারাগন এর
ফার্মগেট শাখায়। থাকতাম বড়চাচার
বাসায়। নারিন্দায়।
সপ্তাহে চারদিন
দুইঘণ্টা জার্নি করে ক্লাস
করতে যেতাম। আর বাকি সময়টুকু
খালি পড়াশোনা!

সেদিন শুক্রবার। ঢাকার রাস্তা একদম ফাঁকা ।ক্লাস শেষে সদরঘাটগামী বাসে উঠে বসেছি, বলতে গেলে পুরো বাসই খালি। প্রতি শুক্রবারের মত; প্রায় উড়তে উড়তে চলে এলাম। রায়সাহেব বাজার নেমে কিছুটা স্বস্থি, রিকশা একটা পেয়ে গেছি। রিকশা চলছে; আর আমি দেখতে দেখতে যাচ্ছি। এই এলাকায় দারুন একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম আমি। একই রাস্তায় একটা চার্চ; একটা মন্দির আর একটা মসজিদ আছে। দেখতে দেখতে কীভাবে পথ ফুরালো খেয়ালই নেই।

বাসায় পৌঁছে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হতে ঢুকলাম ওয়াশ রুমে- পড়তে বসতে হবে। রাতে ভূত এফ এম আছে। ওটা কিছুতেই মিস করা যাবে না ! ভুত এফ এমের জন্যই হয়তো লেকচার শিট শেষ করতে বেশি সময় লাগেনি।

রাতে ডাইনিং রুমের টেবিলে বসে অংক করছি; আর ভূত এফএম শুরু হওয়ার তর সইছে না। বারোটা বাজতেই কানে ইয়ারফোন গুজে নিলাম।ওই পর্বের ঘটনা গুলো বেশ ভয়ঙ্কর ছিলো । পুরো বাসা শুনশান নীরব হয়ে গেলেও, চাচী আর চাচাতো বোন দুইটাও যে এফএম শুনছে- জানি। কাজেই তেমন ভয় পেলাম না। এমনিতেও আমি বেশ সাহসী মেয়ে!

ওইদিনের ভূত এফএম এ সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ছিলো শেষের ঘটনাটি। ঠিক কেনো ভয়ঙ্কর লেগেছিল- বলতে পারবো না। আসলে যিনি বলছিলেন; তার বলার ভঙ্গীটা এতো দারুন ছিলো যে- আমার মনে হচ্ছিল , ঘটনাটি আমার সাথেই ঘটেছে! আমার চোখের সামনে দৃশ্য গুলো ভাসতে লাগলো।
আরো মজার ব্যাপার হলো , পুরো কাহিনীটা ওয়ারীর একটি পরিত্যক্ত বাড়ি নিয়ে!
তবে লোকটি যদি বানিয়ে বলে থাকে; তাহলে বলতে হবে , সে তিন গোয়েন্দার টেরর ক্যাসল থেকে কিছু কাহিনী ধার করেছে!

ভূত এফএম শেষ হতেই পন্নি আপু ওর রুম থেকে বের হলো। এফএম শেষ হয়ে গেলেও ভয়ের রেশটা রয়ে গেছিল তখনো। বইয়ের দিয়ে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবে ছিলাম। আপুকে খেয়ালই করিনি। ও আমার পাশে এসে দাড়াতেই ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম !
আপু একটু হেসে বলল; "ভয় পেয়েছিস?" মাথা নাড়ালাম আমি। জিজ্ঞেস করলাম; "ভূত এফএম শুনেছো?"
"শুনেছি।" মাথা ঝাকালো ও
বললাম;
"শেষ ঘটনাটি কিন্তু তোমাদের ওয়ারিতেই। বাড়িটা সম্পর্কে জানো নাকি? "
"জানি না। তবে খবর নিতে পারব।"
দুষ্টুমি মাখা গলায় বলল; "কেন? যাওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি?"
বললাম , "আছে।"
আপু বলল; "আচ্ছা , আমি খবর নিচ্ছি। রাত আড়াইটা বাজে; ঘুমাতে যা। সকালেই আবার উঠতে হবে তোর্।"
আমিও মাথা কাত করে সায় জানিয়ে লক্ষী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন যথারীতি ক্লাস শেষে বাসায় ফিরছি। রাস্তায় এত জ্যাম যে গুলিস্তানেই আধা ঘন্টা জ্যামে বসে থাকতে হয়েছে । পিপড়ের গতিতে বাস এগুচ্ছে । নয়াবাজার মোড় পার হওয়ার আগেই মাগরিবের আজান দিয়ে দিলো। বিরক্ত হয়ে বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম। রায়সাহেব মোড়ে এসে কোন রিকশা পেলাম না। হাঁটতে হাঁটতে টিপু সুলতান রোডে এসে দেখি; এইখানেও বিশাল রিকশা জ্যাম। রিকশা না নিয়ে ভালো ই করেছি! চাচা একদিন রায়সাহেব বাজার থেকে বাসায় যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিল। একটা চিপাগলি। তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়ার জন্য আমি ওই চিপা গলি দিয়ে ঢুকে গেলাম।

মাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। আবছা আলোয় হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে না। অযথাই গা ছমছম করে উঠল। হয়তো গলিটা একদম নীরব বলেই এমন লাগছে। কিছুদূর গিয়ে একটা তিন রাস্তার মোড়ে এসে আমি খেই হারিয়ে ফেললাম- কোন দিক দিয়ে যেতে হবে! আসলে মাত্র একবার এসেছি এই রাস্তা দিয়ে। একটা মানুষও নেই ধারেকাছে । হয়তো নামাজ পড়তে গেছে। রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে চারপাশে তাকালাম। তখনই বাড়িটা চোখে পড়লো।

আগের আমলের একতলা বাড়ি।একটা উচুঁ প্লাটফর্মের উপরে দাড়িয়ে আছে- পুরোনো চেহারার অভিজাত বাড়িটি। কয়েক ধাপ সিড়িও আছে। বিশাল কাঠের দরজাটা যৌলুশ হারিয়েছে কালের বিবর্তনে। জায়গায় জায়গায় আইভি লতা। কেনো যেন মনে হলো বাড়িটা আমার পরিচিত! কেমন অস্বস্তি অস্বস্তি লাগছে! অনেক করেও মনে করতে পারলাম না- কবে দেখেছি এই বাড়ি!

চকিতে মনে পড়লো; ভূত এফএম এ গত কাল যে বাড়িটার কথা বলা হয়েছে; এটা সেই বাড়ি নয়তো? লোকটি বাড়িটার দরজার যে নকশার বর্ণনা দিয়েছিল; তা এই বাড়ির দরজার সাথে পুরোপুরি মিলে গেছে! কি মনে হতে আমি সিড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলাম! অস্বস্তিবোধ টা বাড়ছে।
দরজায় আলতো করে ধাক্কা দিতেই হাট করে খুলে গেল ওটা!
ভিতরে কালিগোলা অন্ধকার!

ঢুকবো কি ঢুকবো না দোটানায় ভুগলাম কিছুক্ষণ। ভীতু আমি নই। কিন্তু একা একা ঢোকা সমীচীন হবে বলে মনে হলো না। ভূত প্রেতের ভয় না থাকুক; দুষ্টু ছেলেপেলের আড্ডাখানা ও হতে পারে এই বাড়ি। তাছাড়া আমার কাছে টর্চ ও নেই। মোবাইলের ক্ষীণকায় আলোর ভরসায় এত বড় ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। এক পা দুপা করে সরে এলাম বাড়ির সামনে থেকে। অস্বস্তিবোধটা তখনো কাজ করছে। তিন রাস্তার মোড়টায় এসে তান্নি আপুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে নিলাম; কোন রাস্তায় যেতে হবে আমাকে। প্রায় উড়ে চলে এলাম বাসায়। একসাথে তিনচারটে করে সিড়ি টপকে হাঁফাতে হাঁফাতে চারতলা বাসায় উঠলাম। উত্তেজনা আর পরিশ্রমে দরদর করে ঘামছি। পন্নি আপু আমাকে এইভাবে ঘামতে দেখে বলল; "কীরে? ভূত দেখে আসলি নাকি? এত দেরী কেন আজ?"
কোন জবাব না দিয়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লাম। পন্নি আপু মাথায় হাত রেখে বলল; " শরীর খারাপ?"
পাশের রুম থেকে তান্নি আপু আর আকিব ভাইয়ার হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মাথা নাড়লাম আমি। পন্নি আপুকে বললাম; "আকিব ভাইয়া বাসায়?"
ও মাথা ঝাকালো।
"এসো , কথা আছে" বলে তান্নি আপুর রুমের দিকে হাঁটা ধরলাম।
তান্নি আপু আমাকে দেখে বলল; " রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলি?"
"রাস্তা হারিয়ে দারুণ একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি!"
"কী আবিষ্কার করলি?" তিন জোড়া চোখ উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
বুঝতে পারছি না; ওরা ব্যাপারটাকে কিভাবে নেবে।
বললাম , "কাল রাতে ভূত এফএম এ ওয়ারীর যে বাড়িটার কথা বলা হয়েছে; সম্ভবত: ওটা আমি খুঁজে পেয়েছি! " বোমা ফাটালাম আমি!
"কি বলিস!"
তিনজনেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো।
"আস্তে!" ফিসফিস করে বললাম আমি। "আম্মু জানতে পারলে বের হতেই দিবে না!"

মা মারা যাওয়ার পর বড় চাচীকেই আম্মু বলে ডাকি আমি। এই মমতাময়ী মহিলা মায়ের মতোই যত্ন করে আমার। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলেন- তার নাকি তিন মেয়ে!
"আচ্ছা! সবাই আস্তে কথা বলো!" ফিসফিস করেই জবাব দিল আকিব ভাইয়া। আমার উত্তেজনা ওর মধ্যে ও সংক্রমিত হয়েছে।
" এখান থেকে কত দূরে?" পন্নি আপু জানতে চাইলো।
"বেশি দূরে না। টিপু সুলতান রোডের ধারে কাছেই।" ওর দিকে তাকিয়ে জবাব দিলাম।
এইপর্যন্ত একটা কথাও বলেনি তান্নি আপু। বলল; "আমরা তিনটা মেয়ে! আর একটা ছেলে! কাউকে না জানিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? রিস্ক হয়ে যায় না? যদি কোন বিপদ হয়?"
" ভীতুর ডিম! এখনই ভয় পেয়ে গেলি?" সঙ্গে সঙ্গেই তান্নি আপুকে খোঁচা দিয়ে ফেলল আকিব ভাইয়া। তান্নি -পন্নি আপুর মামাতো ভাই ও। পিঠাপিঠির হওয়ায় সারাদিন তান্নি আপুর পিছনে লেগেই থাকে। তান্নি আপুও কোন অংশে কম যায় না। বলল, "আমি নিজের জন্য ভাবছি নাকি! আমি ভাবছি মৌএর কথা! পিচ্চি মেয়ে! ওর যদি কিছু হয়, আম্মু আমাকে মেরেই ফেলবে! তারচেয়ে আমরা বড়রা যাই। গিয়ে যদি দেখি ভয়ের কিছু নেই তখন ওকে নিয়ে যাওয়া যাবে। তোরা কি বলিস?"
"আমি মোটেও পিচ্চি মেয়ে নই!" সাথে সাথে প্রতিবাদ জানাই আমি। "তাছাড়া তোমরা যদি আমাকে না নাও , তাহলে আমি তোমাদের বাড়িটা দেখাবো না!"
"তুমি না দেখালেও প্রব্লেম নেই বাছা! আমরা ওটা খুঁজে নিতে পারবো।" মুচকি হেসে পন্নি আপু উত্তর দিলো।
"ওকেই! তাহলে আমি একা একাই যাব!" মরিয়া হয়ে হুমকি দিলাম ওদের। যদিও জানি; ওরা যদি না চায় আমি ওই বাড়িতে কিছুতেই যেতে পারব না। আম্মুকে একবার বলে দিলেই আমার জারিজুরি খতম!
অবাক দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকালো তান্নি আপু। মুখে না বললেও ওকে আমি বেশ ভয় পাই। ও না বলে দিলে আমার আর ওই বাড়িতে যাওয়া হবে না। আমার চেহারায় যাওয়ার প্রচন্ড আকুতি দেখেই বোধহয় মায়া হলো ওর্। বলল; "থাক। চলুক ও আমাদের সাথে। কিছু হলে আমরা তো আছিই। তাছাড়া এই রাতের বেলা বাড়িটা খুঁজতে যাওয়াটাও কম ঝক্কির ব্যাপার নয়। আর আমার পক্ষে কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব নয়!"
আমার মতো তান্নি আপুও উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছে না!

আমরা সবাই ব্যাগে করে টর্চ , দিয়াশলাই আর দড়ি নিয়ে নিলাম। কী মনে হতে রান্নাঘর থেকে একটা মোমবাতি আর একটা কিচেন নাইফও নিলাম। আম্মুকে বললাম; বাইরে খেতে যাচ্ছি। আম্মুও কিছু বললেন না। আমরা প্রায়ই বাইরে খেতে যাই।

হেঁটে হেঁটেই আমরা চারজন সেই তিন রাস্তার মোড়ে এসে গেলাম। আসার সময় কেউ একটা কথাও বলেনি। জায়গাটা বড় বেশি নির্জন। ওই বাড়িটার আশেপাশে তেমন কোন বাড়ি নেই। আছে কয়েকটা ওয়ার্কশপ। রাত হওয়ায় ওগুলো ও বন্ধ হয়ে গেছে। আকিব ভাইয়া টর্চের আলো ফেলে চারপাশটা দেখে নিচ্ছে । তারপর একধাপ একধাপ করে সিড়ি ভেঙ্গে বেদিটার উপরে গিয়ে দাড়ালো। আমরা তাকে অনুসরণ করলাম। দরজাটা হাট করে খোলা। আমি যেমনটা রেখে গেছিলাম ঠিক তেমনই আছে। আমি ভেবেছিলাম; অবশ্যই দরজাটা আটকানো থাকবে এবং আমাদের সেই দরজা খুলতে খুব বেগ পোহাতে হবে! ওইরকম কিছুই না। খুব ধীরে ধীরে একপা দুপা করে ভিতরে ঢুকলাম আমরা।

টর্চ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখছি । একটা হলরুমে এসে ঢুকেছি আমরা। কোন আসবাব নেই রুমে। অনেক বালি আর মাকড়শার ঝুল। খুব স্বাভাবিক। পুরনো একটা পরিত্যক্ত বাড়ি খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে , এটা আশা করাটাও বোকামি। সত্যি বলতে এখন পর্যন্ত অস্বাভাবিক কিছু দেখিনি বাড়িটায়। শুধু ………
শুধু ওই অস্বস্তিবোধটা ছাড়া। বাড়িটার কাছাকাছি আসার পর পর ই ওটা ফিরে এসেছে আবার। সবার মুখের দিকে তাকালাম একবার করে। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে না, অস্বস্তিবোধটা ওদের হচ্ছে নাকি হচ্ছে না!

টর্চটা ঘুরিয়ে ডানদিকে আলো ফেললাম। একধারে একটা দরজা দেখা যাচ্ছে । কোন রুমের হবে হয়তো। কেনো জানি রুমের ভিতরে দেখতে ইচ্ছে হলো। হয়তো অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েছে। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। রুমের ভিতরে পা রাখার আগে পিছনে ফিরে তাকালাম একবার। একেকজন একেক দিকে যাচ্ছে। ঘাড় ফিরিয়ে পা বাড়ালাম। এবং তখনই বিপত্তি টা ঘটলো। কিসের সাথে হোচট খেয়ে যেন পড়ে গেলাম। মাথাটা ঠুস করে ঠুকে গেলো মেঝের সাথে। এবং সাথে সাথেই জ্ঞান হারালাম।

কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলো বলতে পারবো না। কথোপকথনের শব্দে সম্ভবত। চোখ মেলে দেখলাম মেঝেতে চাটাই বিছানো। কুপির আলোয় দুজন মানুষের অবয়ব দেখতে পেলাম। একজন মাঝবয়সী মহিলা একজন বৃদ্ধ মহিলা কে খাবার বেড়ে দিচ্ছে । দুজনের কারোর চেহারাই দেখতে পাচ্ছি না। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হলো না তারা কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছে। খাওয়া শেষ হতে বৃদ্ধ মহিলা একদিকে চলে গেলেন। অন্ধকারে ঠিক বুঝলাম না; তিনি কোনদিকে গেলেন। ওইপাশ দিয়ে আরেক টা দরজা আছে নিশ্চয়ই।
আর মাঝবয়সী মহিলা বিছানা ঝেড়ে শুয়ে পড়লেন। মহিলার চলাফেরাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল; উনি সন্তানসম্ভবা। অতি সাবধানে নড়াচড়া করছিলেন তিনি।

আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম। প্রচন্ড অবাক হয়ে লক্ষ করলাম , আমি নড়তে পারছি না! কথা বলার চেষ্টা করলাম , মুখ দিয়ে একটা শব্দ ও বেরুলো না। ভয় পেয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি মাঝবয়সী সেই মহিলা ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। ওনার পায়ের কাছে একটা জানালা আছে। আমি অতি আতঙ্কিত হয়ে গেলাম! যখন দেখলাম , অস্বাভাবিক বড় আকৃতির একজোড়া চোখ জ্বলজ্বলে হিংস্র দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে! আমার দিকে নয় , ঘুমন্ত ওই মাঝবয়সী মহিলাটির দিকে। চোখজোড়া ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আমি। মনে হচ্ছে চোখজোড়া শূন্যে ভেসে আছে! জ্বলজ্বলে চোখজোড়া এতোই ভয়াবহ যে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। তারপরও যেন ভয়ঙ্কর চোখজোড়া ভাসতে থাকলো আমার সামনে। কেমন যেন লোভাতুর একটা হিংস্র দৃষ্টি!

বেশিক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকতে পারলাম না। কৌতুহলের কাছে ভয়ের পরাজয় হলো। ধীরে ধীরে চোখ মেললাম। একরাশ অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখলাম না।
না কোন ভয়ঙ্কর চোখ।
না কোন মানুষ।


হঠাৎ করেই নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ফিকে হতে থাকলো। ফ্যাকাসে আলোয় আবার দুজন মানুষের অবয়ব দেখলাম। সেই বৃদ্ধ মহিলা আর মাঝবয়সী মহিলা টি। মাঝবয়সী মহিলাটি মাথায় ঘোমটা দিয়ে কাঁদছে। আর বৃদ্ধা তাকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন আর নিজের ভাগ্য কে দোষারোপ করছেন। সম্ভবত মাঝবয়সী মহিলার পেটের বাচ্চাটা মরে গেছে। আর উনারা দুজন সম্ভবত বৌ -শ্বাশুড়ী।

কান্নার দমকে মহিলার মাথার ঘোমটা খসে পড়েছে। মহিলার চেহারার দিকে চোখ পড়তেই যেন বৈদ্যুতিকশক খেলাম আমি! এই চেহারা তো আমার অতি পরিচিত! কতবার বাবার মাইর খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরেছি তাকে!
কতবার স্কুল থেকে ফিরেই ব্যাগটা কাঁধ থেকে ফেলে ঝাপিয়ে পড়েছি তার কোলে! কতবার না খেয়ে জানালা দিয়ে দুধ ফেলে দেওয়ার অজুহাতে কানমলা খেয়েছি!
এই চেহারা কীকরে ভুলি আমি!

শেষ দেখেছিলাম পাঁচ বছর আগে। যখন হসপিটাল থেকে স্টীলের খাটে করে প্রাণহীন দেহটা আনা হয়েছিল - তখন।
আমার মা!
চিৎকার করে ডাকতে চাইলাম। ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে চাইলাম আগের মতো। কিচ্ছু করতে পারছি না! এক বিন্দু ও নড়তে পারছি না। এত কাছে থেকেও আমি মাকে ছুঁতে পারছি না। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। কতদিন পর কাঁদলাম আমি! আমার সমস্ত সত্তা শুধু একটা কথাই বলতে চাচ্ছে ,
মা! মা!! মা ……………!!!

তারপর সব অন্ধকার।

"মৌ! এই মৌ!"
যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে পন্নি আপুর গলা। মিটমিট করে চোখ খুললাম। চোখটা ঝাপসা হয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে কাঁদছিলাম নাকি আমি! দুহাতে চোখ রগড়ে নিলাম। পন্নি আপু উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে আছে। আমি ওর দিকে তাকাতেই মিষ্টি একটা হাসি ফুটলো।
বলল; "যাক! অবশেষে ঘুম ভাংলো তোর! আজ দুদিন পর জাগলি তুই!"
"দুই দিন!" বিড়বিড় করলাম; "কয় তারিখ আজকে?"
"জুনের বারো তারিখ! তুই দেখ উঠতে পারিস কিনা। আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসছি।"
বিছানা থেকে উঠতে গেল ও। আমি খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেললাম।
"আপু! কি হয়েছিল ওইদিন? আমি কিচ্ছু মনে করতে পারছি না!"
"খেয়ে নে আগে। তারপর বলছি।" হাত টা ছাড়িয়ে নিয়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে। আমি বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করছি। অবর্ণনীয় ব্যথা পুরো শরীরে স্রোতের মত ছড়িয়ে পড়লো। টলতে টলতে বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে বসলাম। আপু খাবার বাড়ছে। বললাম; "নাও। আমি খাওয়া শুরু করলাম। এবার তো বলো।" কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলতে শুরু করলো ও।

"সেদিন আমরা ছড়িয়ে পড়ে বাড়িটা দেখতে শুরু করেছিলাম। কেউই কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখিনি। দেখা শেষ করে যখন হলরুমে ফিরে এলাম , তখন দেখি আমাদের মধ্যে তুই নেই। কই গেলি তুই! খুঁজতে শুরু করলাম। এঘর ওঘর সবগুলো ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজা শেষ করে একটা ঘরের সামনে এলাম। দরজা খুলে ভিতরে টর্চের আলো ফেলতেই দেখি তুই মেঝেতে পড়ে আছিস। কি হয়েছিল তোর?"
"ও! তোমরা তাহলে প্যারানরমাল কিছুই দেখোনি?"
প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম ওকে।
"নাহ! তুই দেখেছিস?"
"কিজানি! মনে করতে পারছি না।"
মাথা নাড়ালাম।

খাওয়া শেষ করে আম্মুর রুমে গেলাম। অনেক দিন ধরেই অসুস্থ আম্মু। আমাকে দেখে একটা হাসি দিলেন। আম্মুর পাশে শুয়ে জিজ্ঞেস করলাম , "আচ্ছা আম্মু , আমার জন্মের আগে যে মায়ের বাচ্চাগুলি মরে যেত- কিভাবে মরতো?"
"জানিনা রে মা! তোর দাদু বলত "কিছু" একটার নজর পড়ত তোর মায়ের উপর । তাই বাচ্চা গুলো মরে যেত।"
অন্যসময় হলে ফিক করে হেসে ফেলতাম। কিন্তু এখন হাসি আসছে না! ওইদিন রাতে তো আমি দেখেছি; 'কিছু একটা' আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে!

আজো ওইরাতের ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়াই আমি। যদিও কাওকে কিচ্ছু বলিনি। কিন্তু প্রতিনিয়তই ওই ব্যাখ্যাতীত ঘটনার মানে খুঁজি। কেউ অস্বাভাবিক কিছুই দেখেনি বাড়িটায়। আমিই কেনো দেখলাম? জানিনা কি ব্যাখ্যা এর্।
হয়তো ওই রাতে ওই বাড়িটায় আমি কিছুই দেখিনি। হোচট খেয়ে পড়ে জ্ঞান হারানোর পর আর কিছুই ঘটেনি। হয়তো ভূত এফএম এ লোকটার বলা ঘটনাগুলো আমার মনে গভীর ভাবে দাগ কেটেছিল। তাই উল্টাপাল্টা অনুভূতি হয়েছিল। হয়তো আমার অবচেতন মন মাকে দেখতে চায় বলেই মন পুরো ব্যাপার টা স্বপ্নে ঘটিয়েছিল ।
হ্যাঁ! এইটাই ব্যাখ্যা! হয়তো পুরো ব্যাপার টাই একটা স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু এতো বাস্তব স্বপ্ন আমি কখনো দেখিনি। চোখ বন্ধ করলে মায়ের ওই মুখটা এখনো আমার সামনে ভাসে।

হয়তো ওটা স্বপ্নই। তারপরও কথা থেকে যায়। স্বপ্নও এত জীবন্ত হয়!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:১৩
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×