somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ড. মাহাথির মোহাম্মদের ভাষণ

০৯ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[সম্প্রতি মালয়েশিয়ার রাজধানী পুত্রাজায়ায় এক আন্তর্জাতিক ইসলামী সেমিনারে আগত বিশ্বের তরুণ মুসলিম শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়ার প্রধান রূপকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ যে ভাষণ দেন তার প্রতিপাদ্য ছিল, ‘‘মুসলিম বিশ্বের বর্তমান (করুণ) অবস্থাঃ উত্তরণের উপায় যথার্থ বিদ্যার্জন।’’

পরবর্তীতে এ ভাষণের গুরুত্ব বিবেচনায় দি মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ (রাবেতায়ে আলমে ইসলামী) মক্কা হতে তাদের নিজস্ব ম্যাগাজিন ‘জার্নালে’ এটিকে মুদ্রিত ও সারা বিশ্বে প্রচার করে। বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে এটি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উপস্থাপন করা হলো।]



মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অবস্থা কি? আমি তো মনে করি এটি এত নিম্নস্তরে এসে গেছে এবং এর অবস্থা এত টলটলায়মান হয়ে গেছে যে, যে কোন মুহূর্তে ধ্বসে পড়ে চুরমার হয়ে যাবার ঝুঁকির মুখে এসে পৌঁছেছে। ইউরোপিয়ানদের উত্থান ও মুসলিম তুর্কী সাম্রাজ্যের পতনের পর মুসলিম বিশ্ব আর ঐক্য ধরে রাখতে পারলো না; ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হল; বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব করার দাপট ও গৌরব আর ফিরে পেল না। স্বতন্ত্রভাবে কোন রাষ্ট্রই আর এগুতে পারলো না; বিশ্ব সভায় কোন মুসলিম রাষ্ট্রই প্রভাব রাখার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারলো না। তুর্কী মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অনেক মুসলিম দেশই উক্ত সাম্রাজ্য হতে মুক্ত হবার কৌশল হিসাবে ইউরোপিয়ানদের মিত্র হিসাবে বরণ করেছিল। তার ফল হলো উল্টো। তারা তুর্কী মুসলিম সাম্রাজ্য হতে মুক্ত হল ঠিকই সঙ্গে সঙ্গে আবার বৃটিশ ও ফরাসী ঔপনেবিশক শাসনের যাঁতাকলে পড়ে গেল। শেষে অনেক ত্যাগ, সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে এ যাঁতাকল হতে মুক্ত হতে তাদের লেগে গেল দীর্ঘ সময়। শত শত বছর। ফরাসী ও বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের হাত হতে মুক্ত হলেও পূর্ববর্তী মুসলিম সাম্রাজ্যের যুগের সে সাচ্ছন্দ ও সামর্থ আর ফিরে পেল না। তার পরিবর্তে পেল আভ্যন্তরীণ সমস্যা, সংকট, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। ফলে অগ্রগতি হল সুদূর পরাহত। এমনকি কিছু মুসলিম দেশ অনেক প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক অঙ্গণের কোন ক্ষেত্রে কোন প্রকার প্রভাব রাখতে পারলো না; বিশ্বের উন্নত জাতিসমূহের তালিকায় একটি মুসলিম দেশেরও ঠাঁই হলো না।

যে সময়টিতে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটে সে সময় মুসলিম বিশ্ব কিন্তু শতধা বিভক্ত ছিল না। তবুও এ বিপ্লবে তারা শরীক হতে পারলো না; এর সুফলেরও অংশীদার হতে পারলো না। গোঁড়ামী অথবা অজ্ঞতার কারণে শিল্প-বিপ্লবজাত বস্ত্তগত উন্নতি বা এ প্রক্রিয়াকে তারা প্রত্যাখ্যান করলো, এর থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখলো। এভাবে আমরা শুধু শিল্প বিপ্লবকেই হারালাম না; উক্ত বিপ্লব পরবর্তী অনেক উন্নয়ন প্রক্রিয়া হতেও নিজেদের বঞ্চিত করলাম। ইউরোপিয়ানরা যখন এভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন আমরা তাদের দেখেছি সন্দেহের দৃষ্টিতে; বিদআতী হিসাবে। অথচ ইসলামের আদি যুগের অবস্থা ছিল ভিন্ন। মুসলমানেরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ছিল অন্য সব জাতির তুলনায় অনেক এগিয়ে। সেরা চিকিৎসক, অঙ্ক বিশারদ, জ্যোতির্বিদ, ভূগোলশাস্ত্রীবিদগণকে পাওয়া যায় সে যুগের মুসলমানদের মধ্যে। বস্ত্তত ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তি লাভের পেছনে ঐ মুসলিম মনীষীদের অবদানও ছিল অসামান্য।

পরবর্তীকালে জ্ঞান আহরণ (ইলম তলব) এর অপব্যাখ্যা বা ভুল অর্থ করা শুরু হল যে, ইলম বলতে ধর্মীয় শিক্ষাকেই বুঝায় এবং এর বাইরের বিদ্যার্জনের ফলে পরকালে কোন লাভ হবে না, এটি একটি অযথা কাজ (বা পাপকাজ) তখন হতে ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া অন্য সব শিক্ষা উপেক্ষিত হলো। আজো অন্য সব শিক্ষাকে আমরা তাচ্ছিল্য করছি। আজো ধর্মীয় শিক্ষার বাইরের বিষয়াদি নিয়ে যেসব মুসলমান ছাত্র-ছাত্রী লেখাপড়া করছে বা করতে চায় তারাও যেন পাপবোধ হতে মুক্ত হতে পারছে না। তাদের অধিকাংশ সময় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এ যেন প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে পাপ লাঘবের চেষ্টা আর কি। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমান ছাত্ররা উৎকর্ষ সাধন করতে পারছে না, নতুন ও কল্যাণকর কিছু উদ্ভাবন করতে পারছে না, উপহার দিতে পারছে না, অমুসলিম দুনিয়ার সাথে প্রতিযোগিতার ধারে কাছেও আসতে পারছে না।

সে সব কথা বাদই দিলাম। ইসলামের মৌলিক শিক্ষাসমূহের একটিতে মুসলমানদের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ আছে যে, তারা নিজেরা যেন অপরাজেয় শক্তি ও সামর্থের অধিকারী হয়ে বাস করে। নিজেদের প্রতিরক্ষা শক্তি যেন এমন হয় ইসলামের শত্রুরা যা দেখে শুনে ভীত সন্ত্রস্ত থাকতে বাধ্য হয়। এ নির্দেশের ব্যাপারে তারা বেখবর। বর্তমানে তারা এতই দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন যে, মাত্র তের লক্ষ অমুসলিম (ইহুদী) বাহিনীর নিকট বিশ্বের এক কোটি ত্রিশ লক্ষ মুসলমানের তাবৎ শক্তি অসহায়। বস্ত্তত এখন বিশ্বের যে কোন অমুসলিম দেশ পাশ্ববর্তী যে কোন মুসলিম দেশকে নাস্তানাবুদ করে দিতে পারে। আক্রান্ত মুসলিম দেশের তখন অপর অমুসলিম দেশের বা দেশ সমূহের দ্বারে দ্বারে সাহায্য ও সহযোগিতা ভিক্ষা করা ছাড়া আর কোন বিকল্প থাকে না। আর এ কথা সত্য যে, আক্রান্ত মুসলিম ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসার সাহস অন্য কোন মুসলিম দেশের নেই। যেমন মার্কিন আগ্রাসনের শিকার ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া।

এ নিরিখে এখন এটি পরিষ্কার যে বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশী দুর্বল ও হতাশাগ্রস্থ। এ সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানই মুসলমানগণকে আশার আলো প্রদর্শন করাতে পারে। তবে যেনতেন সাধারণ জ্ঞানই এ কাজটি করতে পারবে না এ জন্য চাই অঢ়ঢ়ষরবফ শহড়ষিবফমব বা বাস্তব সম্মত ও প্রায়োগিক জ্ঞান।

সরল কথায় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন ঘটাতে হবে। জ্ঞান ও শক্তি অর্জন প্রশ্নে আমাদের মনন ও তথাকথিত মূল্যবোধ যেভাবে আমাদিগকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চায় তার নাগপাশ হতে আমাদিগকে মুক্ত হতে হবে। আমাদের শিক্ষার ত্রুটির কারণে ও শিক্ষা বিষয়ে একতরফা ও ভুল ব্যাখ্যার প্রভাবে দীর্ঘদিন হতে অধিকাংশ মুসলমান দুনিয়াবী কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্য ভাবতেও নারাজ। পরকাল চিন্তায় মগ্ন থাকতে ও পরকালের সামান (পাথেয়) যোগান করতেই তারা ব্যস্ত। তাদের ভাবনা চিন্তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তাদের কেউ কেউ এমন ভাবছে যে পশ্চাদপদ মুসলিম দেশসমূহ কখনো উন্নত অমুসলিম দেশগুলির মানে পৌঁছুতে পারবে না। তাদের বিশ্বাস মুসলমানগণ যত বেশী ধর্ম-কর্ম বাহ্যিক পোশাক-আশাক, আচার-ব্যবহার ও রীতিনীতিতে ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করবে ততই তাদের মঙ্গল।

আমি শিল্প বিপ্লবের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছিলাম। শিল্প বিপ্লবের পর উৎপাদিত শিল্প পণ্যসমূহকে আমরা অনেকদিন সন্দেহের চোখে দেখেছি। আর এটি করেছি আমরা সে একই কারণে অর্থাৎ শিক্ষার ব্যাপারে ইসলামী নির্দেশের ভুল ব্যাখ্যার কারণে। জ্ঞানার্জনকে আমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে। আর আমাদের বুঝানো হল যে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই ফরজ। অনুরূপভাবে আত্মরক্ষাও ফরজ। এ ফরজের ব্যাপারে আমাদের মুরুববীগণ নির্লিপ্ত। কিভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে? আধুনিক সমরাস্ত্র দিয়ে নাকি পশুর পিঠে চড়ে আদি যুগের তীর, ধনুক, বল্লম, বর্শা তলোয়ারের মাধ্যমে? এ ব্যাপারেও তারা দ্বিধাগ্রস্ত।

ন্যায় বিচারও ফরজ। এ ব্যাপারেও আমরা ব্যর্থ। ইসলাম আসলে কি কি ব্যাপারে অগ্রাধিকার প্রয়োগ করে ভুল শিক্ষণের কারণে আমরা তাই জানতে পারছি না। ধর্ম-কর্মের বাহ্যিক ধরণ ও প্রক্রিয়া আমাদিগকে শেখানো হয় কিন্তু এ সবের সারবত্তা বা লক্ষ্য কি তা আমাদের বলা হয় না।

আমরা অবশ্যই জ্ঞানার্জন করবো। কারণ এটি ফরজ। সঙ্গে সঙ্গে এটি ফরজ হবার পেছনের লক্ষ্যও বুঝে নেব এবং সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই জ্ঞানার্জন করবো। তবেই আমাদের জ্ঞানার্জন সার্থক হবে। খালি চোখে দেখা যায় না, ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায় না, বুঝা যায় না এমন একটি পরমাণুও কি তাচ্ছিল্যের বস্ত্ত? এ পরমাণুর গঠন কাঠামো, এর অভ্যন্তরে কি অমূল্য শক্তি ও সম্পদ লুকিয়ে আছে তা আমরা শিখলাম না, জানলাম না। এখন আমরা এর বিধ্বংসী থাবার মুখে অসহায় দাঁড়িয়ে আছি।

আবার বলছি- আমাদিগকে অবশ্যই এ বিশ্বাস হতে বেরিয়ে আসতে হবে যে, শুধু মাসায়ালা-মাসায়েল সংক্রান্ত ধর্মীয় শিক্ষাই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। জাগতিক শিক্ষার অন্যান্য শাখার অভাবে আমরা যে কত পিছিয়ে পড়েছি- তা আগেই উল্লেখ করেছি। আর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে ও বুঝিয়ে দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কারিগরি বিদ্যা ও শিল্প দক্ষতায় আমরা কোথায় কোন অবস্থানে আছি? আমরা কী নতুন কোন কিছু উদ্ভাবন করতে পারছি? এমন কোন সামরিক শক্তি বা অস্ত্র কি আমাদের আছে যার ফলে শত্রুরা আমাদের সমীহ করতে অথবা যদ্বারা আমরা আত্মরক্ষা করতে সক্ষম? ধর্মীয় শিক্ষার বাইরের কোন শিক্ষা আমাদের কোন কাজে আসবে না এ অপবিশ্বাস হতে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মরক্ষার জোর তাগিদ ইসলামেই আছে। সে বিষয়ে আমরা নির্লিপ্ত থাকবো কেন? আত্মরক্ষার জন্য এখন কোন জিনিসের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন? তা হল শক্তি। প্রকৃত প্রস্তাবে ‘‘নলেজ ইজ পাওয়ার- জ্ঞানই শক্তি।’’ এ শক্তি ও সামর্থ অর্জনের জন্যই প্রয়োজন বিজ্ঞান চর্চা। সত্যিকার অর্থে কোরআন তথা ইসলামে জ্ঞানার্জন সম্পর্কিত হুকুম পালন করতে হলে দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি দুনিয়াবী সব শিক্ষায় আমাদের উৎকর্ষ অর্জন করতে হবে। তাতে অযথা অপরাধবোধ করার কোন কারণ নেই। বরং দ্বীনের প্রতিষ্ঠা ও মুসলমানদের আত্মরক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনীয় সব বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা হবে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের সামিল। বস্ত্তত আমাদের নিজেদের স্বয়ম্ভরতার সাফল্য ক্ষমতা, উৎকর্ষ ইত্যাদি অর্জনে আমাদের শিক্ষা হতে পারে অতি বড় হাতিয়ার। এ শিক্ষাই আবার রাখতে পারে আমাদের ধর্মের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় অবদান।

বিদ্যার্জন সম্পর্কিত নির্দেশাবলীর সঠিক মর্মোপলব্ধি পূর্বক মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটিয়ে যুগোপযোগী তথা চাহিদানুযায়ী বৈষয়িক ও প্রায়োগিক শিক্ষায় ব্রতী হওয়া ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই। এটিই এখন আমাদের সামনে একমাত্র উপায়, এই-ই হচ্ছে একমাত্র হাতিয়ার। আমাদের প্রতিপক্ষীয়রা এর মাধ্যমেই ক্ষমতার্জন করেছে। এর জোরেই এখন বিশ্বে কর্তৃত্ব করছে।

শিক্ষার্জন সম্পর্কিত ইসলামী নির্দেশাবলীর ভুল অর্থ ও অপব্যাখ্যা বিশ্বাস ও আমল করে আর পেছনে পড়ে থাকার অবকাশ আমাদের নেই। এ ভুল ব্যাখ্যার কারণে ইতিপূর্বে শিল্প বিপ্লব ধরতে পারিনি, প্রথম প্রথম বিদ্যুৎও ব্যবহার করিনি, শিল্প কারখানায় উৎপাদিত দ্রব্য ব্যবহার করিনি। রেডিও শুনিনি, টেলিভিশন দেখিনি; অথচ এখন মিডিয়ার যুগ। প্রিন্ট ও ইলেক্টনিক্স মিডিয়ার সম্মিলিত সন্ত্রাসে মুসলিম ব্যক্তিত্ব, সংগঠন ও মুসলিম বিশ্ব দিশেহারা। আমাদেরকে বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে। যে বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত নব নব আবিষ্কারে পৃথিবীকে বিস্মিত করছে আমরা সে বিজ্ঞানের অবদানে চোখ বুজে থাকতে পারি না। আমাদের সন্তানদেরকেও বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে বিরত রাখতে পারিনা। কারণ আমরাও বিশ্ব সভার সদস্য।

ইসলাম শুধু ৭ম খৃষ্টাব্দের ধর্ম নয়। এটি সর্বকালীন ধর্ম। পরিবর্তনশীল বিশ্বে প্রগতির ধর্ম। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। এখন ১৪০০ বছর পূর্বের অবস্থা ও পরিবেশ নেই। আমরা যদি ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝি তাহলে দেখব যে ইসলাম পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে অনুমোদন করে। এটি স্থবির ধর্ম নয়। সর্ব পরিস্থিতিতে সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি ইসলাম দিয়ে রেখেছে। ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমে নতুন পরিস্থিতির মোকাবেলা এবং নতুন উদ্ভাবন ও আবিষ্কারকে আত্মস্থ করা যায়। মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে যারা এ বিষয়ে কিছুটা চিন্তা-গবেষণা করেছে তারা কিছুটা হলেও উন্নতি লাভ করেছে।

এক মালয়েশীয় ধর্মপরায়ণা মুসলিম মহিলা ইউরোপের এক রেস্তোরাঁয় সময়মত নামায আদায় করার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সুবিধামত স্থান খুঁজে না পেয়ে অবশেষে টয়লেটে ঢুকে নামায আদায় করে শান্ত হলেন। এ দ্বারা বুঝা গেল নামায বিষয়ক মাসায়েল গুলিও তিনি সঠিক জানেন না। ভ্রমণের সময় প্রয়োজনে ক্ষাণিক পূর্বে বা পরে নামায আদায় করা যায়। সংক্ষিপ্ত (কসর) করা যায় এসব তাঁর জানা ছিল না। আমাদের বোঝা ও কষ্ট লাঘব করার জন্য আল্লাহ্ পাক অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও সাহাবীগণ তা অনুশীলন করে দেখিয়ে গিয়েছেন। আমরা যারা এসব সুযোগ গ্রহণ করি না তারা প্রকারান্তরে আল্লাহ্র নেয়ামতকে প্রত্যাখ্যান করি।

আমাদের পশ্চাদপদতার জন্য ইসলাম মোটেই দায়ী নয়, দায়ী হচ্ছে আমাদের গোড়ামী; ভুল জ্ঞান অর্জন ও ভুল ব্যাখ্যা অবলম্বন। জ্ঞান-অন্বেষা সম্পর্কিত নির্দেশাবলীর অপব্যাখ্যার কারণেই বর্তমানে আমাদের এ দৈন্যদশা, এ অসহায় অবস্থা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোন শাখায়ই আমাদের কোন অবদান বর্তমানে নেই। অথচ জ্ঞানই হলো যোগ্যতা ও সামর্থ অর্জনের একমাত্র হাতিয়ার।

যে জ্ঞানের ব্যবহারিক মূল্য আছে, প্রয়োগ আছে, যে জ্ঞান বাস্তবে কল্যাণ ও উন্নয়নের দিশা দেয় সে জ্ঞানকে অবহেলা করার মত আহম্মকী আর কি হতে পারে?

ক্ষমতা ও কর্তৃত্বার্জনে সহায়ক লেখাপড়া অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত সব চাহিদা পূরণে অবদান রাখতে পারে। জ্ঞান স্থিতিশীল নয়, চলমান। এটি নতুন নতুন আঙ্গিকে চর্চিত হচ্ছে, ব্যাপকভাবে ফলাও হচ্ছে। তাই আমাদের জ্ঞানের সন্ধান হতে হবে সার্বক্ষণিক ও অবিরাম। বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় আমাদের বিশেষজ্ঞ থাকতে হবে। চিকিৎসা, গণিত, তথ্য প্রযুক্তিসহ বিজ্ঞানের সব শাখার উৎকর্ষ মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের অর্জন করতে হবে।

একশত ত্রিশ কোটি মুসলমানের আর পেছনে তাকিয়ে থাকার অবকাশ নেই। এক্ষুণি ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে সামনে দুর্বার গতিতে। বিজ্ঞানের নিবিড় চর্চার মাধ্যমে আগামী দিনের নেতৃত্ব তাদেরকেই গ্রহণ করতে হবে; এবং তাদের জন্য এটি মোটেও কোন কঠিন কাজ নয়। উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের বাকি কাজগুলির দায়িত্ব তাদেরকেই নিতে হবে। কারণ তারাই শ্রেষ্ঠ জাতি ও শ্রেষ্ঠ জাতির সন্তান। পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষাও থাকতে হবে, থাকতে হবে প্রকৃত উলামায়ে হাক্কানী ও রাববানী। এভাবে বিভিন্ন ধারার সুসমন্বিত শিক্ষার আলোকে উদ্ভাসিত মুসলিম মিল্লাহ্ একটি সুন্দর আদর্শ, নৈতিক ও শক্তিশালী জাতি হিসাবে আবার বিশ্বে সবার উপরে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন জগতের দরজা খোলার দায়িত্ব শত্রুদের হাতে ন্যস্ত করে নিজেরা নিরব দর্শক হয়ে বসে থাকার দিন শেষ। এ দায়িত্ব এখন আমাদের তরুণদের নিতে হবে। অতীতে একসময় মুসলমানেরাই ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুরোধা। পরে আমাদের দুর্বলতার সুযোগে ইউরোপীয়রা কৌশলে আমাদের সেই সৌধ, সেই জ্ঞানের, তত্ত্বের ও তথ্যের সৌধ দখল ও আয়ত্ব করে শিল্প বিপ্লব ও শিল্প উন্নয়ন ঘটিয়েছে। হিসাব নিকাশের সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া সংক্রান্ত শাস্ত্র আলগোরিদম (অষমড়ৎরঃযস) এর জনক আল খারিজমি ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান। বিখ্যাত এ মুসলিম মনীষীর অষমড়ৎরঃযস এর পদ্ধতি অনুসরণেই বর্তমানে মাইক্রো চিপের সার্কিট তৈরি হচ্ছে। এই মাইক্রো চিপের মাধ্যমে কম্পিউটার সমগ্র বিশ্বের চিত্র বদলে দিয়েছে। এ আলগোরিদমের বদৌলতেই পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা এখন তথ্য প্রযুক্তির সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার নির্মাণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছে। দুঃখের বিষয় আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের এই দুর্লভ উদ্ভাবন ও কৃতিত্বকে কাজে লাগাতে ও এগিয়ে নিতে পারিনি।

তাই বলছিলাম, আমাদের জ্ঞানেন্দ্রীয় গুলিকে আবার শাণিত করতে হবে। জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সর্বোচ্চ দক্ষতার্জন ও বাস্তব জীবনে এসবের প্রয়োগের মাধ্যমে মুসলমানেরা আবার তাদের অতীত গৌরব ফিরে পেতে পারে।

অবশ্যই পারে। তার প্রমাণ আমাদের প্রবাসী মেধাবী ছাত্রগণ। উন্নত বিশ্বে (ইউরোপ-আমেরিকায়) গিয়ে মুসলমান মেধাবীরা প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধার সুবাদে অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছে, প্রতিভার প্রতিযোগিতায় কোন কোন ক্ষেত্রে অন্যান্যদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপ ও আমেরিকা বৃত্তি দিয়ে, ভাল বেতন দিয়ে আমাদের মেধাবী সন্তানদের চিরদিনের জন্য তাদের গোলাম বানিয়ে রাখছে। স্বদেশে ফিরে আসছে না। মাতৃভূমির উন্নয়নে কোন অবদান রাখছে না।

জ্ঞানই শক্তি। এ সত্যটি আমরা সবাই বলি ও জানি। এ শক্তি অর্জনের আয়ত্ব করার ও কাজে লাগাবার দক্ষতা হাসিল করতে পারলেই মুসলমানগণ অন্যদের সহিত প্রতিযোগিতা করতে পারে ও অপদস্ত অবস্থা হতে বেরিয়ে আসতে পারে। জ্ঞান স্থিতিশীল নয় তা আগেও বলেছি। নিত্য এর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটছে। যে গতিতে নব ও অভিনব আবিষ্কারের পর আবিষ্কার, বিস্ময়ের পর বিস্ময় আসছে তা ছিল অবশ্যই আমাদের চিন্তার অতীত। তাই ভবিষ্যত আমাদের জন্য কষ্টকল্প। অর্থাৎ নব নব আরও কী আবিষ্কার হবে তা কল্পনা করতে অপারগ।

ভুল শিক্ষাজনিত কারণে অথবা ভাগ্যের পরিহাসজনিত কারণে আমরা এখন যে স্তরে আছি তা হতে আমাদের প্রতিপক্ষীয়দের স্তরে পৌঁছুতে বেশ সময় লাগবে। শতবর্ষও লেগে যেতে পারে।

স্মরণ রাখতে হবে যে, ইসলামী সভ্যতার সেই স্বর্ণযুগে যখন মুসলমান পন্ডিত, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকগণ বিশ্বকে শুধু আলোকিত করে যাচ্ছিলেন তখন ইউরোপীয়রা সে জ্ঞানকে লুপে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছিল। এতে মুসলমানদের সমকক্ষ হতে তাদের লেগে যায় শত শত বছর। এখন আবার আমাদের হৃত গৌরব ও কৃতিত্ব পুনরুদ্ধারে বা বর্তমান উন্নত বিশ্বের সমকক্ষ হতে এবং তাদেরকে অতিক্রম করতে আমাদেরও কিছু সময় লাগবে বৈকি। আশার কথা হচ্ছে যে, এখন আর জ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপার গুলো গোপন নেই। প্রতিরক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু কিছু বিষয় ছাড়া আর সবই উন্মুক্ত ও সহজলভ্য।

জ্ঞানের ক্ষেত্র অত্যন্ত বিশাল। আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে হবে ধাপে ধাপে, ভাগে ভাগে। আমরা যদি মনে প্রাণে প্রতিজ্ঞ হই, ব্রতী হই, ইনশাআল্লাহ্ আমরা আবার শিক্ষা, গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চর্চা, ব্যবহার ও প্রয়োগের মাধ্যমে তাবৎ জ্ঞানের শাখা-প্রশাখায় এগুতে এগুতে উচ্চ শিখরে পৌঁছুতে পারবোই এবং তা পারতেই হবে। কারণ ক্ষমতায় আরোহণের এটিই উপায় ; আর জ্ঞানই ক্ষমতার চাবিকাঠি। ইতিহাস সে সাক্ষ্যই বহন করে।

আমরা বুঝি, মানি ও একমত যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার সিঁড়ি হচ্ছে শিক্ষা। সেমিনার, কনফারেন্সের মাধ্যমে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেই আমরা দায়িত্ব শেষ করেছি বলে মনে করলে চলবে না। এরূপ সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাবাবলী এ যাবৎ অনেক হয়েছে। এখন সময়ের দাবী কি কি, সে সব মস্তিষ্কে ও মননে রেখে, কালবিলম্ব না করে লক্ষ্যর্জনে এক্ষুণি ব্রতী হওয়া ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই।



অনুবাদঃ মুহাম্মদ মিছবাহুল ইসলাম)(সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১:৫০
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা

লিখেছেন মুনতাসির, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪৩

বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×